- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩
উৎসবের মেজাজে লেখক-পাঠকের অমূল্য সমাবেশ। উপচে পড়া জনস্রোতের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, বাংলা যতদিন, আন্তর্জাতিক বইমেলা ততদিন

চিত্র প্ততিবেদক
আজ চতুর্থ দিন। স্বতঃস্ফূর্ত মেজাজে উদ্ভাসিত কলকাতা বইমেলা। ৭০০ প্রকাশনা আর ২০০ লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে উপচে পড়ল ভিড়। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে নবীন-প্রবীনের আড্ডা। গানে-গানে ভাসল বিদায়মুখী শীত। দুপুর থেকে বইকেনার তাড়াহুড়ো। বিকেলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ চৌহদ্দি, পা রাখার ঠাঁই নেই। হঠাৎ বিদ্যুতের দিকবদলে নেমে এল লোডশেডিং। স্থায়িত্ব ১২০ সেকেণ্ডের। তারপরেই আবার কোলাহল, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! তখন উপরে কুয়াশাহীন চাঁদের শামিয়ানা, নীচে বইয়ের অবারিত আহ্বান। মুহুর্তে স্মরণে ফিরে এলেন কবি শহীদ কাদরী, অভিবাদন প্রিয়তমা।
জনস্রোত ক্রমশ রেকর্ড ভাঙছে। ধেয়ে আসবে এরকম ভিড়, সম্ভবত ভাবতে পারেননি অনেকেই। মেলার সৃষ্টিপাত আর দৃষ্টিনিক্ষেপ দেখে অভিভূত গিল্ডের যোদ্ধারা। ব্যস্ততা তাঁদের তুঙ্গে। প্রত্যাশিত উচ্ছ্বাস আর বইকেনার উৎসাহ। তার মানে, প্রজন্ম বইবিমুখ নয়। মধ্যবয়সী আর প্রবীণরাও পড়ার অভ্যাস ছাড়তে বিলকুল রাজি নন, বই তাঁদের টানছে, তাঁরাও বইকে জড়িয়ে জেগে থাকতে চাইছেন। দুই মলাটের মধ্যে কাছে পেতে চান দূর নিকটের জ্ঞানবিশ্বকে।বই এর সঙ্গ উদযাপনের মুহুর্মূহু মুহুর্তকে লেন্সবন্দি করতে ছুটছেন আলোকচিত্রীরা। এও আরেক দৃষ্টান্তযোগ্য সুন্দর স্রোত।
বেশ কিছু স্টলে দেখা গেল, ছাত্র ও যুবারা বেসামাল ভিড়ে একাকার। অপ্রতিরোধ্য স্রোত বইছে।পুস্তক বিপণির ভিতরে আর বাইরে।লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের এখানে ওখানে যেন হাসছেন দিলখোলা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নামে অঙ্কিত সরণিতে স্টলের আয়তন কুল্লে ৫০ স্কোয়ার ফুট। তবু উৎসাহ অম্লান।সরণির এপাশ ওপাশ জুড়ে একাধিক নতুন সংস্থা তাদের বর্ণময় প্রকাশনার রত্ন সাজিয়ে হাজির। প্রতিটি স্টলই ৯ নম্বর গেটের কাছে। মেলার মূল প্রাঙ্গনের এক স্টল থেকে আরেক স্টলে বই খুঁজতে ব্যস্ত ১৮ থেকে ৪০, ৪০ থেকে ৬০ পেরিয়ে আরও বহু বয়সজয়ী। এবারের পুস্তক মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন জেলার খ্যাত, স্বল্পখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার উপস্থিতি। দ্বিতীয়ত, লিটল ম্যাগের বাড়ন্ত অংশগ্রহণও নজরে পড়ল। লিটল ম্যাগ নিয়ে এরকম সৃজনশীল উন্মাদনা আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি !

