Advertisement
  • এই মুহূর্তে বি। দে । শ
  • ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫

অশান্ত বাংলাদেশ! রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী, অভিনেত্রী শাওন। জ্বালিয়ে দেওয়া হল পৈতৃক বাড়ি

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
অশান্ত বাংলাদেশ!  রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী, অভিনেত্রী শাওন। জ্বালিয়ে দেওয়া হল পৈতৃক বাড়ি

বাংলাদেশে রোষের আগুনে পুড়ছে বিনোদন জগতের মানুষেরা। আটক করা হল বাংলাদেশি অভিনেত্রী, প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমন্ডি থেকে শাওনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। জামালপুরে শাওনের বাবার বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে উত্তেজিত জনতা, লাগানো হয়েছে আগুন।

আবার অশান্ত বাংলাদেশ! অন্তবর্তী সরকারের আমলে সারা দেশে নৈরাজ্য, উগ্র জনতার আস্ফালন। নতুন বাংলাদেশে কখনো বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ও স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনো শেখ মুজিবরের বাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে, কখনো আক্রমণ নেমে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। বৃহস্পতিবার সকালে দেখা গেছে, কেউ হাতুড়ি হাতে কাঠামো ভেঙে নিচ্ছেন, কেউ বই ও আসবাবপত্র টেনে বের করছেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমণ্ডির ভবন থেকে। পার পায়নি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি সুধা সদন ও খুলনার শেখ হাউস। এবার সেই ‘দাবানল’-এর আঁচ পড়ল বিনোদন জগতের শিল্পীদের উপরেও। রাজনৈতিক পালাবদলের পটভূমিতে বাংলাদেশের বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীদের মাঝে বিভাজন দেখা দিয়েছে। দলাদলির মারপ্যাঁচে তাদের অনেকে জনরোষে পড়েছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীরা অনেক ক্ষেত্রে চাইলেও রাজনীতির বাইরে থাকতে পারেন না। যদিও সংস্কৃতিকর্মীরা দলনিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রাখবেন বলে আশা করেন অনেকেই। কারণ, প্রত্যেক শিল্পীর কিছু দায়বদ্ধতা থাকে।

বাংলাদেশে ‘মৌলবাদীদের’ রোষে শিল্পজগত। হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আওয়ামী সমর্থক আর উদারপন্থী কলাকুশলী ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন সঙ্গীত জগতের সুপরিচিত নামেরা। গত আগষ্টে ঢাকায় প্রখ্যাত বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী, ‘জলের গান’ ব্যান্ডের অন্যতম মুখ রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলা করে ৩,০০০ -এর বেশি বাদ্যযন্ত্র ধ্বংস করেছিল একদল দুষ্কীর্তি। এবার অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী, তাঁদের পৈতৃক বাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা যাচ্ছে।

৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কোন অভিযোগে শাওনকে আটক করা হয়েছে জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন।। ডিবি হেফাজতে তাকে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আগামীকাল তাকে সুনির্দিষ্ট মামলায় আদালতে উত্থাপন করে রিমান্ড চাওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। সম্প্রতি শাওনের রাজনৈতিক অবস্থান ও কিছু মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বিকেলে জামালপুরে তার গ্রামের বাড়িতে আগুন দেয় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে পৌঁছে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও অগ্নিসংযোগের পেছনের প্রকৃত কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী জাহাঙ্গীর আলম জানান, নরুন্দি বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হওয়ার পর কিছু বিক্ষোভকারী শাওনের বাবার বাড়ির সামনে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

শাওনের বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলীর এ বাড়িটি তার পারিবারিক সম্পত্তি। তিনি জামালপুর-৪ (সদর) আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তার স্ত্রী বেগম তহুরা আলী ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯-২০২৪ মেয়াদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। শাওন নিজেও আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। সম্প্রতি শাওনের রাজনৈতিক অবস্থান ও কিছু মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-সহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিকেলে জামালপুরে তার গ্রামের বাড়িতে আগুন দেয় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এরপরই তাকে গ্রেপ্তারের খবর এলো।

