Advertisement
  • দে । শ ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
  • ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪

বাংলা বানানে নৈরাজ্য । শিলচরে একদিনের কর্মশালায় সমবেত আক্ষেপ

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
বাংলা বানানে নৈরাজ্য । শিলচরে একদিনের কর্মশালায় সমবেত আক্ষেপ

ভাষার পীড়নে ধ্বস্ত উত্তর পূর্ব ভারতের শিলচরে হয়ে গেল নির্ভেজাল এক ভাষা উৎসব, ‘ভাষাদূষণ ও মাতৃভাষার বিপন্নতা’ শীর্ষক আলোচনা, এরই সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা রেখে একদিবসীয় ‘বাংলা বানান কর্মশালা’ অনুষ্ঠিত হল একাদশ ভাষাশহিদের শহরে ।

বিজিৎকুমার স্মারক বক্তৃতা দেন ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার । পাশাপাশি বানান কর্মশালাতেও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি । বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সভাপতি সঞ্জীব দেবলস্কর তাঁর ভাষণে বলেন, আসামে বাঙালির অস্তিত্ব-সংকটের নবতম সংযোজন, আমরা ‘বাঙালি হইয়া থাকিব, না বাংলাভাষী অসমিয়া হইয়া মরিব ।’ আলোচনার সূত্রপাত করে তিনি বলেছেন, এ রাজ্যে উপরে বর্ণিত সব কিছুই আছে, কিন্তু যা নেই তা হল ভাষাতত্ত্ব, নৈর্ব্যক্তিক ভাষাবিজ্ঞান । এজন্যে এখনই আমাদের প্রয়োজন ভাষা ও ভাষাতত্বের চর্চা ।

ভাষা-রাজনীতির কূটচালে বিগত দিনগুলোতে এ রাজ্যে শ্রীহট্ট-কাছাড়ে প্রচলিত আঞ্চলিক উপভাষাকে মান্যচলিত বাংলার উর্ধ্বে স্থান দিয়ে মূলস্রোত প্রতিস্পর্ধী একটি না-বাংলা, না-অসমিয়া কিম্ভূত ভাষা প্রচলনের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল । এর বিরুদ্ধে ঈশান বাংলার অন্যতম বুদ্ধিজীবী, বাংলা ভাষার ‘তৃতীয় ভুবন-তত্ত্বে’র প্রবক্তা ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য পাঠ্যপুস্তকে, এমন-কি শিশুপাঠ্য বইয়েও এসব অনাচার বন্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । বিজিৎবাবুর এ প্রয়াসে সামিল হয়েছিল বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনও । আসামে বাংলা পাঠ্যপুস্তককে ইচ্ছাকৃত ভাষাদূষণ মুক্ত করতে বাঙালি এবং অসমিয়া শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, উচ্চপদস্থ আমলারাও (সত্যকাম হাজারিকা, আর, সি জৈন) ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন ।

মমতাবিহীন কালস্রোতে সে প্রত্যাহ্বান আবার নতুন করে হাজির হয়েছে । প্রশ্নটি হল বাঙালি কি স্বমর্যাদায় নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে, অর্থাৎ বাঙালি পরিচিতি নিয়ে, না খণ্ডিত এক আরোপিত অবাস্তব ভাষিক (বাংলাভাষী অসমিয়া) পরিচিতি নিয়েই বাঁচবে ? শর্তাধীন খণ্ডিত পরিচিতি গ্রহণ করার পরামর্শ যদি শুধুমাত্র অধ্যয়নহীন কোন একক সর্বাধিনায়কের রাজনীতিকের পক্ষ থেকে আসত সে এক কথা, কিন্তু যখন স্বভাষীয় কোনও সাহিত্য সভার বন্ধুরাও একই সুরে দোহার দেন তখন এদের জন্য কিঞ্চিত অনুকম্পা হয়, নানাভাবে উৎপীড়িত বাঙালির জন্যও হয় আশঙ্কাও।

ভাষার পীড়নে ধ্বস্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভাষা অনুরাগের পাশাপাশি অবস্থান করে ভাষিক অসহিষ্ণুতা । এখানে হয়েছে ভাষাদাঙ্গাও । দশকে দশকে পুড়েছে ঘর, ঝরেছে মানুষের রক্ত এই ভাষার জন্যই ।

