- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২
বাইরে ষড়যন্ত্র, ভেতরে ইরানি নারীর বিদ্রোহ
দেশের ভেতরেও তার পরম শত্রু শাসকের নব আয়োজিত রাষ্ট্রচিন্তা তার অতীতমুখী কট্টরপন্থা। মহিলাদের ওপর আরোপিত অনুশাসন আর মুক্তচিন্তার কন্ঠরোধ ইরানকে, ইরানের হাজার হাজার বছরের স্বাস্থ্যময় ভাবনার স্রোতকে হেয় করছে। এই অনাধুনিক, আত্মঘাতী অপপ্রয়াস যত বাড়বে, ইরানের মনন ততই পথ হারাবে।

বলিউডের ইরানি অভিনেত্রী, রূপে–গুনে অতুলনীয় এবং প্রগাঢ় স্পষ্টবাদী এলনাজ নোরোজি বলেছেন, ইরানের নীতি পুলিশের অকথ্য অত্যাচারে পুলিশ হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মেহেশা আমিনির মৃত্যুর পর, আমার দেশজুড়ে যা ঘটছে, যে ভাবে অসংখ্য নাগরিককে হত্যা করা হচ্ছে, তার দিকে বিশ্বের নজর দেওয়া উচিত। তাদের অবরুদ্ধ কন্ঠ কী বলতে চায় তা সবার শোনা জরুরী। এলনাজ ভারতীয় চলচ্চিত্র দর্শকের কাছেও সুপরিচিত মুখ। বহু মিউজিক ভিডিও, ওয়েবসাইটে প্রায়ি তাঁর মুখ ভেসে ওঠে। ইরানে তাঁর জনপ্রিয়তা বিপুল। ইরানি ঐতিহ্য, আদব–কায়দা তাঁর মজ্জাগত। হিজাবে ঢাকা পড়তে অভস্ত্য নন। কিন্তু দেশজ শালীনতার হেফাজতে আর মহিলাদের যাপনের আধুনিকায়নে তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল। এলনাজ নৌরোজি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমার ভারতীয় বন্ধুদের অনুরোধ করছি, ইরানি মহিলাদের পাশে দাঁড়ান। হাতে হাত রেখে চওড়া কন্ঠে বলুন, ৪৩ বছর জুড়ে ইরানি মহিলারা তাঁদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের জন্য লড়াই করছেন। তাঁদের রক্তক্ষরণ, তাঁদের আত্মত্যাগ অপরাজেয়।
এলনাজের পরিবার এখন ইরানে। গত কয়েকদিন আগে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পর জানিয়েছেন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট সার্ভিস বিঘ্নিত। ফোনেও কথা বলা যাচ্ছে না। ইরানের নীতি পুলিশ আইনরক্ষার নামে কঠোর অত্যাচার চালাচ্ছে। রাস্তায় মেয়েদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। ইনাজ বলেছেন, গত কয়েকবছর আগে আমি তেহরানে ছিলাম। সঙ্গে আমার খুড়তুতো বোন ছিল। হঠাৎ একজন মহিলা আমাদের সামনে এসে আমার পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, এটা কী? ওঁর ফারসি জবান বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি । কিন্তু ওঁর প্রশ্নের অর্থ বোধগম্য নয় জেনে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলতে চাইছেন। এরপর আর কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই উনি আমাদের ঘাসত–এ–এরশাদ (নীতি পুলিশের) হাতে তুলে দিলেন। পুলিশ বলল, ওই মহিলা ভুল বলেননি। আপনার হাঁটুর নীতের প্যান্টের পা এত চওড়া কেন? আরো টাইটফিট হওয়া উচিত। এরকম অবস্থায় কোনও নারী জীবনযাপন করতে পারে না। তাঁদের অবরোধমুক্ত করতেই হবে।
৪৩ বছর আগে আয়াতউল্লাহ খুমেইনির নেতৃত্বে শিয়া বিপ্লবের যখন উত্থান ঘটল, তখন মহিলাদের ওপর নিশ্চিদ্র কন্ঠরোধ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু নীতিমন্ত্রকের এত কড়াকড়ি ছিল না। তবু হাজার হাজার মহিলা দেশ ছেড়ে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য। তাঁদের চেতনা, তাঁদের অধিকারবোধ অন্যভাবে তৈরি হয়, মুক্ত পরিবেশে। ইরানের ভেতরেও গণচেতনার ভিত তৈরি হতে থাকে। এখনকার রিজিম হঠাৎ উগ্ররূপ ধারণ করেছে। কারন কী? চিন ও রুশপন্থী ইরানকে বিক্ষোভের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে পশ্চিমের বহুরূপী ষড়যন্ত্র। ইরানিরা সাধারণত মধ্যমপন্থী। বুদ্ধিদীপ্ত জাতি। ইসলামি পরিমণ্ডলে জ্ঞান–বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও যুক্তিচর্চার তাদের মনীষার অবদান অসামান্য। পার্শ্ববর্তী ভূখন্ড, ভারতীয় উপমহাদেশ ইরানি ঘরানার বিদ্যাচর্চায় নানাদিক থেকে উপকৃত। মধ্যযুগে একবারই রাষ্ট্রশক্তি শিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন জীবন যাপনের ওপর এত কড়াকড়ি ছিল না। ১৯৬৯ সালের শিয়া বিপ্লবের পরেই পশ্চিমের আধুনিকতা বোধকে পরিহার করে শাসকরা শিয়া রক্ষণশীলতা চাপিয়ে দেয়। বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ইরানি শাসকরা চাপ বরদাস্ত করেননি। ধীরে ধীরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন মিলিশিয়া উপসাগরীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ইয়েমেনেও প্রবেশ করে। প্রতিবেশী দেশগুলিতে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিশেষ করে পরমানু অস্ত্রের পরীক্ষা–নিরীক্ষায় পশ্চিমী দুনিয়া আঁতকে ওঠে। পশ্চিমের ‘অর্থনৈতিক সন্ত্রাস’ও ইরানকে রুখতে পারেনি। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, কাতার ও ফিলিস্তিনে তেহরানের উপস্থিতি আধিকতর জোরদার হয়ে ওঠে। সৌদি আরবের বাইরে পশ্চিম এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ ইরানের পরমানু গবেষণায় উজ্জীবিত। তেহরানে চিনের নিঃশব্দ প্রবেশকে, রাশিয়ার পরোক্ষ উপস্থিতিকে পশ্চিম মেনে নিতে পারছে না। সৌদি আরবের সঙ্গে তেহরানের সদ্ভাব নেই। আবার সরাসরি সঙ্ঘাতও নেও। ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ না করলে সৌদি আরবও সম্ভবত ইরানকে নিয়ে মাথা ঘামাত না। ইয়েমেনে, সৌদির মিত্রশক্তি আমেরিকার সঙ্গে জিদ্দা ক্রমশ শীতলতা তৈরি করছে। প্রকাশ্যে নয়, বিবৃতি জাহির করে নয়, ভারত ও চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমস বাড়িয়ে তুলে বোঝাতে চাইছে, তেলবাজারের নিয়ন্ত্রণে সে আরও স্বনির্ভর হতে চাইছে। সম্প্রতি , সৌদি বাদশাহ তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অনেকটাই যুবরাজ সলমানের হাতে তুলে দিয়েছেন। সলমান দূরদর্শী রাজপুরুষ। ঘরোয়া রক্ষণশীলতায় ঘা দিয়েছেন। মেয়েদের অধিকার বাড়ছে। সৌদির স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পশ্চিমের কাঙ্খিত নয়। ইরানের আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার ঐকান্তিকতাকেও পশ্চিম সুনজরে দেখতে অভ্যস্ত নয়। পরমাণু গবেষণায় ইরানের সাফল্য মানেই আমেরিকার নিযুক্ত তেলের দারোগা তেলআবিবের বিপদ। ফিলিস্তিনকে ইসরাইলি মানচিত্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও ভেস্তে যেতে পারে। এ কারনেই ইরানের অভ্যন্তরীন যে কোনও ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে তারা মদত দিতে থাকবে। ১৯৫০ –এর দশকের শেষের দিকে মহাম্মদ মুসাদ্দিক যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েই তেল জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা করলেন, সিআইএ তখন অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠল। মিথ্যা অভিযোগে মোসাদ্দেককে আটক করে চোর, মদ্যপ, জুয়াড়িদের কারগারে বসবাস করতে বাধ্য করল শাহানশাহের সরকার। জেলেই মারা গেলেন অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী। ৬৯ সালে, মেলবোর্নের প্রাক্তনী বনিসদরকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিল তেহরান। মুক্তচিন্তার অর্থশাস্ত্রীকে রুশপন্থী অপবাদ রটিয়ে শীর্ষশাসকের চক্ষুশূল করে তুলল পশ্চিম দুনিয়া। বিদেশে আশ্রয় নিতে হল বনিসদরকে। দেশে কবরের দু’গজ জমিও মিলল না তাঁর।
