- এই মুহূর্তে দে । শ
- জুন ১৮, ২০২৫
লাগাতার অভিযানে কোণঠাসা ‘লাল সন্ত্রাস’! অন্ধ্রপ্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত সিপিআই (মাওবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য-সহ ৩ শীর্ষ মাওবাদী নেতা

অন্ধ্রপ্রদেশের অলুরি সীতারামা রাজু জেলায় মাওবাদী দমনে বড় সাফল্য পেল নিরাপত্তা বাহিনী। বুধবার ভোরে অন্ধ্র-ওড়িশা সীমান্তের দেবীপটনমের গভীর জঙ্গলে যৌথবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হলেন সিপিআই (মাওবাদী)- ৩ শীর্ষ নেতা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম গজারলা রবি ওরফে উদয, যিনি শুধু অন্ধ্র-ওড়িশা বর্ডার বিশেষ অঞ্চল কমিটির সম্পাদকই ছিলেন না, ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও। তাঁর মাথার দাম ছিল ২৫ লক্ষ টাকা। দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্ত এলাকায় কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ মাওবাদী নেত্রী— বিশেষ অঞ্চল কমিটির সদস্য অরুণা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডার অনজু। অরুণা হলেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছত্তীসগড়ে এনকাউন্টারে নিহত কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রামচন্দ্র রেড্ডি ওরফে চালপতির স্ত্রী।
ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার, অন্ধ্র-ওড়িশা সীমান্তবর্তী দেবীপটনমের ঘন জঙ্গলে। জানা গিয়েছে, মাওবাদীদমন বাহিনী গ্রে-হাউন্ড গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তল্লাশি অভিযান চালায়। শুরু হয় গুলির লড়াই। মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও তারা পাল্টা গুলিবৃষ্টি শুরু করে। নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা গুলিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৩ জঙ্গিনেতার। রবি ও অরুণার মাথার দাম ছিল ২৫ লক্ষ টাকা করে। অরুণা ২০১৮ সালে আরাকুর টিডিপি বিধায়ক কিদারি সর্বেশ্বর রাও ও প্রাক্তন বিধায়ক সিভেরি সোমাকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে একাধিক একে-৪৭ রাইফেল-সহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। মেরেদুমিল্লির জঙ্গলে আরো মাওবাদী সদস্যরা লুকিয়ে আছেন। তাঁদের খোঁজে চলছে গ্রে-হাউন্ড বাহিনী। নিহতদের দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে রামপচোদভারম হাসপাতালে।
গত এক বছরে মাওবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকা ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে লাগাতার যৌথ অভিযান চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাহিনী। ‘অপারেশন কাগার’ এবং ‘অপারেশন শতপ্রহর’-এর মতো বিশেষ অভিযানে একাধিক শীর্ষ নেতা খতম হয়েছে। শুধু চলতি বছরেই ছত্তীসগড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৭০ জন মাওবাদী। জানুয়ারি মাসেই ছত্তিশগড়ের বাস্তার অঞ্চলে নিহত হয়েছিল ১৪ জন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন চালপতি। ২০০৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের আলিপিরি জঙ্গলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডুর উপর বোমা হামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন নিহত চালাপথি। অরুণার মা মাভি এবং ভাই আজাদও মাওবাদী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁরাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলেন। মে মাসে কোন্ডাগাঁও ও নারায়ণপুরে আরও বড়সড় সংঘর্ষে মৃত্যু হয় প্রায় ২৭ জন মাওবাদীর। তেলেঙ্গানায় বস্তার সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে একাধিক ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ঝাড়খণ্ডেও পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মির সদস্যদের বিরুদ্ধে বড়সড় অভিযান চালিয়ে ধরা হয়েছে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত নেতাকে। গত এপ্রিল মাসে ছত্তিশগড়ে এক গোপন অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন সিপিআই (মাওবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক তথা সর্বোচ্চ নেতা বাসবরাজ ওরফে নরসিংহ রেড্ডি। দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা এই নেতা সংগঠনের মূল কৌশলগত মাথা বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যু সংগঠনের পরিকাঠামোয় চরম ভাঙন ধরিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের অনুমান।
গোয়েন্দাদের দাবি, লাগাতার অভিযানে ক্ষমতা হারাচ্ছেন ‘লাল সন্ত্রাস’-এর নেতারা। দীর্ঘদিন ধরে যেসব অরণ্য অঞ্চল মাওবাদীদের ঘাঁটি ছিল, সেখানে সেনা ও আধাসেনার উপস্থিতি বেড়েছে। প্রযুক্তি-নির্ভর নজরদারি, ড্রোন ও স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে চলছে অভিযান। ছত্তিশগড়ের দণ্ডকারণ্য অঞ্চল থেকে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে যাতায়াতের জন্য অন্ধ্র-ওড়িশা বর্ডার অঞ্চল এতদিন মাওবাদীদের ‘সেফ করিডর’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন সেই করিডরই তাঁদের জন্য হয়ে উঠেছে মৃত্যুর অপর নাম। পুলিশের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, ‘এত অল্প সময়ে শীর্ষস্তরে এত মৃত্যু মাওবাদী সংগঠনের ইতিহাসে বিরল। নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার মতো অবস্থা নেই, পুরনো ক্যাডাররা আতঙ্কিত ও দিশাহীন। এই মুহূর্তে তারা স্পষ্টতই নেতৃত্বহীন, ছিন্নমূল।’ অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘অভিযানের পাশাপাশি সরকার স্থানীয় আদিবাসী ও বনবাসী সম্প্রদায়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সচেতনতা বৃদ্ধির উপরও জোর দিচ্ছে। এর ফলে মাওবাদীদের সামাজিক ভিত্তিও দুর্বল হচ্ছে। বিকল্প উন্নয়নের পথ আর একইঙ্গে অভিযান, দুই কৌশলেই উল্লেখ্যোগ্য সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে।’
উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবারই বলে এসেছেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণ নকশালমুক্ত করে তোলা হবে।’ কয়েক বছর আগেও যা ছিল নিছক রাজনৈতিক ঘোষণা, আজ তা ক্রমশ বাস্তবের চেহারা নিচ্ছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বিগত এক বছরে দেশের নকশাল-প্রবণ রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের যৌথ অভিযানে একের পর এক শীর্ষ মাওবাদী নেতা নিহত হয়েছেন, ধরা পড়েছেন বহু জঙ্গি, ধ্বংস হয়েছে বহু ঘাঁটি। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড থেকে মহারাষ্ট্র— সর্বত্রই চলছে লাগাতার অভিযান। অমিত শাহের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে একদিকে যেমন যৌথ বাহিনীর সক্রিয় অভিযান চলছে, পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও এনআইএ-সহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘কো-অর্ডিনেটেড কনটেইনমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি করেছে। মূল-নিবাসী এলাকায় সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চলছে রাজ্য-কেন্দ্রের যৌথ জঙ্গি ও সমর্থক চিহ্নিতকরণ, আর্থিক জোগান বন্ধের কৌশল ও প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারি।
❤ Support Us