Advertisement
  • এই মুহূর্তে বি। দে । শ
  • মার্চ ১৭, ২০২৫

হোলবার্গ পুরষ্কার পেলেন বাঙালি চিন্তাবিদ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
হোলবার্গ পুরষ্কার পেলেন বাঙালি চিন্তাবিদ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

ভারতীয়-আমেরিকান চিন্তাবিদ, অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে ২০২৫ সালের হোলবার্গ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছ। এটি বিশ্বব্যাপী গবেষণার জগতে অন্যতম শ্রেষ্ট পুরস্কার বলে বিবেচিত হয়। স্পিভাকের পোস্টকোলোনিয়াল স্টাডিজ আর তুলনামূলক সাহিত্যে ঐতিহাসিক অবদানের জন্য এই সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে।

বাঙালি চিন্তাবিদ, অধ্যাপক, সাহিত্য তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে ২০২৫ সালের হোলবার্গ পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। তাঁর তুলনামূলক সাহিত্য , অনুবাদ, পোস্টকোলোনিয়াল স্টাডিজ, নিম্নবর্গের ইতিহাস, রাজনৈতিক দার্শনিকতা আর নারীবাদী তত্ত্বে অগ্রণী আন্তঃবিষয়ক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এই সম্মাননা। এই পুরস্কারটি নরওয়েজিয়ান সরকার ও বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে দিয়ে থাকে। প্রতি বছর মানবিকতা, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন বা ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে এক জন করে ব্যক্তিকে নরওয়ের মন্ত্রিপরিষদের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের পক্ষ থেকে এই পুরষ্কার প্রদান করা হয়। গত ১৩ মার্চ গায়ত্রীর নাম ঘোষণা করলেও আগামী ৫ জুন নরওয়ের বেরজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ওই পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দেবেন সে দেশের যুবরাজ হাকোন। পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫৪০,০০০ মার্কিন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা।পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান হাইকি ক্রিগার বলেছেন, ‘সমালোচনামূলক ব্যাখ্যার জন্য পাশ্চাত্য চিন্তার মূল ভাবনাকে গ্রহণ করেছেন স্পিভাক। কিন্তু তাঁর সমালোচনার ভিতরে রয়েছে ক্রমাগত প্রশ্ন করার অভ্যাস। আধুনিক বিশ্বের ভাবনার মূল কেন্দ্র ও প্রান্তসীমা, দু’টিকেই সমান ভাবে স্পর্শ করেছেন তিনি।’ আরো বেলছেন, একজন জনসাধারণের চিন্তাবিদ ও আন্দোলনকারী হিসেবে স্পিভাক বঞ্চিত গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সাক্ষরতার উন্নতি ঘটাতে কাজ করছেন।’ কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘স্পিভাক বিশ্বাস করেন যে, কঠোর সৃজনশীলতা স্থানীয় উদ্যোগগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদের বিকল্পগুলি উপস্থাপন করে। তাঁর কাজ পাঠকদের, শিক্ষার্থীদের এবং গবেষকদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির একটি গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে ‘কল্পনার প্রশিক্ষণ’ করতে চ্যালেঞ্জ জানায়।’ গায়ত্রীর নিজের কথায়, ‘শুধু মাত্র বিপুল পরিমাণ তথ্য আর জ্ঞান সঞ্চয় করা কখনো কোনো সুসংহত ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্ম দিতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার অভ্যাস।’ নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকে শুধুমাত্র থিয়োরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি গায়ত্রী।

১৯৪৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর পরবর্তীতে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি ইংরেজিতে এমএ এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি করেন। বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববিদ্যার অধ্যাপক। তাঁর দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে, স্পিভাক আধুনিক সময়ে একজন প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। পোস্ট-হেগেলীয় দর্শন ও সাব- অল্টার্ন–ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত সমাজের গোষ্ঠীগুলির অধ্যয়নে তাঁর বিশেষজ্ঞতার জন্য তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত। তাঁর প্রখ্যাত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাব-অল্টার্ন স্পিক?’ পোস্টকোলোনিয়াল সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের একটি মাইলফলক। এই প্রবন্ধে তিনি পশ্চিমী গবেষণার পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে, বিশ্বের সংখ্যালঘু জনগণের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম আর তাদের কণ্ঠস্বরের উপেক্ষাকে প্রকাশ করেন। এই লেখাটি তার তত্ত্বগত কাজের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, প্রান্তিক জনগণের নিজেদের কথা বলার ক্ষমতা কি সত্যিই অস্তিত্বশীল, বা তারা একটি উপনিবেশী ও বর্ণবৈষম্যমূলক কাঠামোর মধ্যে নিষ্প্রভ এবং নীরব রয়ে গেছে। এই প্রবন্ধে তিনি পশ্চিমা দার্শনিক ও তাত্ত্বিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন এবং দেখান, কীভাবে উপনিবেশ-পরবর্তী বিশ্বে নিম্নবর্গের মানুষেরা বিশেষত নারীরা তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর হারায়। এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি সতীদাহ প্রথার প্রসঙ্গ টেনে আনেন, বোঝান, কীভাবে ভারতীয় সমাজে মেয়েদের নিজেদের স্বর ও শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র সাহিত্য বা দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, সমাজবিজ্ঞান ও নারীবাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রেও গভীর আলোড়ন তোলে।