ইরানের সমস্যা, গুরুতর সমস্যাই বটে— বাইরে, বিশেষ করে পশ্চিমে তার অভ্যন্তরীন নীতি, তার ঐতিহ্যবাহী দর্শন, স্বনির্ভরতা গ্রহনযোগ্য নয়। ছায়াবাদ, সুফিচিন্তা বৌদ্ধিক মহলে আদৃত হলেও ইউরোপের গনচিত্ততার সঙ্গে অপরিচিত। সাম্প্রতিক বিজ্ঞান চর্চা আর অস্ত্র সমৃদ্ধি ইউরোপকে, আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন কর তুলেছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় ভারতই ইরানের প্রধানতম বন্ধু। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়াও যথেষ্ট সদয় নয়। আশঙ্কা, এসব দেশে শিয়া রাজনৈতিক দর্শন মাথাচাড়া দিতে পারে।
দেশের ভেতরেও তার পরম শত্রু শাসকের নব আয়োজিত রাষ্ট্রচিন্তা তার অতীতমুখী কট্টরপন্থা। মহিলাদের ওপর আরোপিত অনুশাসন আর মুক্তচিন্তার কন্ঠরোধ ইরানকে, ইরানের হাজার হাজার বছরের স্বাস্থ্যময় ভাবনার স্রোতকে হেয় করছে। এই অনাধুনিক, আত্মঘাতী অপপ্রয়াস যত বাড়বে, ইরানের মনন ততই পথ হারাবে। পশ্চিমি রাষ্ট্রচিন্তা আর রাষ্ট্রীয় অহমিকা ইরানের হালের রাষ্ট্রশক্তির ভুলের সুযোগ নিয়ে ঘরে বাইরে, তাকে কোনঠাসা করতে ব্যস্ত। সে চায় তার আধিপত্যবোধের অপরাজেয় অক্ষুন্নতা। মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম এশিয়ায় যা চায়, এখানেও তারা তা চাইছে। ইরানের রাষ্ট্রশক্তি প্রায়ই ভুলে যায়, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায়র সমর্থন ছাড়া তার রাষ্ট্রীক নবনির্মাণ সম্ভব নয়। মহিলাদের অবরোধহীন অগ্রগতি ব্যতিরেকে নতুন তেহরান পুরনো তেহরানের আভিজাত্য ছুঁতে পারে না। তার দরকার মাতৃত্বের পূ্র্ণ আস্থা। দরকার বৌদ্ধিক মুক্তাঙ্গনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যা মধ্যযুগে আরব শাসনের অন্তরালে ও প্রকাশ্যে ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হচ্ছিল। এখানেই সাম্প্রতিক কালের ইরানি শাসক ইরানের ঘোরতর জাতীয় শত্রু। ইরানি মায়েদের নবজাগৃতিরও প্রবল অন্তরায়। এই অন্তরায়ের অবসান দরকার। এরকম অবসানকে ত্বরান্বিত করতে জরুরি পূর্ব–পশ্চিমের একাত্ম, যৌথ জনমত গড়ে তোলা। কিন্তু শাসকের চাপিয়ে দেওয়া রক্ষণশীলতা আর অবদমনের সুযোগ নিয়ে, সে পশ্চিম হোক আর পূর্ব হোক, যদি কেউ ইরানের জাতীয় জেদ আর অঙ্গীকারকে বিভ্রান্ত করতে চায়, গুঁড়িয়ে দিতে চায় ইরানের অর্জিত বৈজ্ঞানিক ফসলকে, তাহলে বিপরীত স্রোত গর্জে উঠবে। ঘেরাও হতে পারে বিদেশি ষড়যন্ত্রের আশ্রয় কেন্দ্র। আশা করি, পশ্চিম দুনিয়া ভুলে যায়নি যে, ৬৯ সালে, মাসের পর মাস মার্কিন দূতাবাসকে অবরোধ করে রেখেছিল গণসমর্থিত বিপ্লবীরা। ওই পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশিত নয়। লক্ষণ বড়ো ধোঁয়াটে। অভ্যন্তরীন জুলুমকে রুখতে হবে ইরানকেই। এজন্য সর্বাত্মক জনমত তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্রের নাকগলানোও ক্ষুব্ধ কন্ঠে প্রতিহত করা জরুরি।
❤ Support Us