Advertisement
  • প্রচ্ছদ রচনা
  • নভেম্বর ৩, ২০২১

নোয়ার অশুরে

মেসোপোটেমীয় আখ্যান থেকে মৎস্য পুরাণ--সবেতেই রয়েছে সেই প্রলয়ঙ্করী বন্যার কাহিনী। মৎস্য পুরাণের মনুও কী তবে নোয়ার মতোই কোনো খাবার তৈরি করেছিলেন?

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
নোয়ার অশুরে

ভারতবর্ষে ছোট নাগপুর মালভূমিতে, ঝাড়খণ্ডের নেতারহাট থেকে ছত্তীসগঢ়ের সীমান্ত অবধি যাদের ছোট ছোট খাপরার চালে ছাওয়া মাটির ঘর দেখা যায়, সে আদিবাসী অসুরদের খাবার নয় অশুরে। সুকুমার রায় অ্যাসিরিয়া দেশটি নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছেন ‘অসুরদের দেশ’।  অ্যাসিরিয়রা যদি অশুরে খেতো তাহলেও  নিশ্চিন্তে একে অসুরদের খাবার বলা যেত। কিন্তু মিষ্টান্ন ‘অশুরে’ ভারতের আদিবাসী কিংবা অ্যাসিরিয়ার অসুরদের খাবার নয়। এটি তুর্কীদের খাবার।

অশুরে খাবারটির উৎপত্তির কথা জড়িয়ে আছে এক অতিপরিচিত পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে।

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী–পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন বলে একসময় ঈশ্বরের মনে অনুশোচনা জেগেছিল। ধরায় মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। ঈশ্বর ঠিক করলেন সমগ্র মানব জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। বাঁচিয়ে রাখবেন কেবল একজন ব্যতিক্রমী মানুষকে, যিনি  সৎ, ন্যায়পরায়ণ। সে মানুষটি নোয়া। আসন্ন ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে নোয়াকে সাবধান করে দিয়ে ঈশ্বর তাকে বললেন,  তিনি  যেন একটা বিশাল নৌকা বানান। তিনতলা উঁচু ঐ নৌকা নোয়া এবং তাঁর পরিবারের লোককে যেমন রক্ষা করবে, তেমনি পৃথিবীর প্রাণীকুলের নানান প্রজাতির আশ্রয় স্থলও হবে সে নৌকা।

ঈশ্বরের নির্দেশ মতো নোয়ার নৌকোয় যথেষ্ট পরিমাণে খাবার দাবার সংগ্রহ করা হল। পৃথিবীর সমস্ত পশুপাখি-কীটপতঙ্গের প্রতিটি প্রজাতি থেকে এক জোড়া প্রাণীকে আশ্রয় দেওয়া হলো নৌকোয়। তারপর শুরু হয় মহাপ্লাবন। দিনের পর দিন ঝড়লো অঝোর বৃষ্টি। জল বেড়েই চলল। চরাচরের আর সব ডুবে গেলেও, নোয়ার নৌকো কিন্তু ভেসে রইল। জীবজগতকে গ্রাস করল  সর্বনেশে বন্যার জল। পৃথিবীতে যত প্রাণী ছিল, একসময় সকলেরই সলিল সমাধি হল। কেবল বেঁচে গেলেন নোয়া আর তাঁর নৌকোর সহযাত্রীরা। নোয়ার নৌকোর সেই প্রাণীদের থেকেই পৃথিবীর বুকে আবার শুরু হল নতুন জীবনধারা।

হিব্রু বাইবেলের এই কাহিনীই রয়েছে কোরান শরিফে। সেখানে কেবল ইশ্বর হয়েছেন আল্লাহ আর নোয়া হয়েছেন নুহ। এই নোয়া বা নুহ এর হাতেই তৈরি হয় প্রথম ‘অশুরে’। মহাপ্লাবনের সময় তুরস্কের আরারাত পর্বতে আশ্রয় নেয় নোয়ার নৌকো। বন্যার বিধ্বংসী রূপ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। কিন্তু জল তখনও কমেনি। নৌকোয় খাবার দাবার ফুরিয়ে আসছে। তখন নোয়া তাঁর নৌকার অবশিষ্ট রসদ এক জায়গায় জড়ো করে একটি খাবার তৈরি করেন। সেই খাবার হচ্ছে মিষ্টান্ন ‘অশুরে’। নোয়াকে স্মরণ করে যা ‘নোয়ার পুডিং’ নামেও খ্যাত।

Asura-matsha-puran.png

 বাইবেল থেকে  কোরান সবেতেই উল্লেখ আছে এ গল্পের। মহাপ্লাবনের সময় তুরস্কের আরারাত পর্বতে আশ্রয় নেয় নোয়ার নৌকো। নৌকার অবশিষ্ট রসদ এক জায়গায় জড়ো করে একটি খাবার তৈরি করেন নোয়া । সেই খাবার হচ্ছে মিষ্টান্ন ‘অশুরে’। যা ‘নোয়ার পুডিং’ নামেও খ্যাত।


