- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ প্রচ্ছদ রচনা
- এপ্রিল ১১, ২০২৩
বাংলাকে সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি জানালে কি ভেঙে পড়বে শাসকের মহা পর্বত ?
ঈশানের পুঞ্জমেঘে ছলাৎ ছলাৎ বেদনার চিহ্ন ভেসে উঠছে, দিন কয়েকের মধ্যে বড়াইল পাহাড়ের নিম্নভূমিতে গর্জন শুরু হবে, মিছিল ছুটবে, নড়ে উঠবে বর্ণমালার আহত বোধিবৃক্ষ। কেননা সামনে পবিত্র, রক্তাক্ত ১৯ মে, স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যে কোনো স্তরে দিনটি আমাদের শোকাতুর দ্রোহ আর অবরুদ্ধ বিদ্রোহে অবশ্যই শান দেবে, আমরা জড়ো হয়ে বিভাজনের চক্রান্তে ঘা দিয়ে একদিন, দুদিন, কিছুদিন ঐক্যের হাঁক দেব, প্রতিবছর যা হয়, এবারও তা হবে, গ্রাম শহরের শ্রেণী বিন্যাস, যা চেনা, সংক্রামক অসুখের মতো আমাদের চেতনা আর ভাবাবেগকে গ্রাস করে আছে, সে সব তাৎক্ষণিকের ভঙ্গি দেখে সাময়িকভাবে পিছু হটবে। তারপর আবার ‘ভাগ করো,শাসন করো’-র প্রত্যাবর্তন অনিবার্য। বরাকের গ্রাম-শহরে বেয়াদব একই রেওয়াজ বদলাবে না।
একসময় কাটাখাল থেকে মিজোরামের কিছুটা অদূরে লালা পর্যন্ত বার্ণ কোম্পানির উল্টো ট্রেন ছুটত। পেছনে ইঞ্জিন, সামনে রেলের বগি। উল্টোদেশের সে এক আজব কীর্তি। সে ট্রেন সম্ভবত এখন আর নেই। কিন্তু উল্টো গৌরব থেকে আজও বরাকের রেহাই নেই। আজও গ্রামীণ বরাক একদিকে, আর গ্রাম্যতাদুষ্ট, শ্রেণী সচেতন শহর আরেক দিকে। এমন কোনো ইস্যু নেই, যেখানে বরাকের অখণ্ড, ঐক্যরূপ দৃশ্যগত হয়ে ওঠে। ১৯৪৭-এর গণভোট সহ এপর্যন্ত, এমন কোনো মুহূর্ত নেই, যেখানে বরাকের জনমতে, গণকণ্ঠে একসুর, একই আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছে। ১৯৬১-র ভাষা আন্দোলনে, একাদশ বীর বীরাঙ্গনার মৃত্যুর আগে-পরেও ঐক্যের দেখা মেলেনি। পরে, যে কোনো ইস্যুতে অনৈক্য আরো বেড়েছে, অসমের কতিপয় ভাগ্যবানের রাজনীতি প্রতিটি মুহুর্তে সুযোগ খুঁজে কোপ মেরেছে, বরাককে ঘায়েল করেছে, চাপিয়ে দিয়েছে বঞ্চনা, বঞ্চনার পীড়ন সহ্য করেও শ্রেণীবিভক্ত, সম্প্রদায় ঘেঁষা অন্ধ আত্মছলনার ঘেটো থেকে বরাকের জনসত্ত্বা, যা মূলত জাতিসত্ত্বা— কখনো বাইরে বের হতে পারে না।
