Advertisement
  • এই মুহূর্তে দে । শ
  • জুন ১২, ২০২৪

সেলিব্রিটি জামাইকে ঘিরে আজও মাতে বিষ্ণুপ্রিয়ার গ্রাম

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
সেলিব্রিটি জামাইকে ঘিরে আজও মাতে বিষ্ণুপ্রিয়ার গ্রাম

গৌর-গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে কাকভোর থেকেই সাজো সাজো রব। জামাই আসবেন যে ! এতো যে সে জামাই নন, রীতিমত সেলিব্রিটি জামাই। মহাপ্রভু জামাইষষ্ঠীর সকালে পা রাখবেন শ্বশুরঘরে। তবে আসল শ্বশুরঘর রামচন্দ্রপুরতো এখন আর নেই। কবেই ভাগীরথী গোটা গ্রামটাকেই গিলে নিয়েছে। তাই নবদ্বীপ এলাকার ধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মন্দিরেই জামাইষষ্ঠীর বন্দোবস্ত হয়। সেই কবেকাল থেকে আজও গৌরাঙ্গ বরণ থেকে শুরু করে জামাইষষ্ঠীর যাবতীয় আয়োজনে মাতেন মহাপ্রভুর অর্ধাঙ্গিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার বংশধররা। নদিয়া আর পূর্ব বর্ধমানের নাদনঘাট সীমান্তের গৌরাঙ্গ মন্দিরে জামাইষষ্ঠী দেখতে এখনও বহু বৈষ্ণবপ্রাণ মানুষজন ছুটে আসেন। পুরনো আবেগ আর ঐতিহ্য যথাসম্ভব বজায় রেখে জামাইষষ্ঠীর আয়োজন হয় বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিবারে।

বৈষ্ণবতীর্থ অনুসন্ধানী রণদেব মুখোপাধ্যায় মনে করালেন, গৌরাঙ্গ-জায়া বিষ্ণুপ্রিয়া তাঁর ভাই যাদবাচার্যের পুত্র মাধবাচার্যকে ‘দত্তক’ নিয়েছিলেন। সেই মাধবাচার্যের বংশধররাই বংশপরম্পরায় বছরের এই একটি দিনে দেবতার আসন থেকে মহাপ্রভুকে ‘নামিয়ে’ জামাইয়ের আসনে বসান। বরণে-আপ্যায়নে মাতেন। এবার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্য জামাইষষ্ঠীর আয়োজন মাধবাচার্যের চতুর্দশ বংশধরদের। সুদিন গোস্বামী নামে সেই বংশধর জানালেন, ‘পুরনো প্রথা মেনে এবারও জামাই-বরণ থেকে শুরু করে জামাইষষ্ঠীর যাবতীয় পরম্পরা সুসম্পন্ন হয়েছে।’

সেই পরম্পররার খোঁজে গিয়ে যে ছবি দেখা গেল, তা হচ্ছে, ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেলপথের নবদ্বীপধাম স্টেশনের নাকের ডগায় বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট। ভাগীরথী লাগোয়া এই হল্ট স্টেশনের গায়ে রামচন্দ্রপুরেই ছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার বাপেরবাড়ি। জামাইষষ্ঠীতে বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিবারের বর্তমান বংশধররা সকাল সকাল ভাগীরথীতে ডুব দিয়ে নাটমন্দিরে জড়ো হন। সেখানেই জামাইকে বরণ করার পর দিনভর চলে জামাইকে খাওয়ানো-দাওয়ানো, জামাইকে নিয়ে খুনসুটি। সকালের শুরুটা হয় মঙ্গলারতির মাধ্যমে জামাইকে বরণ করে। তারপর মহাপ্রভুকে জামাইয়ের বেশ পরানো হয়। গরদের জোড়, চিকনের পাঞ্জাবি, পীত রংয়ের উত্তরীয়, মাথায় পাগড়ি। পরানো হয় জুঁই-রজনীগন্ধা-বেলফুলের মালা। ফুলের তৈরি বালা পরিয়ে দেওয়া হয় দু’হাতে। মাখানো হয় চন্দন, আতরের সুগন্ধি। বরণডালা সাজানো হয় ধান, দূর্বা, হরিতকি, আমপাতা, বাঁশপাতা দিয়ে। গরমে জামাই যাতে কাহিল হয়ে না পড়েন সেজন্য পুরনারীরা তালপাতার পাখার বাতাস করেন।

খাবারের আয়োজনও এলাহি। কাঁসা-পিতলের তৈরি বিভিন্ন সাইজের বাসনকোসনে খাবার সাজিয়ে পরিবেশন করা হয় ‘জামাইরাজা’কে। জলখাবারে থাকে ফলের সমারোহ। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, বেল, তরমুজ, সন্দেশ, দইয়ের সরবত। মধ্যাহ্নভোজ কাঠের উনুনে রান্না করতে হয়। গিয়ে দেখা তীব্র গরমে ঘেমেনেয়ে একশা রাঁধুনির দল। তাতে অবশ্য ক্লান্তি নেই। জামাইয়ের জন্য স্পেশ্যাল পদ তৈরি করছেন ভক্তি আর নিষ্ঠার সঙ্গে। মেনুতে রয়েছে বাসমতী চালের ভাত, শাক, শুক্তো, ৫ রকমের ভাজাভুজি, সোনামুগের ডাল, পোস্ত, মোচার ঘন্ট, ফুলকপির রোস্ট, ছানার রসা, আমের চাটনি, পায়েস। মিষ্টান্নেরও হরেক পদ। পরিবেশন করা হয় নানান সাইজের রুপোর পাত্রে। তালিকায় রয়েছে রাজভোগ, লাল দই, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, কাটোয়ার পানতোয়া, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া, রানাঘাটের সন্দেশ। শেষ পাতে মিঠা পান আর সুগন্ধি মশলা। ভোগের আগে আরতি হয়। তখন মহাপ্রভুকে নতুন পাঞ্জাবি পরানো হয়। ‘ডিনারের’ মেন্যুতেও নানান পদ। লুচি, ডাল, মালপোয়া, রাবড়ি, মিষ্টি, সন্দেশ, ক্ষীর। জামাইয়ের খাওয়ার পর সেই ভোগ বিতরণ করা হয় ভক্তদের মধ্যে। ভোগ গ্রহণের জন্য ভক্তদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। একদিনের জামাই গৌরাঙ্গ পরদিন আবার মহাপ্রভু হয়ে যান। মানুষ না দেবতা, কে বেশি আপন, সেই সংশয় না মিটতেই আবার একটা জামাইষষ্ঠীর ভোর এসে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টে থামে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!