- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
“গঙ্গাসাগর ভারতের সবচেয়ে বড় মেলা, ৪০ লক্ষ পুণ্যার্থী আসবেন”, মেলায় যাতায়াত-নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নিলেন মুখ্যমন্ত্রী
গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে বুধবার নবান্নে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুণ্যার্থীদের সুবিধার্থে অতিরিক্ত ট্রেন-বাস চালানো হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। থাকছে অতিরিক্ত লঞ্চের ব্যবস্থাও। শুধু পরিবহণ নয়, মেলার জন্য় অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। থাকছে এক হাজারেরও বেশি সিসিটিভি। মেলায় গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে থাকছে বিমার সুবিধাও। রাজ্যে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, ইন্দ্রনীল সেন, পার্থ ভৌমিক, সাংসদ স্নেহাশীষ চক্রবর্তী থাকছেন মেলা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে গঙ্গাসাগরে। কলকাতা থেকে মেলার উপর নজরদারি করবেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শশী পাঁজা, ব্রাত্য বসু। মেলায় ভিআইপিদের আসার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। তবে অযথা তাঁরা যাতে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে মেলায় এসে ভিড় না করেন সেই বিষয়টা প্রশাসনকে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রেলের তরফে বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিদের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও ভাবেই মেলার দিনগুলোতে ওই পথে রেল যেন বাতিল করা না হয়।
৮ থেকে ১৭ জানুয়ারি চলবে গঙ্গাসাগরের মেলা। সেই প্রস্তুতি নিয়ে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ১৫ মন্ত্রী। ১৮ দপ্তরের শীর্ষ আধিকারিক। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা প্রশাসনও। এদিন মেলার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “গঙ্গাসাগর ভারতের সবচেয়ে বড় মেলা। অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষের সমাগম হবে। কোনও তীর্থযাত্রীর যাতে কোনও রকম অসুবিধা না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চগীত করতে রাজ্য সরকারের সব দফতর উদ্যোগ নিচ্ছে।” সেখানে আগত দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রতিদিন ১৫-১৬টি অতিরিক্ত বাস চলবে। সবমিলিয়ে ২ হাজার ২৫০টি সরকারি বাস যাতায়াত করবে। চলবে অতিরিক্ত ৬৬টি ট্রেন। থাকছে অতিরিক্ত লঞ্চের ব্যবস্থাও। ২২টি জেটিকে মজবুত করা হচ্ছে। শুধু যাতায়াতের ব্যবস্থা নয়, মেলার নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত সিসিটিভির ব্যবস্থা থাকছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১ হাজার ১৫০টি সিসিটিভি থাকবে মেলা প্রাঙ্গনে। থাকছে জিপিএস ও স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা। ইসরো স্যাটেলাইট ট্র্যাকিঙের কাজ করবে। শুধু যন্ত্রের মাধ্যমে নজরদারি নয়, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মেলায় থাকবে পর্যাপ্ত পুলিশ। ২ হাজার ৪০০ জন সিভিল ডিফেন্সের কর্মী। প্রচুর সিভিক ভলান্টিয়ারও। পাশাপাশি মেলায় গিয়ে দুর্ঘটনায়. কারও মৃত্যু হলে ৫ লক্ষ টাকার বিমার সুবিধাও পাবেন পুণ্যার্থীরা। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রীন করিডোর দিয়ে তাকে যাতে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যায় তার ব্যবস্থাও থাকছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন, সেচ দফতর জানিয়েছে ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি ভাটার টান বেশি থাকবে। তাই রাজ্য সেচ দফতর গত ১ নভেম্বর থেকে গঙ্গাসাগরে ড্রেজিং শুরু করেছে। এই ড্রেজিং চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। হঠাৎ গঙ্গাসাগরে কচুবেড়িয়া সংলগ্ন জায়গায় হঠাৎ একটা চরা জেগে উঠে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। কচুবেরিয়া পয়েন্টে বাংলাদেশের একটা জাহাজ সাত,আট বছর আগে ডুবে গিয়েছিল, তাই চরা তৈরি