গত দশকগুলোতে বাংলা ভাষার প্রথম (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ) এবং বরাক উপত্যকাসহ আসাম নিয়ে বাংলার তৃতীয় ভুবনে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ভাষাতত্বের চর্চা প্রায় থেমে গেছে । অভিধান, শব্দকোষ, বানানকোষ, এসব দীর্ঘদিন থেকে অমুদ্রিত এবং বাজারছুট, দুষ্প্রাপ্য । নতুন করে সম্পাদিত, সংশোধিত, সংযোজিত অভিধান নেই ।

বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ভুবন অর্থাৎ আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিকভ্রষ্ট পূর্ব বাংলায়, বিশ্বকবির সোনার বাংলায়, নজরুলের বাংলাদেশ, কিংবা জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় কিছুদিন আগেই এপারের পবিত্র সরকার এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শীর্ষে রেখে বৃহদায়তন ‘প্রমিত বাংলার ব্যাকরণ’-প্রণয়নের কাজটি করিয়ে নেওয়া হয়েছিল । ভাগ্যিস! তবে দুই খণ্ডের বইটি এপারে আর সহজলভ্য নয় । পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানান অভিধানের নব-সংস্করণ এবং অন্যান্য প্রকাশনার কোনও উদ্যোগই নেই । আচার্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যাযের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’, কিংবা রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকারও কোন সময়োপযোগী সম্পাদিত সংযোজিত সংস্করণও নেই । বাঙালি কি ধর্মে আছে না জিরাফে আছে, তা বোঝা যায় না, তবে বাঙালি ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে খুব একটা নেই তা বোঝা যায় । প্রায় দু দশক হল ফটোকপি বা পাইরেটেড সংস্করণ ছাড়া নতুন বা সম্পাদিত পুরনো অভিধান বাঙালির প্রায় নেইই । অভিধান-বিহীন একটি জাতির ভাষার বহমান ধারা ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কাও করেছেন সভাপতি ।ঈশ্বরচন্দ্র, রামমোহন থেকে সুনীতিকুমার, শহীদুল্লাহ, জ্যোতিভূষণ চাকীর বাংলায় ভাষার এ পীড়ন বড়ই অসহনীয় । আসাম, বিহার, এমন-কি পশ্চিমবঙ্গে নানা ভাবে ভাষিক আগ্রাসন দেখে নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমন গেয়েছিলেন,

প্রতিরোধ কর নজরুল শতবর্ষে,
প্রতিরোধ কর তিতুমির তিতুমির
ভাষার পীড়ন ঘোচাও ভারতবর্ষে
বল বীর, বল উন্নত মম শির।

মূল ভাষণে উঠে পবিত্র সরকার মুক্তকণ্ঠে বলেন, ভাষায় ভাষায় কোনও শত্রুতা, বিবাদ নেই, তার পরও যে বিবাদ হয় সেটা রাজনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা । বিশ্বায়নের যুগে শুধু বাংলা কিংবা অসমিয়া-ই নয় পৃথিবীর ছোট, বড়, মাঝারি সব কটি ভাষাই বিপন্ন ।

অনুষ্ঠানের সূচনায় ভাষাবিজ্ঞানীর হাতদিয়ে উন্মোচিত হল বঙ্গসাহিত্যের ভাষা বিষয়ক নিজস্ব একটি সুদৃশ্য বই– সুকুমার বাগচি রচিত ‘বাংলা বানান ও উচ্চারণ ।’ সে সঙ্গে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রাজীবমোহন পন্থের হাত দিয়ে উন্মোচিত হল অসমিয়া কবি কুসুম কলিতার বাংলা কাব্যগ্রন্থ, ‘কবিতার অঙিনায় ।’ এ প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়েছেন পবিত্রবাবু । তিনি একষট্টির ভাষাশহিদ, সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাশহিদ সুদেষ্ণা সিনহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।

