- এই মুহূর্তে ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
- অক্টোবর ১৭, ২০২৫
মুঠোফোনে মঞ্চ ! ৩০০-এর বেশি বাংলা নাটক নিয়ে হাজির দেশের প্রথম ওটিটি থিয়েটার

‘ব্রহ্মার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চতুর্মাথার দিকে তর্জনি নাচিয়ে সে বলল, এমন এক নির্মাণ আমি করেছি, এমন বিশ্ব যা আপনিও করতে পারেনি। এ এক অন্য জগৎ আর তার কারিগর আমি’— বিশ্বকাঁপানো নাটক ‘টিনের তলোয়ার’ প্রসঙ্গে নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র, যে নিজে অভিনেতা ও পরিচালক বেণীমাধব চাটুজ্যে ওরফে কাপ্তেনবাবু বলেছিলেন, এ কথা থিয়েটারের মঞ্চ প্রসঙ্গে। এই সংলাপ এক সাক্ষাৎকারে আমাদের শুনিয়েছিলেন নির্মাতা উৎপল দত্ত। অর্থাৎ মঞ্চ যে দৃশ্যকল্প নির্মাণ করে, যে চরিত্র নির্মাণ করে তা পৃথিবী কোন ছাড়, ব্রহ্মাণ্ডর অনিন্দ-রহস্যকেও ছাপিয়ে যায়।
যুগ বদলালেও, বাঙালির সংস্কৃতি থেকে বই, গান, সিনেমা আর থিয়েটারকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেওয়া মুশকিল। কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় মঞ্চনাটক দেখা বহু বাঙালির কাছেই যেন স্মৃতির অলিন্দে আটকে পড়া ধুলোমাখা অভ্যাস। তাই সে সংস্কৃতি এবার ফিরছে নতুন মোড়কে। গ্রুপ থিয়েটারের বহু প্রশংসিত নাটক এবার দেখা যাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। শুরু হচ্ছে দেশের প্রথম থিয়েটার ওটিটি ‘ওয়ান থিয়েটার’-এ। বাংলার সংস্কৃতিতে থিয়েটারের যে এক গর্বিত ঐতিহ্য রয়েছে, তারই আধুনিক রূপায়ণ ঘটাতে চলেছে এই নতুন উদ্যোগ। এককথায়, থিয়েটার এবার আর শুধু মঞ্চে নয়, সরাসরি পৌঁছে যাবে দর্শকের ঘরে, হাতে থাকা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে।
১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে থিয়েটারের বিশেষ এই স্ট্রিমিং। প্রথম ধাপে থাকছে ৩০০-রও বেশি বাংলা নাটক। পৌলমী চট্টোপাধ্যায়, গৌতম হালদার, সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের নাট্যপ্রযোজনা থাকছে, অভিনয়ে দেখা যাবে শঙ্কর চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদার, রজতাভ দত্ত, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত-সহ বাংলা মঞ্চ ও রুপোলি পর্দার একঝাঁক পরিচিত মুখকে। পাশাপাশি থাকছে প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত নাটকের একটি আলাদা আর্কাইভ, যা এই অ্যাপের অন্যতম আকর্ষণ। অ্যাপ নির্মাতারা জানাচ্ছেন, ইউটিউবে সামান্য কিছু নাটক দেখবার সুযোগ থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা থিয়েটারের নানা দুর্লভ প্রযোজনার কোনো সুষ্ঠু ডিজিটাল সংরক্ষণ ছিল না। ছিল না কোনো প্রামাণ্য আর্কাইভ। সে অভাব অনেকটাই মেটাতে চলেছে ‘ওয়ান থিয়েটার’। জিটিপিএল-কেসিবিপিএল গ্রুপের সহযোগিতায় তৈরি এই প্ল্যাটফর্ম বাংলা গ্রুপ থিয়েটারকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। তাদের কথায়, কলকাতা থেকে জেলার অলিগলি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নাট্যদলের সৃজনশীলতাকে একত্রে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের এই প্রয়াস দেশের মধ্যে প্রথম।