হয়ে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফারাক্কা কর্তৃপক্ষ থেকে ড্রেজিং করা হয়েছে। গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি বৈঠকে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই কথা জানান সেচ দফতরের আধিকারিকরা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সেনা বাহিনীকে বলে এই জাহাজটাকে তোলার ব্যবস্থা করতে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলা শাসক উলগানাথন যখন ছিলেন তখন তিনি এই জাহাজটা তোলার জন্য অনেক চেষ্টা চালালেও তা হয়ে ওঠেনি বলে জেলা প্রশাসনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে বুধবারের বৈঠকে জানান হয়।
মুখ্যমন্ত্রী নৌবাহিনীর অধিকর্তাদের কাছে বৈঠকে এই বিষয়টি বললে বৈঠকে উপস্থিত নৌবাহিনীর আধিকারিক জানান, এটা ড্রেজিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার কাজ। নৌবাহিনী এই কাজ করে না, তাছাড়া নৌবাহিনীকে বিষয়টি জানান হয়নি। আমরা দুর্ঘটনা হলে উদ্ধারের কাজ করি। আমাদের কাছে ডুবে যাওয়া জাহাজ তোলার মতো দক্ষতা বা সরঞ্জাম নেই।
মুখ্যমন্ত্রী এর পর বলেন, “ড্রেজিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াকে বিষয়টি জানিয়ে গঙ্গাসাগর মেলার পর ওই বাংলাদেশি ডুবে জাওয়া জাহাজটিকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। জাহাজটা বাংলাদেশি, তাছাড়া জাহাজ কেম্পানির এই বিষয়ে দায়িত্ব থাকা উচিত। ২০১৩ সালে ওই জাহাটা ডুবে গিয়েছে, তারপর থেকে চর সৃষ্টি হল কেউ দেখল না? এতদিন ধরে জাহাজ যাতায়াত করছে কেউ দেখল না ?” এই সময় জেলা প্রশাসনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হয়, এই বছরই চর পড়েছে। তাই বিষয়টি নজরে এসেছে। ৫ জানুয়ারির মধ্যে আমরা ড্রেজিং করে চরটা কমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।
মুখ্যমন্ত্রী কচুবেরিয়ায় বাংলাদেশি জাহাজ ডুবে থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে তাঁকে নৌসেনার তরফে জানান হয় যদি এই ডুবে যাওয়া জাহাজ আমাদের জলপথে যদি বাধা না হয় তাহলে আমরা সেটাকে সরানোর কথা ভাবি না।
গত বছর ফগলাইট না থাকায় প্রচুর ট্রলার আটকে গিয়েছিল। তাই এবার আরও বেশি সংখ্যক ফগলাইট কেনা হয়েছে বলে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা প্রশাসনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে বৈঠকে জানান হয়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “৩০০ বেডের একটি হাসপাতাল থাকছে গঙ্গাসাগরে। সঙ্গে জরুরি বিভাগ, ১০০-র বেশি অ্যাম্বুল্যান্স, এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স, ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স থাকছে।”
মুখ্যমন্ত্রী অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। দমকল দফতরের আধিকারিক বলেন, “আমরা প্রস্তুত। ৫০টি বাইক নিয়ে মেলায় দমকল কর্মীরা টহল দেবেন। ৮টি অস্থায়ী দমকল কেন্দ্র পুরো মেলা ময়দান জুড়ে করা হয়েছে। মোট ১৩টি দমকল কেন্দ্র থাকছে। ২ তারিখ আবার পর্যবেক্ষণ হবে, দমকলের ডিজি, দমকল মন্ত্রী থাকছেন।”
এদিকে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হয় যে সব তীর্থযাত্রী গঙ্গাসাগর মেলায় আসেন তারা কলকাতার কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে ঘুরতে যান। তাদের জন্য আউট্রাম ঘাটে ট্যাক্সি থাকে। তবে ট্যাক্সিওয়ালারা ২০০/৩০০ টাকা ভাড়ার বদলে ১০০০ টাকা চাইছে। এটা একটু দেখা দরকার। দরকারে বাসের ব্যবস্থা করা দরকার। তাছারা কালীঘাটে আরও সিসিটিভি থাকা দরকার, তীর্থযাত্রীদের পকেটমার হয়ে যায়। আমরা চাই সারা ভারত দেখুক, যারা মেলায় আসেন তারা বলুন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেমন ভাবে গঙ্গাসাগর মেলাকে একটা উচ্চতায় তুলে এনেছেন।
