- প্রচ্ছদ রচনা বি। দে । শ
- জুন ২০, ২০২৫
রক্তাক্ত শৈশবের ইতিহাস লিখছে যুদ্ধ! রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা — জাতিসংঘের প্রতিবেদনে হাড়হিম তথ্য

বিশ্বব্যপী যুদ্ধ থামেনি বরং তীব্র হয়েছে। আর তার নিষ্ঠুর ছায়ায় নিঃশেষ হচ্ছে শৈশব। বিশ্বের নানা প্রান্তে সংঘাতের মাঝখানে থাকা শিশুদের উপর সহিংসতা গত বছরে রেকর্ড ছুঁয়েছে বলে জানাল জাতিসংঘ। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর লঙ্ঘন’-এর সংখ্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ, অতীতের যে কোনো বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এক বছর আগেই এই বৃদ্ধির হার ছিল ২১ শতাংশ। মোট ৪১,৩৭০টি গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬,২২১ টি ঘটেছে ২০২৪ সালেই। বাকি ৫,১৪৯টি ঘটনা পূর্ববর্তী বছরগুলিতে ঘটলেও তা যাচাই হয়েছে গত বছরে। শিশুদের হত্যা, পঙ্গু করা, অপহরণ, যৌন সহিংসতা, স্কুল-হাসপাতালে হামলা—এমন কোনও নৃশংসতা নেই যা যুদ্ধের নামে করা হয়নি। এমনকি শিশুদের মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত রাখা রয়েছে। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, এটি এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার দলিল। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে জোরালো সতর্কসংকেত।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গাজা ও পশ্চিম তীরের শিশুরা। সেখানে মোট ৮,৫৪৪টি ঘটনা নিশ্চিত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো (৪,০৪৩), সোমালিয়া (২,৫৬৮), নাইজেরিয়া (২,৪৩৬) ও হাইতি (২,২৬৯)। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, সারা বছর জুড়ে শিশুদের লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি জল সরবরাহের মতো মৌলিক পরিকাঠামোতেও। । বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ, কারণ সামাজিক লজ্জা, নিরাপত্তার অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অপরাধের খবরই পৌঁছায় না। কঙ্গোর কিশোরী রেবেকার কথাতেই প্রতিধ্বনিত হয় সেই বিপন্নতা — ‘চিৎকার করেছিলাম, কিন্তু কেউ আসেনি।’
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিকটি হল রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের নিশ্চুপ থাকা, নীতির ব্যর্থতা। ইজরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে গত বছরেই ৭,১৮৮টি গুরুতর লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে। শিশু নিহত হয়েছে ১,২৫৯ জন। এ সংখ্যার বাইরেও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাস্তবতা আরো ভয়ঙ্কর, মৃতের সংখ্যা জাতিসংঘের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। এই তালিকায় পুনরায় স্থান পেয়েছে হামাসও। আবার রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনে স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি শিশুকেন্দ্রেও হামলা চালিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউক্রেনে রুশ সেনার হামলায় ৯৪ জন শিশু নিহত এবং ৫৭৭ জন আহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রগুলি শুধু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দায় এড়াতে পারে না। যখন একের পর এক রাষ্ট্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ভঙ্গ করে শিশুদের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তখন জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাজ শুধু নিন্দা করা নয়—অভিযুক্তদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
এখানে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—বিপন্ন শিশুদের রক্ষা করার জন্য মানবতার নামে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের মানে কী? আন্তর্জাতিক আইন পরিষ্কারভাবে বলেছে, যুদ্ধে শিশুদের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। শিশুদের মৃত্যু বা যৌন সহিংসতার ঘটনা ‘আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি’ নয়। বরং তা যুদ্ধ-অপরাধ। অথচ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সুবিধা ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রাপ্ত বাহিনী ও গোষ্ঠীগুলো শিশুদের হত্যা করেও অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। অন্তত ১,৯৩৮টি ঘটনা নিশ্চিত হয়েছে — যা রেকর্ডে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে হাইতিতে, তারপর নাইজেরিয়া, কঙ্গো এবং সোমালিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক লজ্জা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার কারণে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে মানবিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর মন্তব্য আমাদের দায়বদ্ধতার কথা আরো একবার মনে করিয়ে দেয়—যদি আমরা নীরব থাকি, তখন আমরাও সহিংসতারও ভাগীদার। শিশুদের উপর যৌন সহিংসতা যুদ্ধের একটি নতুন অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এটি শুধু একটি মানসিক আঘাত নয়, বরং ভবিষ্যতের উপর আঘাত। শারীরিক জখম, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, সমাজচ্যুতি—এই সবকিছুই এক একটি শিশুর জীবনকে চিরতরে ভেঙে দেয়। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান ইনগার অ্যাশিং কড়া ভাষায় বলেছেন, ‘যখন শিশুরা যুদ্ধের নামে এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হয়, তখন তা মানবতার বিরুদ্ধে বর্বর অপরাধ। যৌন সহিংসতা এখন আর গোপন নয়, বরং যুদ্ধের কৌশল হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ‘হাইতির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর চান্তাল সিলভি ইম্বো। তাঁর কথায়, হাইতি বর্তমানে শিশুদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক স্থান। বহু শিশু এখনও অনিরাপদ, গোষ্ঠী সংঘর্ষের মধ্যে আটকে রয়েছে, আশ্রয় শিবিরে দুর্বিষহ অবস্থায় কাটাচ্ছে। অনেকেই নিয়মিত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, এমনকি সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের জোর করে নিয়োগ করছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুদের বিরুদ্ধে ছয়টি গুরুতর লঙ্ঘন-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের হত্যা ও পঙ্গু করা, সশস্ত্র বাহিনীতে শিশুদের ব্যবহার, স্কুল-হাসপাতালে হামলা, যৌন সহিংসতা, অপহরণ এবং মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, সব পক্ষেরই দায়িত্ব সংঘর্ষে শিশুদের রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কোথায়? — প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন যুদ্ধের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয় অস্ত্র দিয়ে, কিন্তু শেষ হয় প্রজন্ম ধ্বংস করে। ২০২৪-২৫ সালের এই দুঃসহ চিত্র ঘোষণা দেয়, যুদ্ধ না থামলে, এভাবেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে থাকবে অনন্য শৈশব, প্রজন্মের উত্তরাধিকার।
❤ Support Us