গত কয়েক বছরে গ্রামাঞ্চলে, শহরেও গেরুয়া উত্থান, গণতান্ত্রিকতার ছদ্মবেশে তাবিজ পড়া রাজনীতির অনুপ্রবেশ যত বেড়েছে, ততই বিশেষ করে ভোটের মুহুর্তে, সাম্প্রদায়িক চেতনা উগ্রতার চেহারা ধারণ করে মূল ও মৌলিক ইস্যুকে আড়াল করবার বিরামহীন চেষ্টায় শুধু সফলই হয়নি, তার সাফল্যের জোর কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। প্রতিটি ভোটের আগে, ৪৭-এর গণভোটের পরিস্থিতি ফিরে আসে, পালিয়ে যায় মনুষ্যত্ব , ব্যবহারিক ভাষাতত্ত্বের যাবতীয় নিয়ম-কানুন।এসব বলতে গিয়ে, পীড়িতবোধ করছি যে, খণ্ড খণ্ড পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এরকম খণ্ডিত মানসিকতার রূপকার কে ? পুজোর ছলে পুজিতকে অপমান করার কারিগর কারা, তা কেন খুঁজে দেখি না আমরা? কেন লৌকিকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই স্বার্থসর্বস্ব অলৌকিকের নির্বোধ আস্ফালন ? কেন, ভাষাগত প্রশ্নে, যা বাংলার ‘ইষ্টার্ন মোস্ট’ ডায়ালেক্টের (উপভাষার) নিহিত, অন্তরঙ্গ স্রোত — তার চিরায়ত ধর্মে ঢেলে দিই আরোপিত অভিশাপ। শীতলং শাহ থেকে হাসন রাজা, মহৎপ্রাণ পদকর্তা সইফুল মিঞার জন্মান্ধ দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনোহর দৃষ্টি জাগিয়ে রাখত যা, তাকে আমরাক প্রায় ব্রাত্য করে তুলছি কোন ভৌতিক ফিকিরে ? সর্বনাশা, আত্মঘাতী ফিকির। মিলিত যৌবনকে, যৌবনের ঔদার্যকে ছিনিয়ে নিচ্ছে । আড়ালে, সম্মুখে। সম্মুখের শত্রুর গতিবিধি চেনা যায়, কিন্তু যে অগোচরে, শ্রেণীগত সম্প্রদায়গত জোট বাঁধছে, আর্যাবর্তের ধর্মচ্যুত আগন্তুকদের সঙ্গে সমাজের গিঁট তৈরিতে ব্যস্ত বরাকে, বহুভাষিক সুন্দরের গোটা উত্তর-পূর্বে তাঁদের একভাষিক আধিপত্যবোধের প্রবেশ আর অনুপ্রবেশের দ্বার ও ধার আমাদের ভোঁতা বানিয়ে দিচ্ছে। সঙ্কটের মুহুর্তে, সায়েলেণ্ট মেজরিটির উদাসীনতা নিয়ে আমরা স্তব্ধ। আমরা নিশ্চুপ। কে লাগাম পরিয়ে দেয় আমাদের মুখে ? দহনের মুহূর্তে কে অঙ্গুলি নির্দেশে হুকুম দেয়, একদম চুপ ? সে কি বহিরাগত ? না আমাদেরই ভেতরের দ্বন্দ্বপীড়িত ভীরুতা ? যাকে শাসন করে দৃশ্যমান শক্তি, যে শক্তিকে হয় আমরা সমীহ করি,নয় তো অনাগত সাম্প্রদায়িক ঐক্যের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিভাজনের রীতি ও নীতিকে পুজো করতে উদগ্রীব, অতি উদগ্রীব আমরা। এখানেও মানবিক কিংবা জাতিগত ঐক্যের চেয়ে সম্প্রদায়গত ঐক্যকে ক্ষমতামত্ত করে তুলছি নিঃশব্দে। কখনো মৃদু স্বরে।আমাদেরই, এরকম সরবতা আর নীরবতার একটি প্রাসঙ্গিক আর সাম্প্রতিক ছবির পেশ করবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
এককোটি বাঙালির প্রমিত ও মৌখিক ভাষাকে সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি জানাতে সরকারের অনীহার কারণ কী? বঙ্গভাষীদের সংখ্যাধিক্য ? শাসক গোষ্ঠীর একাধিক চিন্তাভাবনার আড়ালে জাতিগত, ভাষাগত বিদ্বেষ ? না রাজনীতির ক্ষুদ্রতা?
অসম বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে, বাংলাকে সহযোগী সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কমলাক্ষ্য দে পুরকায়স্থ। করিমগঞ্জ থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস বিধায়ক। নওজোয়ান। কর্মঠ। জাতিসত্তার দুর্বিসহ যন্ত্রণা হামেশা ছুঁয়ে আছে তাঁকে। শাসক গোষ্ঠী, নিঃশব্দে বিষয়টি কৌশলে বরাকের আত্মঘাতী, আত্মদ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দেয়। বরাক থেকে নির্বাচিত বিজেপি সদস্যরা হৈ হৈ করে উঠলেন। অন্যরা নীরব আর সর্ব ভূমিকায় অবতীর্ন। কেউ কেউ সরকারের একাধিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ততটা মুখর হলেন, তার চেয়েও বেশি উদাসীনতার ছায়া ভেসে উঠল সমাজের নানা স্তরে, যেন কমলাক্ষ্যের দাবিটি অনর্থক, সঙ্গতিহীন। সরকার আর প্রশ্নহীন আনুগত্যবাদী বিধায়কদের নিন্দা করল, শুধু (আমরা যতটুকু জানি) বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট। প্রেস বিবৃতিতে বিডিএফ এর আহবায়ক প্রদীপ দত্ত রায় প্রশ্ন তুললেন, পাঁচ শতাংশ বড়ো জনগোষ্ঠীর ভাষা সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি পেয়ে গেল। ভালো লক্ষণ! কিন্তু এককোটি বাঙালির প্রমিত ও মৌখিক ভাষাকে সহযোগী ভাষার স্বীকৃতি জানাতে সরকারের অনীহার কারণ কী? বঙ্গভাষীদের সংখ্যাধিক্য ? শাসক গোষ্ঠীর একাধিক চিন্তাভাবনার আড়ালে জাতিগত, ভাষাগত বিদ্বেষ ? না রাজনীতির ক্ষুদ্রতা? বরাক থেকে নির্বাচিত বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের নিন্দা করেছেন প্রদীপ—বলেছেন, ভারতীয় জনতা দল যে আদতে বাংলা বিরোধী, বাঙালি বিদ্বেষী তা পুর্নস্থাপিত, প্রমাণিত হয়ে গেল।
ভাষাপ্রশ্নে, ১৯৬১ সালে, রক্ত ভাসানো, রক্ত ঝরানো মুহূর্তে অসম বিধানসভার বাঙালি জন প্রতিনিধিরা বিনা প্ৰশ্নে, একসঙ্গে পদত্যাগ করেছিলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব আর রাজনীতিকে বিলকুল প্রশ্রয় দেননি তাঁরা। ১৯৭২ সালে, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একপেশে ভাষা নির্দেশিকার মোকাবিলায় অসমের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন স্তম্ভিত, অক্রান্ত তখন বরাকের অঙ্গীকার, খন্ডিত বাঙালি জাতিসত্তার সংযম আর গর্জন ভাবিয়ে তুলেছিল সরকারকে। হিংসা ছড়িয়ে পড়লো নিম্ন ও উজান অসমে, অশান্তি দূরে সরিয়ে ঐক্যবদ্ধ জনমত গড়ে তুলল বরাকের তারুণ্য। করিমগঞ্জে রহস্যজনক ভাবে খুন হলেন একজন যুব নেতা, ডিব্রুগড়ে বেহদিস আরেকজন ছাত্র, নিম্ন অসমে প্রাণ হারালো এক অসমিয়া কিশোর। অরাজক পরিস্থিতি। বাধ্যতামূলক ওলট পালটে নড়ে উঠলো পারিপার্শিক আর বিড়ম্বিত ভাষিক সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব। সেদিনও দিক হারায়নি বরাকের বাঙালি। ব্রক্ষপুত্র উপত্যকা দিশা হারাল ১৯৬৯-এ। হঠাৎ গুজব ছড়ালো লক্ষ্য লক্ষ্য বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশে অসম বিপন্ন। তখন থেকেই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানের রাজনীতির রং বদল শুরু। তবু, সম্প্রদায়গত ক্ষুদ্রতাকে বিশেষ আমল দেয়নি অসমিয়া ছাত্রশক্তি। শিক্ষাঙ্গন, রাস্তা, ময়দান তাদের দখলে, আবেগে সবাই ভাসছে, সরকার ঠুটো জগন্নাথ, সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তুলল সারা আসাম ছাত্র সংস্থা (আসু)। পরে তারাই ক্ষমতা দখল করল, দখল করেই ভাষিক অধিপত্যবোধের সংক্রামক আর পুরনো অসুখে তারাও আক্রান্ত হলো।