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য, নারীবাদ, বিশ্বায়ন, পলিটিক্যাল থিয়োরি ও ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল থিয়োরি নিয়ে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সারা জীবনের গবেষণা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। যদিও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯, কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লিখিত অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তাঁর রচিত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল– ‘ইন আদার ওয়ার্ল্ডস-এসেস ইন কালচারাল পল্যিটিক্স’, ‘আ ক্রিটিক অফ পোস্টকলোনিয়াল রিজন : টু ওয়ার্ডস আ হিস্টরি অফ দ্য ভ্যানিশিং প্রেসেন্ট’ আর ‘ডেথ অফ আ ডিসিপ্লিন।’ তাঁর চিন্তা ও বিশ্লেষণ সারা পৃথিবীর অন্তত ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তুলনামূলক সাহিত্য, অনুবাদ তত্ত্ব, পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ, পলিটিক্যাল ফিলোসফি এবং ফেমিনিস্ট থিয়োরি নিয়ে তাঁর প্রভাব আজও বহুল আলোচিত। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের কাজের মধ্যে তিনি পশ্চিমী দার্শনিক এবং সাহিত্য তত্ত্বের মধ্যে ভারতীয় দর্শন, ভাষা এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করেছেন। তাঁর গবেষণা পদ্ধতি একদিকে যেমন পশ্চিমী দার্শনিক চিন্তাধারাকে সমালোচনা করেছে, অন্যদিকে তেমনি দক্ষিণ এশীয় এবং গ্লোবাল সাউথের দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং উপনিবেশিত জনগণের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তৈরি করেছে।

স্পিভাকের তত্ত্বমূলক অবদান সমাজবিজ্ঞানে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে, শুধু তাত্ত্বিক স্তরে নয়, বাস্তব পৃথিবীতেও প্রভাব ফেলেছে। একাডেমিক গবেষণার বাইরেও তিনি গভীরভাবে সামাজিক আন্দোলনে নিযুক্ত। বঞ্চিত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা ও সাক্ষরতার প্রকল্প স্থাপন, অর্থায়ন আর তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত এবং অন্যান্য দেশে। স্পিভাকের বিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোগের সমন্বয় সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদের বিকল্প এভাবেই তৈরি হতে পারে। তাঁর ‘স্ট্র্যাটেজিক এসেনশিয়ালিজম’ ও ‘গ্লোবাল ক্রিটিক্যালিটি’র ধারণাগুলি বিশ্বব্যাপী আলোচিত, গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এই ধারণাগুলির মাধ্যমে, স্পিভাক পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার এবং বৈশ্বিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর কাজ আজও পাঠক, শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের ‘কল্পনাকে প্রশিক্ষিত’ করতে অনুপ্রাণিত করে । সাহিত্যের দীর্ঘস্থায়ী অধ্যয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আধুনিকতার কেন্দ্রে ও প্রান্তে নতুন চিন্তাধারার সূচনা করেছে। অনুবাদ ক্ষেত্রে, জার্মান দার্শনিক জঁ দেরিদার ‘অফ গ্রামাটোলজ্যি’ গ্রন্থটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বকে তিনি ইংরেজিভাষী বিশ্বের কাছে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৯১ সাল থেকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। যদিও ২০০৭ সালে তিনি প্রফেসর হিসেবে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ততদিনে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে চিন্তাবিদ ও গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। অধ্যাপকের পুরস্কার প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বসিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরফ্যাকাল্টি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন অ্যামি হাঙ্গারফোর্ড বলেন, ‘প্রফেসর স্পিভাকের এই স্বীকৃতি আমাদের গর্বিত করেছে। সাহিত্য, সমাজ, দর্শন এবং শিক্ষাকে বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আগামী বহু প্রজন্ম স্মরণে রাখবে।’ এর আগে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর সম্মাননার তালিকায় রয়েছে– ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মভূষণ, কিয়োটো আন্তর্জাতিক পুরস্কার অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ১৫টি সাম্মানিক ডক্টরেট লাভ করেছেন।গায়ত্রী স্পিভাকের পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!