Advertisement
  • দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
  • ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

অকাল বসন্তের বাতাসে, উতলা বইয়ের গন্ধ

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
অকাল বসন্তের বাতাসে, উতলা বইয়ের গন্ধ

বইমেলার মাঝামাঝি, উধাও শীতের আমেজ। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস থমকে আছে ভিড়ে ঠাসা প্রাঙ্গনে। পরিবেশ অন্তরায়, সারা বিশ্বে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় বিশ্ব উষ্ণায়ন। সাহিত্য সম্পাদকরাও সাহিত্য সংস্কৃতির দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। পরিবেশভাবনায় বাঙালি পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাতে, সুপ্রকাশ প্রকাশনের অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্যের ‘চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে’ — বইটি ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তা। বিরুৎজাতীয় প্রকাশনী থেকে অংশুমান করের ‘Climate change and Cultural Representation’ – পুস্তকে জড়িয়ে রইলো ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃতি ভাবনার নিবিড় পাঠ। মানুষের মহামিছিলের ভিড়ে স্কুলের ক্ষুদেদের অনন্য ভাবনায় শহরে জল সংকটের কথা। গানে-কবিতায় মুখর পথ-নাটকে বড়দের মুখ লজ্জায় অবনত। কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছ তোমরা — প্রশ্ন নির্মল চোখের।

বই না কি খাবার? নাগরিক সমাজের নস্টালজিয়া কলকাতা পুস্তকমেলার বাতাসে কোন গন্ধ ভাসছে? বইমেলা তো কেবল আর দশটা বিকিকিনির মহোৎসব নয় বরং মিলোনোৎসব। বইয়ের সাথে মানুষের মিলন। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলন। ইতিহাসের পুননির্মাণ, সুবর্ণরেখা-সবুজপত্রের পসরায় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সম্ভার। দেখা মিলল বিশ্বভারতী নির্মাণের আবহে গুণীজনদের লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংকলন। লন্ডন থেকে ছাপা – তোতা ইতিহাস। বইপোকাদের আড্ডায়, পুরনো দিনের রোমন্থনে জমজমাট বইসরণির অলিগলি। আড়ালে আবডালে হারানো প্রেমের উপাখ্যান, নতুন প্রেমের পূর্বরাগ। সেই সঙ্গেই চলতে থাকবে চা, ভাজা-ভুজি। মানুষ কি বই খাচ্ছে, নাকি মানুষ বই গিলছে? নাকি মানুষের নজর এখন শুধুই ফুড ভ্লগিংয়ে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বই আর খাবারে আদৌ কি কোনও বিরোধ কিংবা প্রতিযোগিতা আছে? এই সব প্রশ্নই উঠে এল বইমেলায়, এই সময়–এর ১৯০ নম্বর স্টলে। আলোচনায় কথায় কথা বাড়তে বাড়তে উঠে এল বাঙাল–ঘটির কথা। হলো একটু–আধটু রসিক ঝগড়াও। শেষ পর্যন্ত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে এল আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে রাজনীতির বহুচর্চিত প্রসঙ্গ। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে সুবাসে, শীতবিদায়ের কালে লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ।

রাজনীতির মানুষেরা না কি বই পড়েন না? মঙ্গলবার কিন্তু অন্য ছবি, রাজনীতির তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা প্রাণের মেলায় আসছেন। আড্ডা জামাচ্ছেন। অডিটোরিয়ামে বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন। বই কিনছেন। পড়াশোনার গুরুত্ব কতখানি উঠে আসছে তারাদের আলোচনায়। সোমবার আজকাল -এর স্টলে মৌ রায়চৌধুরির ‘আনন্দ গান’ হাতে শিক্ষামন্ত্রী নাট্যকার ব্রাত্য বসুর গভীর পাঠ ঋদ্ধ করেছে সকলকেই। দাঁড়াবার জায়গার স্টলে এ দিন হাজির অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সঙ্গে ছিলেন প্রচেত গুপ্ত, অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য। প্রাঙ্গণ জুড়ে কবি-সাহিত্যিকদের সাথে মোলাকাত করছেন বিনোদন জগতের নক্ষত্রেরা। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় জানাচ্ছেন, ভালোলাগার কথা।