বৃহত্তর অসমিয়া জাতিগঠন আর জাতিসত্তার ইতিহাসে এযেন এক স্থায়ী ব্যাধি। এরকম বিপন্ন মুহূর্তে সঙ্কটিত, সঙ্কুচিত বোধ তাকে, তার ইন্দো তিব্বতি পরিচিতিকে বিভ্রান্ত করে দেয়। জুলাই, ১৯৮৬। কার নির্দেশে বোঝা কঠিন, অসম মধ্যশিক্ষা পর্ষদ (সেবি) জোর করে স্কুলের পঠন পাঠনে অসমিয়া চাপিয়ে দিতে চাইল। বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় গর্জে উচল বরাক আর জনজাতি অধ্যষিত বড়োভূমি। করিমগঞ্জে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের উপস্থিতিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। মারা গেলেন দুই ছাত্র নেতা। বরাকে তখন কংগ্রেসের এক চেটিয়া প্রভাব। একটিমাত্র আসন অগপর। বিজেপি শূণ্য। কংগ্রেসের ব্যানারে নয়, স্বাভাবিক ভাবাবেগে বরাক তখন ঐক্যবদ্ধ। রাস্তায় নামল ছাত্র জনতা ও সামাজিক নেতৃত্ব। ওই ঐক্যের আবহ এখন উজ্জ্বল অতীত। ওই ঔজ্জ্বল্যকেও নিভিয়ে দিতে চাইছে শাসকের নিঃশব্দ আগ্রাসী ইচ্ছা। কৌশলপূর্ণ পুনরাবৃত্তি আবার শুরু হয়েছে, কৌশলের দুটি দিক। এক, গুঁড়িয়ে দাও বাঙালির অখন্ডবোধের স্বাতন্ত্র্য। সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখা বড়ো করে ছড়িয়ে দাও মনোজগতে, লোকায়তের নৈসর্গিক চিত্রপটে। দুই, দৃশ্যগত ভাষাপ্রীতিকে থমকে দাও, সব রাস্তা বন্ধ করো তার। প্রয়োজনে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে চওড়া করো ফাটলকে, প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠুক বাঙালির আত্মঘাতী দ্বন্দ্বের মূর্তি। এরকম ধূর্ত চালচিত্রই জাগিয়ে রাখল বিজেপি শাসিত অসম বিধানসভাকে।
সঙ্গত দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেসের বিধায়ক কমলাক্ষ্য। কাউকে ঘা দেননি। নিন্দার ফাঁদে পা দেননি। বরাকের কতিপয় বিধায়করা যে ভাষায়, যে ক্রুড় মনোভাব নিয়ে কমলাক্ষ্যকে কটাক্ষ আর হেয় করেছেন, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? দলীয় আদর্শ আর নিয়ম মেনে সমবেত তাল ঠুকলেন অনুশাসিত কাকাতুয়াদের অংশ বিশেষ। তাঁরা নমস্য। প্রণম্য। গেরুয়া হাওয়া গায়ে মেখে প্রকারন্তরে জানিয়ে দিলেন, বিজেপি মানেই বাংলাভাষা আর বাঙালির বিরুদ্ধ শক্তি। একই মায়ের সন্তানকে ডুবতে দেখেও তাদের অপরিহার্য জিজ্ঞাসা, লোকটার পরিচয় কী?
প্রসঙ্গত বলা জরুরি, বড়োদের ভাষা ও সামাজিক আন্দোলনে সামিল হয়ে, পুলিশের গুলিতে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবার প্রতি ৬ লক্ষ টাকা করে অনুদান দিয়েছে সরকার। অসম আন্দোলনের ‘শহিদ’দের ৭৬৭ পরিবারের জন্য একইভাবে সরকারি অনুদান বরাদ্দ।
কিন্তু এই সময়ে, সঙ্ঘর্ষে, হামলায় নেলি সহ বিভিন্ন অঞ্চলে যে সব ভাষিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য খুন হয়েছিলেন, তাঁদের দিকে কোনো সরকার মুখে তুলে তাকায়নি। নেলির দুঃস্বপ্ন আজও স্বজনহারাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সুবিচার মেলেনি। ১৯৬১ সালে বরাকের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ১১ জনের । একমাস পর, ১৯ জন প্ররোচিত সঙ্ঘর্ষ আর পুলিশের গুলিতে নিহত হন অন্তত ১০ জন ( সঠিক সংখ্যার তথ্য নেই) বরাকের ভাষা আন্দোলন আর উসকানিমূলক সংঙ্ঘর্ষে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের কারও পরিবার কি সরকারি অনুদান কিংবা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন?
সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে তাঁরা দ্বিখণ্ডিত। বিজেপির পরিকল্পিত রাজনীতি ছিন্নমূল শহরে বাঙালিকে ‘বাঙালি হিন্দু’ নয় ‘হিন্দু বাঙালি’ বানিয়ে তুলেছে। যেসব গ্রামীন কৃষক, প্রায় দুশো বছর জুড়ে অসমে বাস করেছেন, দুর্যোগ উপেক্ষা করে অসমকে সুজলা সুফলা করে তুলেছেন, ঘটনাচক্রে তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতিই সঙ্ঘপরিবারের প্রধান বিবেচ্য। নিজ বাসভূমেই তাঁরা পরবাসী, অনুপ্রবেশকারী
অথচ ৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্যবাদী ভাষা নীতিকে সমর্থন করে, সঙ্ঘর্ষে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের কারো কারো স্মৃতিতে ইতিহাস ছোঁওয়া হস্টেলের নাম বদল হয়েছে, স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে উঠেছে, সরকারি অর্থে। তার মানে কী দাঁড়ায়? সঙ্ঘর্ষে কিংবা পুলিশের গুলিতে ক্ষমতাহীনদের কেউ কেউ মারা গেলে তাঁরা শহিদ নন, তাঁদের মৃত্যু, মৃত্যু নয়, নিছক ঘটনামাত্র।
অসমিয়া ভাষা প্রেমিকদের সৌভাগ্য, ক্ষমতার রাজনীতি তাঁদের ভাবাবেগের, তাঁদের যুক্তির, তাঁদের ভাষাসেবার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অসমের বঙ্গভাষীরা এদিক থেকে ভাগ্যহত। সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে তাঁরা দ্বিখণ্ডিত। বিজেপির পরিকল্পিত রাজনীতি ছিন্নমূল শহরে বাঙালিকে ‘বাঙালি হিন্দু’ নয় ‘হিন্দু বাঙালি’ বানিয়ে তুলেছে। যেসব গ্রামীন কৃষক, প্রায় দুশো বছর জুড়ে অসমে বাস করেছেন, দুর্যোগ উপেক্ষা করে অসমকে সুজলা সুফলা করে তুলেছেন, ঘটনাচক্রে তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতিই সঙ্ঘপরিবারের প্রধান বিবেচ্য। নিজ বাসভূমেই তাঁরা পরবাসী, অনুপ্রবেশকারী। জোট বেঁধে বিদ্বষ তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তাদের অভ্যন্তরীন স্তানান্তরের কারণ কেউ দেখতে পায় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ভাঙনের হামলা তাঁদের নিয়তি। ক্ষমতাবানের পুলিশ তাঁদের পেটায়, বন্যাবহুল নদীও বাসভূমিতে হামলে পড়ে। এরকম ভাগ্যপীড়িত, নির্যাতিত জনগোষ্ঠী বিশ্বে বিরল। নিজেদের মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে, প্রতিবেশীর মাতৃভাষাকে বুকে জড়িয়ে স্বভাষা ঘোষণা করেও এক কোটিরও বেশি জনসম্পদ লুঠপাট আর নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায় নি। কমলাক্ষ্য এঁদের কথা বলেননি। কেন বলেননি, তা উনিই জানেন। তবু যা বলেছেন, তা সঙ্গত। ভেবে দেখবার বিষয়। বাংলাকে সহযোগী সরকারি ভাষার স্বীকৃতি জানালে অসমের, অসমিয়া জাতি গোষ্ঠীরই মঙ্গল হবে। বহুভাষিকতার স্বপ্নে, কর্মে আর মর্মে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে অসমের মুখ। এই মুখ কেন দেখতে চায় না বিজেপির রাজনীতি?
ক্ষুদ্রতাকে আমল দিতে গিয়ে কতদিন বহুত্বের পথ আটকাবে? আদৌ এটা কি সম্ভব? দৃষ্টির অগোচরে ভাব বিনিময় আর শব্দ বিনিময়ের যে স্রোত বইছে, নিভূত মিলনান্দে নাচছে লোকসত্তা, তাকে বিভ্রান্ত করে ভুল পথে ঠেলে দিয়ে নির্মূল করে দেবে, এরকম শক্তি কোথায়? ক্ষমতার ঔদ্ধত্য আর অহঙ্কারের পরাজয় অনিবার্য। রাজা আসে, রাজা যায়, জেগে থাকে জনসত্তার গ্রহনশীলতা আর গ্রহনযোগ্যতা। বাংলাভাষাকে সহযোগী সরকারি ভাষার স্বীকৃতি জানাবার প্রশ্নে আজ অসমে যারা চোখ রাঙায়, রুখে দাঁড়ায়, তাদের একাল একদিন সেকাল হবেই, হবে।
♦—♦—♦
❤ Support Us