Advertisement
  • দে । শ
  • অক্টোবর ১৮, ২০২৫

ধনতেরাস, বাঙালির নয়া হুল্লোর ?

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
ধনতেরাস, বাঙালির নয়া হুল্লোর ?

পূর্ব ভারতে যতই দীপাবলির মূল ব্যঞ্জনা সীমাবদ্ধ থাকুক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ভূপ্রকৃতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে ধনতেরাসের দীপ্তি। তবে শুধু রূপা, সোনা বা কাসার বাসনের কেনাকাটা দিয়ে এ উৎসবকে বেঁধে ফেললে চলবে না। ধনতেরাস এখন বাঙালি নগরজীবনে আলো, অর্থ আর বৈভব মাখা নয়া হুল্লোড়। সাংস্কৃতিক, পৌরাণিক ও আধ্যাত্মিক দ্যোতনার নাম।

পুরাণ বলছে, সমুদ্র মন্থনের সেই মহাকাব্যিক ঘটনার ত্রয়োদশ তিথিতেই আবির্ভূত হন আয়ুর্বেদের দেবতা ধন্বন্তরী। হাতে ছিল অমৃতের কলস। তাঁর আগমন শুধু শরীর রক্ষার বার্তা নয়, বরং দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার প্রতীক। আজও সে ঐতিহ্যেই ঘরে ঘরে পুজিত হন ধন্বন্তরী, ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রবাদ ও অপ্রতিম।

অতীতে বাঙালি সমাজে ধনতেরাস-এর তেমন প্রচলন ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে এর ইতিহাস নেই। কিন্তু আজকাল ঝকঝকে শপিং মল, অলংকারের বিজ্ঞাপন এবং সর্বজনীন উৎসবস্বরূপ দীপাবলির বিস্তারে দিনটি জায়গা করে নিচ্ছে বাংলার ঘরেও। বহু পরিবারে লক্ষ্মী, কুবেরের সঙ্গে সঙ্গে ধন্বন্তরীর পুজোও হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে আয়ুর্বেদ, হোলিস্টিক মেডিসিন ও ‘ওয়েলনেস’-এর প্রতি যে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, তার পেছনেও রয়েছে এই দেবতারই ছায়া। ধনতেরাস মানেই সমাজের উচ্চবিত্তিয় শ্রেণীর বৈভব ছোড়ানো আর মধ্যবিত্তশ্রেণীর ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার অদম্য প্রয়াসের দিন। সোনার দোকানে ভিড়, রূপার পাত বিক্রির হিড়িক। কেনা হয় নতুন বাসনপত্র, গয়না, রান্নাঘরের সামগ্রী। অনেকেই এদিন কিনে ফেলেন নতুন গাড়িও – আর্থিক শুভলগ্নের দোহাই দিয়ে। শহরের সোনার বাজারে রেকর্ড বিক্রির মাঝে কেউ কেউ আবার কিনছেন আয়ুর্বেদ সামগ্রী, ঘরোয়া ওষুধ অথবা ঝাড়ুও, কারণ, বিশ্বাস বলে ঝাড়ু মানেই দারিদ্র্যকে ঘর থেকে তাড়ানোর প্রতীক। তবে প্রাচীন শাস্ত্র অনুযায়ী এই দিনে কিছু বস্তু কিনতে বারণও রয়েছে – যেমন লোহা বা ধারালো বস্তু, তেল, ঘি, এমনকি কাঁচের সামগ্রী। এসবই নাকি অশুভ শক্তিকে টেনে আনে। আধুনিক মানুষ একদিকে যেমন বিজ্ঞানের দোহাই দেয়, অন্যদিকে আবার বেছে নেয় বিশ্বাসের অবলম্বন – উৎসবের মধ্যেই এই দ্বৈততা বোধহয় বাঙালির চিরন্তন স্বভাব।

যদিও, ধনতেরাস কেবল ধন লাভের অনুরণন নয়, বরং এটি অকাল মৃত্যুর বিরুদ্ধে এক আলো জ্বালানোর দিন। রাজা হিমের পুত্রের সেই গল্প মনে পড়ে, যেখানে নববধূ স্বামীর মৃত্যু রোধ করতে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, অলংকার ছড়িয়ে ঘর উজ্জ্বল করেছিলেন, গান গেয়েছিলেন, যাতে যমরাজের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, ভুলে যান মৃত্যুর পথ। সে থেকেই রীতি— ‘যমদীপ দান’। বাড়ির দক্ষিণে মুখ করে জ্বলে ওঠে প্রদীপ – যমের পথ যেন রুদ্ধ হয়। এই প্রতীকী দীপ্তিই ধনতেরাসকে করে তোলে মরণজয়ী প্রার্থনার উৎসব। বাঙালির কাছে ধনতেরাস এখনো নতুন। তবু এখন দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ, সর্বত্রই লক্ষ্মী-কুবেরের ছবি, ঘরের বাইরে ঝাড়ু কেনা, নতুন বাসন পুজোর প্রস্তুতি – দেখা যাচ্ছে। অনেকের মতে, ‘ধন’ মানে শুধুই সোনা নয়, ‘জ্ঞান’, ‘সংস্কৃতি’, ‘মানবতা’ এসবই জীবনের প্রকৃত ধন, সত্যিকারের স্থায়ী সম্পত্তি। তাই আজকের দিনে কেউ নতুন বই কেনেন, কেউ সেবামূলক কাজে দান করেন, কেউ আবার প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটান – এটিও তো একধরনের ধনতেরাস।

সময়টা কেবল আলোর নয়, আত্মবিশ্লেষণেরও। কে সত্যিকারের ধনী ? যার আছে সোনা-রূপো-গাড়ি-প্রাসাদ, না কি যার আছে শান্তি, সুস্বাস্থ্য ও সুসম্পর্ক? ধন্বন্তরী যেন বলেন – ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’। আর লক্ষ্মী বলেন – ‘পরিশ্রমই পুরস্কার’। ধনতেরাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সম্পদের আসল মানে কেবল বস্তুগত বাহ্যিক উল্লাশ নয়। আজকের দিনে যদি একটি নতুন ঝাড়ু কেনা হয়, তার অর্থ শুধু ঘরের আবর্জনা সরানো নয়, বরং মনের ক্লান্তি, অতৃপ্তি ও হিংসার আবর্জনাও সরিয়ে দেওয়ার প্রতীক। প্রদীপ জ্বালানোর অর্থ শুধু আলোকিত ঘর-বারান্দা নয়, বরং এক আলোকিত উন্মুক্ত মন। ধনতেরাস দিয়ে দীপাবলির সূচনা হয়। শারদ উৎসবের পরে যখন জীবনে অসস ক্লান্তি নামে, তখন বাঙলি মনে বেজে ওঠে মহাশক্তির আরাধনায়, সমস্ত গ্নানি দূর করে উজ্জ্বল আলোর দিকে যাত্রা।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!