‘ওয়ান থিয়েটার’-এ থাকছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ভিন্ন স্বাদের ও গন্ধের নাটক। যেমন ‘টাইপিস্ট’ নামের একটি নাটক, যা পরিচালনা করেছেন পৌলমী চট্টোপাধ্যায় এবং প্রযোজনায় রয়েছে শ্যামবাজার মুখোমুখি। চাকরির অনিশ্চয়তা, জীবনের ছোট ছোট স্বপ্ন আর আবেগের দোলাচলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই নাটকের কাহিনি। এই নাটকে অভিনয় করেছেন দেবশঙ্কর হালদার এবং পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। একই রকম মননশীল একটি নাটক ‘মনে জঙ্গলে’। কল্পায়ু-র প্রযোজনায় এবং জ্যোতিস্মান চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় তৈরি এই নাটক মূলত মনের জগৎ ও স্মৃতি-বিস্মৃতির প্রক্রিয়াকে ঘিরে। এক অর্থে এটি মানব মস্তিষ্কের স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণ ও আবেগের পারস্পরিক টানাপোড়েনের কাহিনি। অভিনয়ে রয়েছেন রজতাভ দত্ত, শঙ্কর চক্রবর্তী, দেবলীনা দত্ত, অনিন্দিতা ব্যানার্জি, প্রীথা মজুমদার, জ্যোতিস্মান চট্টোপাধ্যায়-সহ একঝাঁক দক্ষ শিল্পী। অন্য আরেকটি নাটক, ‘মিতালী’ নাটকটি পরিচালনা করেছেন গৌতম হালদার। এটি একটি কিশোর প্রেমের গল্প, যেখানে থাকছে নস্টালজিয়া, কৈশোরের সরল আবেগ এবং চিঠির আদানপ্রদানে গড়ে ওঠা এক অনাবিল প্রেম। বিশ্বখ্যাত লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির একটি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকটি লেখা। অভিনয়ে রয়েছেন গৌতম হালদার, দ্যুতি ঘোষ হালদার প্রমূখ।
আয়োজকরা আশাবাদী, এই অ্যাপ যেমন দর্শকদের অতীত থিয়েটরের সঙ্গে যুক্ত করবে, তেমনই নতুন প্রজন্মের সামনে মঞ্চনাটককে তুলে ধরবে এক নতুন আঙ্গিকে। থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা আছে অথচ সময় বা সুযোগের অভাবে হলে গিয়ে নাটক দেখা হয় না, এমন দর্শকদের জন্য ‘ওয়ান থিয়েটার’ এক আশীর্বাদ বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে অনেকে আবার বলছেন, যে অভিজ্ঞতা অন্ধকার হয়ে আসা হলঘরে, আবহ সংগীত আর আলো-আঁধারির ‘অলৌকিক’ দুনিয়ায় প্রবেশমাত্র পাওয়া যায় তা ফোনের স্ক্রিনে পাওয়া সম্ভব নয়। সেসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। তবে এই মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় থিয়েটার এখন বিশ্বজনীন। ইউরোপের বহু নামজাদা নাটক ওটিটিতে দেখানো হচ্ছে। এ এক উন্মুক্ত মঞ্চ, বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে আগ্রহী দর্শক পেতে পারেন তার আস্বাদ। যা এতদিন সম্ভব ছিল না। বাংলা থিয়েটারও সে পথেরই পথিক। ঘর ছেড়ে যেন ঘরেই ফিরছে সে। আর এই ‘ফেরা’ অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং এক নতুন অভিজ্ঞতা নির্মাণের প্রচেষ্টা। ‘ওয়ান থিয়েটার’ সেই প্রচেষ্টারই প্রথম ধাপ।
❤ Support Us