- এই মুহূর্তে দে । শ
- জুলাই ৪, ২০২৩
বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তি জারি করে অবশেষে পিছু হটল লোরেটো। বঙ্গবাসীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা কলেজের
চাপের মুখে পরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হল লোরেটো। বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্তৃপক্ষ জানাল, তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারে যে যোগ্যতামান নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ইচ্ছা করে দেওয়া হয়নি। একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সমগ্র বাংলার মানুষের কাছেই তারা ক্ষমাপ্রার্থী। যে শর্ত স্থির করা হয়েছিল তাও তুলে নেওয়া হল। বাংলা বা যে কোনো মাধ্যমের পড়ুয়ারাই এবার থেকে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। জানালেন অধ্যক্ষ।
স্নাতকের পড়াশোনায় কেবলমাত্র ইংরাজি মিডিয়াম পড়ুয়ারাই স্বাগত। অন্য মাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ। দিন কয়েক আগে লোরেটো কলেজের এমন ফতোয়াকে ঘিরে রাজ্যের শিক্ষা মহলে শুরু হয়েছিল ব্যাপক শোরগোল। সামাজিক মাধ্যমে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে শতাব্দী প্রাচীন কলেজের সাম্প্রতিক ভর্তির বিজ্ঞপ্তি। যেখানে বলা হয়, তাদের প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাতেই পড়াশোনা করা হয়। তাই কথাবার্তা, অনুভূতি প্রকাশ, ভাইভা, আদব-কায়দায় ইংরেজির ছাপ থাকা দরকার। পঠন-পাঠন আর পরীক্ষাও দিতে হয় ইংরেজিতেই। তাই দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যে সব ছাত্রীরা বাংলা বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশোনা করেছে, তাঁরা এই কলেজে ভর্তির জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন না। তাদের পরামর্শ তারা যেন অন্য কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। যা নিয়ে নেট নাগরিকদের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন ভাষা কী করে ভর্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতার মানদণ্ড হতে পারে? পক্ষে ও বিপক্ষে এ নিয়ে একাধিক মত উঠে আসে।
বিষয়টি সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে রাজ্যের শিক্ষামহল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ক্রিস্টিন কুটিনহোকে বলা হয়, ভর্তি বিধিতে বৈষম্য বিধিসম্মত নয়। মঙ্গলবার তাঁকে ডেকে পাঠান হয়। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বিজ্ঞপ্তি বাতিল করার পক্ষ মত দেন । অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের ‘সংখ্যালঘু’ তকমা আছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী, এমন পদক্ষেপ তাঁরা নিতেই পারে। যদিও শহরের অন্য দুই অন্য দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট জেভিয়ার্স ও স্কটিশ চার্চ কলেজ কিন্তু এ পথের পথিক নয়। সব ভাষায় পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীদেরই তারা কলেজে স্বাগত জানাতে চান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কলেজ কর্তৃপক্ষর ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তাই এ ধরনের বৈষম্যমূলক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যেন আগামী দিনে যেন ভর্তি না হয়। বলা দরকার, পুরনো রীতিতে ইতিমধ্যে ভর্তি শুরু হয়ে গেছে। মেধা তালিকাও প্রকাশ হয়েছে।
নিজেদের অবস্থানের পক্ষে লোরেটো কর্তৃপক্ষের সাফাই, শতাব্দী প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। কলেজ ইংরেজি মাধ্যম হওয়ায় বাংলা বা অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় পড়াশোনা করে আসা ছাত্রীরা ইংরেজি পড়ানো হলে তা বুঝতে পারছে না। লিখতেও পারছে না পরীক্ষায় সঠিক ভাবে । অনেক শিক্ষক ফিডব্যাকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের কাছে এমন সব ছাত্রীরা আসছে যারা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে বহুদিন ধরেই খবর পাচ্ছিলেন তারা। তাই চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হন তাঁরা।
কর্তৃপক্ষর অবস্থান প্রশ্নাতীত নয়। চলতি বছরে কেন কলেজে বাংলা ও হিন্দিকে মাইনর সাবজেক্ট করা হয়নি তার উত্তর তাঁরা দেননি। আসলে, সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার ছাপ বড্ড বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। মেকলে শিক্ষানীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ভারতীয় শিক্ষার ব্যবস্থাকে খোলনোলচে পালটে দেওয়ার দাবি বহুদিনে। সম্প্রতি নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে তা সাহেবিয়ানা থেকে ভারতীয় শিক্ষাকে মুক্ত করতে পারবে কিনা সে নিয়ে সংশয় রয়েছে। একটা কথা সকলের বোঝা দরকার, ইংরাজির প্রয়োজনীয়তা বর্তমান সমাজে কেউ অস্বীকার করছে না। তবে, নিজের স্বকীয়তা, ভাষিক স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিয়ে অন্য কোনো ভাষাকে রপ্ত করতে হলে মানুষ তাঁর আত্মপরিচিতি হারায়, হারায় তাঁর সুদীর্ঘ লালিত হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। বাংলার সঙ্গে ইংরাজীর কোনো বিরোধ নেই , বিরোধ থাকতে পারে না। ভাষা তাঁর আপন স্রোতে এগিয়ে চলে চলার পথে নতুন শব্দ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ হয় সে। সমন্বয়ের ভাবনা যদি থাকে, তাহলে এমন ফতোয়া জারির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন হয় না। লোরেটো কর্তৃপক্ষ যদি তা বুঝতেন অনাবশ্যক বিতর্ককে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সে বিচক্ষণতা দেখাতে ব্যর্থ হলেন শতাব্দী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা।
❤ Support Us