মুযমন্ত্রী সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর বলেন, “৮ তারিখ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে। ১৫ জানুয়ারি মকড় সংক্রান্তি। আমি এই সমন্বয় বৈঠকটা প্রতি বছর করি। ভারত সেবাশ্রমের প্রতিনিধি, মুখ্যসচিব, স্বরদষ্ট্র সচিব এবং আরও অন্যান্য দফতর, দফতরের মন্ত্রীরা আছেন। ৪০ লক্ষ মানুষ আসেন গঙ্গাসাগর মেলায়। ভারতের সবচেয়ে বড় মেলা। কোনও ট্রেন যেন এই সময় বাতিল না হয়। বিকেলে মেলায় জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা থাকছে ইসরোর সহায়তায়। গাড়ির গতি হ্রাসের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার তীর্থ কর নেয় না। ৮ নম্বর লট থেকে কচুবেরিয়ার মধ্যে যাতে যাতায়াত যাতে ভালোভাবে হয় তার জন্য ড্রেজিং ভালোা করে করা হবে। ভিড় এড়াতে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৯ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের জন্য ৫ লক্ষ টাকার বিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে রাজ্য সরকারের ইদ্যগে। বিশেষ টয়লেট থাকছে। সাগরের তির ব্যবস্থাপনার জন্য পুরুষ ও মহিলা স্বেচ্ছাসেবক থাকছে। শুধু মেলার জন্য ৩০০ বেডের হাসপাতাল, আইসিইউ, ১০০টি অ্যাম্বুল্যান্স, এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স, ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স থাকছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি থাকবে না। এবার মন্দিরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, বঙ্কিম হাজরা, ইন্দ্রনীল সেন,পার্থ ভৌমিক, স্নেহাশিস চক্রবর্তী থাকবেন। লট ৮ এ থাকবেন ফিরহাদ হাকিম। থাকছেন জ্ঞানবন্ত সিং। কলকাতা পুলিশের তরফে বিনিত গোয়েল কলকাতা থেকে বেহালা পর্যন্ত নজরদারি চালাবেন তাঁর বাহিনী নিয়ে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রিন করিডোর করে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হবে। বাংলা,ইংরেজি,মারাঠি সহ সব ভাষায় নিরাপত্তাজনিত ঘোষণা ও পথ নির্দেশ থাকবে। মেলাকে বর্ণময় আলোকমালায় সাজিয়ে তোলা হবে। ৬০ লক্ষ জলের পাউচ থাকছে। ৭টি ওয়াইফাই জোন থাকছে। জরুরি ব্যবস্থার জন্য হ্যাম রেডিও, স্যাটেলাইট যোগাযোগ থাকবে। কপিল মুণির আশ্রম দেখার জন্য লাইভ স্ট্রিমিং ই-দর্শনের ব্যবস্থা থাকছে। পূণ্যার্থীদের নিরাপত্তা ভালোভাবে দিতে হবে। তারাহুরো করার দরকার নেই। যাতায়াত শান্তভাবেই করতে হবে। আগে মানুষ বলতেন সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার। এখন গঙ্গাসাগার বারবার। সব দফতরের সহায়তায় সার্বিকভাবে মেলাটাকে পরিচালনা করতে হবে। কলকাতা থেকে মেলা পর্যালোচনা করবেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ব্রাত্য বসু, শশী পাঁজা। যেখানে ভিড় বেশি হয় সেখানে এলইডি লাগাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতা থেকে ট্রাফিকের পদস্থ আধিকারিকদের থাকতে হবে। কচুবেরিয়াশ বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। স্নান করেই কচুবেরিয়ায় সবাই চলে আসতে চায়। তাই সমস্যা হয়। মেলায় কোনও তাবুতে রান্না করা যাবে না। শোলার তাবুতে কোনও ভাবে যেন আগুন না ধরে যায় সেই বিষয়টি দমকল কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে। ভিড়ে ভিআইপিদের আস্তে নিষেধ করছি না তবে তাঁরা পাইলট নিয়ে যেন সমস্যা না করে সেটা দেখতে হবে।”
কচুবেরিয়া থেকে সাগরে এই বছর বাড়তি ২০০ বাস ওপারে থাকবে। অ্যান্টিফগ লাইট লাগানো হয়েছে সবত্র। বাফার জোন থাকছে।
তৃণমূল বিধায়ক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা বলেন, “কচুবেরিয়ায় কিছু জামা-কাপড় বিলি করা গেলে ভালো হয়, অনেকের জামা-কাপড় হারিয়ে যায়।”
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনও জামা-কাপড় বিলির ব্যবস্থা হবে না। এটা করলে মানুষ পদপিষ্ট হয়ে যাবে, এটা চাই না।”
রেল, বন্দর, বিএসএনএল, দমকল, এসডিআরএফ, বিপর্যয় মোকাবিলা, মুখ্যসচিব, বরাষ্ট্র সচিব, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, ইন্দ্রনীল সেন, সুজিত বসু, পার্থ ভৌমিক সহ রাজ্য সরকারের বেশিরভাগ দফতরের মন্ত্রী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এই সমন্বয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী এদিনের বৈঠকে গঙ্গাসাগর মেলার সব দিক সম্পর্কে এই বৈঠকে খোঁজখবর নেন। তিনি নিজেও প্রতিবারের মতো মেলায় আগেই যাবেন বলেও জানিয়ে দেন।
❤ Support Us