বলা হয় দশটি উপাদান দিয়ে নোয়া তৈরি করেছিলেন ‘অশুরে’– গম, বার্লি, চাল, বিন, চানা মটর, খেজুর, শুকনো ফল, বাদাম, দারচিনি ও ডালিম। মূল উপকরণ একটি বড় পাত্রে সেদ্ধ করা হয়  একসঙ্গে। কিন্তু তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায় না। সেদ্ধ হলে পর, তার সঙ্গে মেশানো হয় সামান্য মশলা, শুকনো ফল, বাদাম।

ভাবছিলাম, মহাপ্লাবনের কথা। মেসোপোটেমীয় আখ্যান থেকে মৎস্য পুরাণ–সবেতেই রয়েছে এই প্রলয়ঙ্করী বন্যার কাহিনী। আচ্ছা, মৎস্য পুরাণের মনুও কি নোয়ার মতোই কোনো খাবার তৈরি করেছিলেন, বিষ্ণুরূপী মাছে টানা নৌকায় রাখা উপাদান দিয়ে?

অশুরে নিয়ে কিংবদন্তী থেকে চোখ সরিয়ে ইতিহাসের কাছে যাওয়া যাক।

২০১৩ সালে একটি বই প্রকাশিত হয় ‘শেরবেট অ্যান্ড স্পাইস–কমপ্লিট স্টোরি অফ টার্কিশ সুইটস অ্যান্ড ডেজারটস’। লেখিকা মেরী ইশিন এতে তুরস্কের খাবার দাবার, বিশেষ করে রকমারি মিষ্টির ইতিহাস, সময়ের সঙ্গে সেসবের বিবর্তন, রান্নার পদ্ধতি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে তুলে ধরেছেন। বইটির ভূমিকাতেই রয়েছে ‘অশুরে’র কথা।

তিনি লিখেছেন, তুরস্কের কুইজিনে মিশেছে বিভিন্ন সংস্কৃতি। পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া মহাদেশের নানা অঞ্চল, বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য, ইউরোপ, আফ্রিকার নানা দেশের রন্ধনশৈলী কালের স্রোত বেয়ে প্রবেশ করেছে  উসমানীয় রান্নাঘরের ভেতর। এর ফলেই এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার খাদ্যশিল্প জন্ম নিয়েছে টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীর দেশে।

ইশিনের মতে, প্রস্তরযুগের শেষের দিকে যখন সে দেশের মানুষ প্রথম জেনেছে কৃষিকথা, উর্বর জমি কর্ষণ করে ফলিয়েছে গম, যব– সেই আদি কৃষকদের হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে ‘অশুরে’। লেখিকার কথায়, তুরস্কের পুডিং ‘অশুরে’র নাকি ইংরেজ পরিজ ‘ফ্রুমেন্টির’ সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে। এই ফ্রুমেন্টি হচ্ছে ইংরেজদের প্রাচীনতম জাতীয় খাদ্য।

ইংরেজদের কথা যখন উঠল, তখন তুরস্ক থেকে লন্ডনে ফিরে আসি। ষোড়শ— সতেরশো শতাব্দী থেকে যুক্তরাজ্যে এসে বসবাস করতে শুরু করেছিল কিছু সংখ্যক তুর্কি। অনেকে তখন ভূমধ্য সাগর পেরিয়ে আসত ইংরেজ বণিকদের ক্রীতদাস হয়ে। সেই সময় যুক্তরাজ্যে হাতে গোনা কয়েক ঘর তুর্কী থাকলেও, ক্রমে এ দেশে তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। লন্ডন ও তার আশপাশের অঞ্চলে এখন প্রায় ৫ লক্ষ তুর্কী থাকেন। এমনকি বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রপিতামহ ছিলেন একজন তুর্কি সাংবাদিক। শেষ ওসমান সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়র রাজত্বকালে রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে তুরস্ক ছেড়ে টেমসের তীরে এসে আশ্রয় নেন বরিস জনসনের পূর্বপুরুষ আলীকেমাল বে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দেহেই তুর্কি রক্ত বইছে, এখানে তুর্কি খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি দেখলে আর আশ্চর্য হবার অবকাশ থাকে না। তুর্কির খাবার ‘অশুরে’ চেখে দেখতে আমাকে তাই হাজার মাইল পেরিয়ে তুরস্কে ছুটতে হয়নি।