বাংলাদেশে শিল্পী-লেখকদের অধিকার চর্চার পথে বাধা সৃষ্টির ঘটনা আগেও ঘটেছে। দাউদ হায়দার এবং অনেক লেখক কবিকে তো বিদেশেই চলে যেতে হয়েছে। তবে অতি সাম্প্রতিক প্রবণতা একেবারে অন্যরকম। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মননশীল মনে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের পাড়দিয়া গ্রামে দুর্বৃত্তদের হামলায় প- হয় ফকির মন্টু শাহের লালন স্মরণোৎসব। মন্টু শাহ’র নিজ বাড়িতে প্রতি বছর দুই দিনের এ সাধু সংঘে অংশ নেন খুলনা বিভাগের অনেক বাউল শিল্পী। গত নভেম্বরে ফকির মন্টু শাহের লালন স্মরণোৎসবে হামলার ঘটনা ঘটে। নরসিংদীর বেলাবতে বাউলদের আখড়ায় ২০২৪ সালের ৭ মে গান-বাজনার সময় বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী হামলা চালিয়ে বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে। ঠিক একমাস পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের আহমদপুর গ্রামে বাউল নিশান আলীর আখড়া ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আখড়াটিতে সন্ধ্যার পর গানের আসর বসাতেন বাউল-সাধুরা। গত বছরের ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নরসিংহপুর গ্রামে তৌহিদী জনতার ব্যানারে হুমকি দেওয়ায় ‘সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে হওয়ার কথা ছিল দুই দিনের ১১তম মেলাটি। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ শীর্ষক সমাবেশে অর্থনীতিবিদ-শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ বহুজাতি, বহুবর্ণ ও বহু বৈচিত্র্যের দেশ। বহু বৈচিত্র্য নিয়ে ঐক্য গড়ে উঠলেই সমাজ শক্তিশালী হয়। অন্যথায় বৈষম্য দানা বাঁধে। বৈষম্যের বিপক্ষে ও বৈচিত্র্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে আমাদের।’ ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরে ‘খুকি লাইফস্টাইল’ নামের একটি শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। ‘রিয়াজউদ্দিন বাজারের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে কিছু লোকের বাধার মুখে উদ্বোধন না করেই ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হন মেহজাবীন। গত ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের টিন মার্কেটে প্রসাধন পণ্য বিক্রির একটি শোরুম উদ্বোধনের কথা ছিল পরীমণির। কিন্তু জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং কালিহাতী শাখার আপত্তির মুখে তারও শোরুম উদ্বোধন করা হয়নি।

১৯৭১ সালে স্বদেশের প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা সহকারে এগিয়ে আসে বাংলার দামাল ছেলেরা। ছাত্র, শ্রমিক, জনতা সবাই মিলে এগিয়ে আসে স্বাধীনতা নামক লালিত স্বপ্ন পূরণের জন্যে। যে যেভাবে পেরেছেন তার জায়গা থেকে অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। লেখক, গায়ক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী যার যার জায়গা থেকে অংশগ্রহণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। সংগ্রাম পরিষদের গায়করা গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনাকে জাগ্রত করেছেন। তেমনি এদেশের চারুশিল্পী সমাজ এগিয়ে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা হিসেবে হাতে রং-তুলির অস্ত্র নিয়ে। শিল্পী হিসেবে যোদ্ধার মতো যারা অনলস পরিশ্রম করেছেন তাঁরা হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, বীরেন সোম, আবুল বারাক আলভী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, চন্দ্রশেখর, মুস্তাফা মনোয়ার -সহ আরো অনেকে। তৎকালীন চারুশিল্পীগণ তাঁদের তুলির সঠিক ব্যবহার করেছিলেন দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে। শুধু মুক্তিযুদ্ধেই নয়, দেশের যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের চারুশিল্পী সমাজ। শুধু সন্তান হিসেবেই নয়, বরং শিল্পী হিসেবে বিবেকের কাছে শিল্পের দায়ে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাঁরা বারবার প্রমাণ করেছেন শিল্পীরা স্বপ্ন দেখায় রুচিশীল সুশীল সমাজের।

‘কৃষক-শ্রমিক- ছাত্র- নেতা,
শিল্পী-সেনা-আমজনতা,
সবাই মিলে একসাথে,
গর্জে ওঠে যুদ্ধের মাঠে,
উদ্দেশ্য একটা – বাংলার স্বাধীনতা।’

সত্তরের দশকের চিত্রশিল্পিরা তাদের তুলির আঁচড়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খানের মসনদ। শিল্পিদের ফেস্টুন, কার্টুন, ব্যানার, পোস্টার, ব্যঙ্গচিত্রগুলো যেন বন্দুক, রাইফেল, গ্রেনেড,কামান, বোমার মতো বিস্ফোরক হয়ে হাজির হয়েছিল পাকিস্তানীদের সামনে। আর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মোহিনী মন্ত্র- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” “তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মোহিত পাগলপারা নির্ভীক বাঙালি জাতি তাদের পিতার আদেশে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্তির লক্ষ্যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আর যারা তাদের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন রং-তুলির আঁচড়ের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

নয়া বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর সরাসরি আক্রমণ নেমে আসছে। ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে ‘একাত্তরের দিনগুলি’-র কথা, ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্বাধীনতা নামক সূর্য সন্তানকে প্রসব করতে কত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদ্ধের, বীরাঙ্গনাদের – দীর্ঘ ৯ মাস সকল গর্ভধারিণী মায়ের মতো। ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া এত সহজ, না কিছুতেই না। বর্বর পাকবাহিনীর ভারি অস্ত্র-সস্ত্র ও গোলাবারুদের বিপরীতে মুক্তি-পাগল দামাল সন্তানরা যেভাবে রণাঙ্গনে মোকাবেলা করেছিল তা অবিস্মরণীয় ও চিরস্মরণীয় দলিল হিসেবে থাকবে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। ফতোয়া দিয়ে, অবরুদ্ধ করে, শিল্প-স্থাপত্য ভাঙচুর করে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে মুছে দিতে পারবে না কেউ, কেউই না।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!