চিত্র প্রতিবেদক
মেলার থিম যেহেতু স্পেন, সেকারণে মুর প্রভাবিত স্পেন ও বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির মেলবন্ধনের আকাঙ্ক্ষা ৪৬ তম পুস্তক মেলার আরেক সুষ্পষ্ট। স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে ঘুরছেন স্পেনের লেখক ও প্রকাশকরা । তাঁদের অনেকেরই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে দেখা গেল দুই নিকটাত্মীয় দেশের পাঠক আর বিজ্ঞজনকে। এখানেও ভিড়। জমে উঠল স্প্যানিশ সাহিত্য পাঠের আসর আর স্পেন-ভারতীয় লেখকদের আলাপচারিতা। ষাঁড়ের লড়াই-এর জন্য খ্যাত যে দেশ, ষাঁড় লড়াই দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন কালজয়ী চিত্রকর সুনীল দাস, আজ তাঁরই জন্ম শহরে এসে উপস্থিত মাদ্রিদের বইভাণ্ডার। বইমেলার সুপরিকল্পিত এ আয়োজনকে ইতিহাস মনে রাখবে। শুধু স্পেন নয়, – জাপান, আমেরিকা, বাংলাদেশ, ইতালি, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া এবং কিউবা সহ ১৮ টি দেশ তাদের বৌদ্ধিক সম্ভার নিয়ে হাজির মেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন ছিমছাম, এবং ভিড়ঠাসা। বরাবর এরকম হয়ে থাকে, একই ছাদের নীচে স্টলের গায়ে স্টল। ঢাকার নামী দামি সব প্রকাশক যোগ দিয়েছেন, এপার বাংলার পাঠক ছুটছে ওপার বাংলার বইয়ের পিছনে। এও আরেক চমৎকার ক্রেজ। সীমান্ত নস্যাৎ করে দুই বাংলার চিরায়ত ভাবাবেগ আলিঙ্গন করছে একে অন্যকে। রাশিয়ার স্টলে পাঠকদের স্বাভাবিক ভিড়, ভিড়কে ভেদ করে বেরিয়ে আসছে মর্মরিত প্রশ্ন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে কবে ?
৯ নম্বর গেটের সামনেই মৃণাল সেন মুক্ত মঞ্চ। বিশ্বজয়ী পরিচালকের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে গিল্ডের প্রত্যাশিত শ্রদ্ধা নিবেদন। প্রতিদিন এখানে পদাতিক- এর স্রষ্টার পদচারণে বিরাজ করছে তাঁর দাঢ্য উপস্থিতি। পাঠকের আড্ডা, লেখকদের আলাপচারিতা , তীক্ষ্ণ বাক বিনিময় মিলিয়ে এই সভামঞ্চ অন্যরকম অভিব্যক্তির স্বাধীন মজলিশ হয়ে উঠেছে। এখানেই আগামী সোমবার ‘আরম্ভ’ পাবলিশার্সের নতুন ৬ বইয়ের মোড়ক খুলবেন তপোধীর ভট্টাচার্য, প্রচেত গুপ্ত, অমিতাভ গুপ্ত, মইনুল হাসান, রণবীর পুরকায়স্থ এবং হেদায়েতুল্লাহ। ৬ কবি-লেখক — গোলাম রসুল, বিশ্বজিৎ দে, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অমিত মুখোপাধ্যায়, তৃপ্তি শেঠ, দেবপ্রিয় চক্রবর্তীর বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে আসাম-বাংলার ৬ প্রাজ্ঞ। এও আরেক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
মেলার ক্রমবর্ধমান ভিড়ে আগামীর ইঙ্গিত স্পষ্ট। বাংলা যতদিন, আন্তর্জাতিক বইমেলা ততদিন, এর কোনো বিরাম নেই, নেই অর্ধচ্ছেদ কিংবা নগণ্য বিরতিচিহ্ন। দ্বিতীয়ত, জনসমাগম আর বই বিক্রির ঝোড়ো প্রবণতা আগের সব রেকর্ডকে তছনছ করে নতুন রেকর্ড গড়বে এবারের বইমেলা। যে কোনো ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে পুস্তক মেলার সমাবেশ আর স্থায়িত্ব অনেকানেক বেশি এবং শানিত এবং মুক্তচিন্তার নিরন্তর সঙ্গী। ১২ দিনের নয়, মননের ১২ মাসের নিত্য সহচর।
❤ Support Us