উত্তর লন্ডনে আমার বাড়ির পাশের তুর্কি রেস্তোরাঁতে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম ‘অশুরে’কে। দোকানে কাচের কাউনটারের সামনে দাঁড়িয়ে কোন খাবারটা  কিনবো ভাবছি, এমন সময় দেখি একটা বিরাট গামলা জাতীয় পাত্রে কী যেন একটা খাবার। চেহারায়, ঘনত্বে ফিরনির সঙ্গে মিল রয়েছে আবার রং দেখে কখনো মনে হচ্ছে সত্যনারায়ণের সিন্নি আর তুশা শিন্নি যেন একসঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকে লাইন দিয়ে সেই খাবার নিচ্ছে বাটি ভর্তি করে। রেস্তরাঁর তরুণ তুর্কী কর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটি তুরস্কের তো বটেই, এমনকি  পৃথিবীর প্রাচীনতম ডেজার্ট ‘অশুরে’! মহরমের মাস জুড়ে আর তারপরও সারা বছরই এই মিষ্টান্ন তুরস্কের প্রায় প্রতিটি খাবারের দোকানে, বাজারে পাওয়া যায়। কথায় কথায় সে বলছিল, ও দেশে অশুরে খাবারটি কখনো একা খাবার জন্য তৈরি করা হয় না। আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী, পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে নিজে খাওয়া এবং অপরকে খাওয়ানো, বিশেষ করে দু বেলা দু মুঠো খাবার যাদের জোটে না তাদের সঙ্গে এই খাবার ভাগ করে নেওয়াই প্রথা।

‘অশুরে’র সঙ্গে ‘দশ’ সংখ্যাটির যোগাযোগ গভীর। আরবিতে আশর অর্থ দশ। আরবি বর্ষের প্রথম মাস মহরম। মহরমের ১০ তারিখ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি ‘আশুরা’ হিসেবে পরিচিত। সুন্নি এবং শিয়া–দুই সম্প্রদায়ের কাছেই দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিমদের মতো ইহুদিরাও মহরমের দিনটিকে পবিত্র মনে করে। উপোস করে থাকে। মহরমের দশম দিনটি স্মরণ করে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করা হয়, প্রার্থনা করা হয়। তাছাড়া, বলা হয়, নুহ বা নোয়া প্রথম যেদিন দশটি উপাদানের সাহায্যে মিষ্টান্নটি তৈরি করেন সেদিনও ছিল মহরমের দশম দিন ‘আশুরা’। ‘আশুরা’ থেকেই নোয়ার পুডিং এর নাম হয়েছে ‘অশুরে’।

পুরাণের অসুরের সঙ্গেও দশ সংখ্যাটির দহরম-মহরম। দুর্গা পূজার শেষ দিন বিজয়া দশমী। মা দুর্গা সেদিন ফিরে যান কৈলাসে। মর্তে আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য, অর্থাৎ দশপ্রহরণধারিণী রূপে অসুর বধের কাজটা সেরে। অসুর বধ মানে জগতের সকল অকল্যাণ, অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করা। পুরাণ মতে, মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন, নয় রাত্রি যুদ্ধ করে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন দুর্গা। এখানেও দশ সংখ্যাটি ঘুরে ফিরে আসছে।

আশুরা আর অসুর এর উচ্চারণে সাদৃশ্য বা আশুরা ও বিজয়া দশমী, এই দুটি বিশেষ দিনের মিল যে কেবল ‘দশ’ সংখ্যাটিতে আবদ্ধ, তা নয়। তুর্কি রেস্তোরাঁর কর্মচারীর মুখে অশুরের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে কিছু কথা ঘোরাফেরা করে। মহরম আর দশমী..মহরম মাসে হোসেন ও তাঁর সঙ্গীদের আত্মত্যাগে শোকের আবহ। বিজয়া দশমীতে মায়ের বিসর্জনের সময়েও বিষাদের সুর। মহরমের ‘আশুরা’-য় রোজা রাখার প্রথা, অসহায় দুঃস্থদের পাশে থাকা, বিশেষ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শোক প্রকাশ করার শান্তি। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন শেষে মাথায় ছিটিয়ে দেয়া হয় শান্তির জল। দুটি ভিন্ন ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপটও আলাদা। কিন্তু তারই মধ্যে কিছু অদ্ভুত সাদৃশ্য। কোথাও যেন আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথি আর মহরম মাসের দশম দিন ‘আশুরা’ হাত ধরাধরি করে মিলে মিশে যায়। এবার তাই বিজয়া দশমীর মিষ্টি মুখ করবো মহরমের মিষ্টান্ন অশুরে সহযোগে।


  • Tags:

Read by:

Advertisement
Hedayetullah Golam Rasul Raktim Islam Block Advt
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
মুদিখানার সামগ্রী কিনতেও পাড়ি দেন দু’দিনের পথ! কানাডার মহিলার জীবনসংগ্রামে অবাক গোটা দুনিয়া ভা | ই | রা | ল
বাংলাদেশে মহামারীর আবহে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা, প্রকাশ্যে উদ্বেগজনক রিপোর্ট এই মুহূর্তে

বাংলাদেশে মহামারীর আবহে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা, প্রকাশ্যে উদ্বেগজনক রিপোর্ট

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ছিল ২১ হাজার ৭৮৯টি, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি ।

আজ বিকেল ৫টায় মোদী-মমতা আমনে-সামনে এই মুহূর্তে
error: Content is protected !!