কল্ললিত কলরবে স্টল থেকে প্যান্ডেলে স্কুল ছাত্রদের আনাগোনা। রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি চিরায়ত ঝোঁক। ফেলুদা থেকে ব্যোমকেশ, হালফিল থেকে মৌচাক-টিনিটিন তিরতির আবেশে মশগুল শৈশব-কৈশোর। কেউ কেউ আলগোছে তুলে নিচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভুষণ, বনফুল। এবার স্কুল ছাত্রদের বই প্রকাশ করে চমক দিয়েছে মরীচিকা প্রকাশন। তবে প্রকাশকের আক্ষেপ – অর্থ দিয়ে বই প্রকাশের মূল কারণ সাহিত্যপ্রীতি নয় বরং রিল জমানার অনিবার্য খ্যাতিলাভের আকর্ষন। দেখা মিলেছে নতুন নতুন প্রকাশনের। পত্রিকা থেকে পাবলিশার্স যাত্রা। এবারে প্রথমবারের মতো স্টল দিয়েছেন তাঁরা। কিছু ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠেছে নতুন গজিয়ে ওঠা প্রকাশকদের নিইয়ে। যাদের কোনো কৌলিন্য নেই, আছে জিনে পাওয়া হিসাববিহীন টাকা আর প্রভূত শাসক সংযোগ- তাদর প্রত্যেকেই প্রায় এখন একদিকে পুরোনো বেশ কিছু বই ছাপছে, যেগুলোর লেখকদের বহুকল প্রয়াণ ঘটেছে বা তাদের তেমন জোরদার দাবিদার উত্তরাধিকারী নেই, অর্থাৎ যাদের বইয়ের জন্য কোনো রয়্যালটি দিতে হবে না। পুরোটাই প্রকাশকের লাভ। এমন কিছু বই। তবে ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। সত্যজিত চর্চায় তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে সুস্মৃতি প্রকাশনের ‘সত্যজিত কুইজ’ উদ্যোগে ভিড় জমাচ্ছেন সিনেমাপ্রেমীরাও।

তরুণ কবি লেখকদের বইপ্রকাশে মুখর লিটিল ম্যাগাজিন চত্বর। প্রথিতযশা প্রকাশকরা প্রায় প্রতিদিন পাঠদের উপহার দিচ্ছেন নতুন বইয়ের গন্ধ। এ দিন দে’জ পাবলিশিং প্রকাশ করেছে পূর্নেন্দু পত্রীর দুই খন্ডে উপন্যাস সংগ্রহ। তিনটি অপ্রকাশিত উপন্যাস রয়েছে এতে। ৪ তারিখ পত্রভারতী এবং দিনেশ্চন্দ্র সেন্টিনারি ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ‘কিশোর সাহিত্য সম্মান’-এ সম্মানিত করা হল সাহিত্যিক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য।
আগামী ৬ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে কলকাতা বইমেলা লিটেরাচার ফেস্টিভ্যাল। তাঁর আগে নারায়ণ সান্যাল সভাগৃহে বিদগ্ধ আলোনার রেশ পৌঁছে যাচ্ছে ১ থেকে ৯ নং গেটে। বিশ্ব সাহিত্য ভাবনায় পড়ুয়া মন বইসমুদ্র থেকে মণিমুক্তের মতো তুলে নিচ্ছেন ফরাসি-জার্মান-লাতিন, ইংরেজি প্রখ্যাত বইয়ের বাংলা অনুবাদ। আরম্ভ-র দৃষ্টি নন্দন স্টলে বই ও পত্রিকা নির্মাণে সম্পাদকের গুরুত্ব অন্বেষণ ফিরে এল আবার । লেখকদের সুদীর্ঘ, কঠিন যাত্রায় বিচক্ষণ আর দুরদর্শী সম্পাদক খনি থেকে তুলে আনেন খাঁটি, গলিয়ে পুড়িয়ে আকার দেন প্রতিমার। সমাচলোচানায় বিদ্ধ করেন, পরম মমতায় জড়িয়ে রাখেন শব্দশ্রমিকের অন্তর্জলী যাত্রা। ‘সাহিত্য সংসদ’ -এর ভাষাবৈচিত্রের ‘বিবেধের মধ্যে এক ভারত ভাবনা।’ ভারতীয় ভাষা-উপভাষার সংস্কৃতি আঁজলা ভরে পাণ করছেন মননশীল মন। বিশ শতকে দাঙ্গার ইতিহাসের আনুপঙ্খিক চর্চাকারী অধ্যাপক সুরঞ্জন দাশের মতো ব্যক্তি, তাঁর গবেষণা চর্চায় , অনবদ্য বাংলা অনুবাদে এ বই যথাযত, সময় উপযোগী। প্রশ্ন উঠছে এই তা হলে অনুবাদের রাজনীতি ও রাজনীতির অনুবাদ? এতকিছুর মাঝে নিজের কৌলীন্যে অটুট কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা। স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সংস্কৃতি চর্চায় লোকান্তরের পাঠ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!