ভাষার সংকট প্রসঙ্গে পবিত্র বাবু বলেছেন, ভাষা বিপন্ন হয় তখনই যখন একটি ভাষা অপর একটি ভাষার উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে । আর উপভাষা সংকট প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন উপভাষা কখনও আক্রান্ত হয় না । মানুষের যাবতীয় আবেগ, দুর্বলতা, মমত্ববোধ সবই আবর্তিত হয় মান্যচলিত ভাষাকে ঘিরেই । উপভাষা নিয়ে রাজনীতি করা অনুচিত । তিনি এও বলেন, ভাষার উপর যে আক্রমন হয়, তা ওই মান্যচলিত ভাষার উপরই । একষট্টির কিংবা একুশের শহিদেরা যে আত্মাহূতি দিয়েছেন সেটা কোনও উপভাষার জন্য নয়, ওই মান্যচলিত ভাষার জন্যই । সিলেটি, কাছাড়ি, বরিশালি, ঢাকাই বা ময়মসিং, চাটগাঁইয়া ভাষার জন্য নয় কদাপিও ।

পবিত্র সরকার মনে করে দিয়েছেন, ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোনও ভাষা বা উপভাষারই ছোট কিংবা বড় নেই । সব ভাষাই সমান মর্যাদা পাবার অধিকারী । ১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বায়নের থাবায় এমন একটি জগাখিচুরি ভাষা সৃষ্টি হয়েছে যার আগ্রাসনে প্রতিটি মাতৃভাষা আজ বিপন্ন । এই ভাষাসংকটের মুহূর্তে সরকারের যা করণীয় তা করেননি, এর ফলে মাতৃভাষার সংকট ঘণীভূত হয়েছে । অভিভাবকরা সহজেই ধাবিত হচ্ছেন ইংরেজির দিকে । ইংরেজি যারা পড়ছে এরা অবশ্য কেউই সাহিত্যের জন্য ইংরেজি নয়, ইংরেজি পড়ছে শুধুমাত্র চাকরির জন্য । দেশিভাষা বিদ্যায় যে এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না । মাতৃভাষা জ্ঞানে চাকরি হচ্ছে না, এ ভাষায় অন্নসংস্থান হচ্ছে না ।

এজন্য তিনি সরকারকেই দায়ী করেছেন । পৃথিবীর অগ্রসর দেশগুলোতে নিজস্ব ভাষাতে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে, আমাদের উপমহাদেশে কেন হবে না? মাতৃভাষার সুযোগ উন্মুক্ত না করলে কেবলমাত্র ভালোবাসা আর আবেগ দিয়ে তাকে রক্ষা করা যাবে না, আমাদের মায়েরা বলতেই থাকবেন, ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’। ঠিক জায়গায়টাই স্পর্শ করেছেন পবিত্রবাবু, সরকার যদি মাতৃভাষার সামনে সম্ভাবনা উন্মুক্ত না করেন তবে  ‘কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে? / বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে ? ’

১৫ তারিখ রবিবার সকাল এগারোটায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দেবাশিস ভট্টাচার্য উদ্বোধন করেন ‘বানান কর্মশালা’। দেওয়ালে সুদৃশ্য ভাষা বিষয়ক পোস্টার, রেখাচিত্র এবং ছাড়া দিয়ে সাজানো বঙ্গভবন কনফারেন্স হলে লেখক, শিল্পী, অধ্যাপক, গণমাধ্যমের কর্মী, গবেষক, ছাত্র, শিক্ষক ছাড়াও ভাষাপ্রেমী উৎসাহীদের ভিড়। ভাষা নিয়ে সত্যিই এ এক অভূতপূর্ব ভালোবাসার নিদর্শন। দিনভর এ কর্মশালায় পবিত্র সরকার মহাশয় সরস ভঙ্গিতে উৎসাহী শিক্ষার্থীর কাছে নীরস ভাষা ও বানানের বিভিন্ন সমস্যা ও এ থেকে উত্তরণের নানা দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবার উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব, কূট রাজনীতি অপর দিকে মাতৃভাষার প্রতি সার্বিক উদাসীনতার এ মুহূর্তে শুধুমাত্র শুদ্ধ বানানের সুলুক সন্ধানী উৎসাহীদের ভিড় সামলাতে বিব্রত বঙ্গভবনের কর্মকর্তারা উচ্ছ্বাস কন্ঠে নিয়ে বললেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বারবার পড়তেও আমরা পিছপা হব না।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!