Advertisement
  • এই মুহূর্তে বি। দে । শ
  • ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫

গাজা দখল নেবে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনিদের ‘স্বেচ্ছায়’ উপত্যকা ছাড়বার নির্দেশ ইজরায়েলের

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
গাজা দখল নেবে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনিদের ‘স্বেচ্ছায়’ উপত্যকা ছাড়বার নির্দেশ ইজরায়েলের

ফিলিস্তিনিরা চাইলে ‘স্বেচ্ছায়’ গাজা ছাড়তে পারেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীকে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাতজ, বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষাবাহিনীকে এই নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুসালেম পোস্টের প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

গাজার বাসিন্দারা যাতে ‘স্বেচ্ছায়’ চলে যায় সে জন্য সেনাবাহিনীকে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন ইজরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাতজ। ৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীকে এই নির্দেশ দেন তিনি। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এমন একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে গাজার বাসিন্দাদের ‘স্বেচ্ছায়’ গাজা উপত্যকা ত্যাগের সুযোগ পাবে। এমন এক সময়ে এই খবর সামনে আসছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা ‘দখল করে’ এর ‘মালিক’ হয়ে পুনর্গঠনের কথা বলেছেন। গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এতে অন্যায়ের কিছু নেই বলেও মনে করেন তিনি।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘হামাস গাজার বাসিন্দাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, মানবিক সহায়তা নিজেদের স্বার্থে আত্মসাৎ করেছে এবং গাজাবাসীদের বের হতে দেয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের মুক্তভাবে বের হওয়ার ও অভিবাসনের সুযোগ পাওয়া উচিত, যেমনটি বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের গ্রহণ করা বিভিন্ন দেশের দায়িত্ব। স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে এবং অন্যান্য দেশ — যারা গাজায় ইসরায়েলের কার্যক্রম নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ ও রক্তচোষা অপবাদ দিয়েছে, তারা আইনগতভাবে বাধ্য যে তারা গাজার যে কোনো বাসিন্দাকে তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি দেবে।’ উল্লিখিত দেশগুলোকে সমালোচনা করে কাতজ বলেন , ‘যদি তারা তা না করে, তবে তাঁদের সমস্ত ভণ্ডামি প্রকাশ হয়ে যাবে। কানাডার মতো কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে কাঠামোবদ্ধ অভিবাসন ব্যবস্থা রয়েছে, তাঁরা আগেও গাজার বাসিন্দাদের নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।’ ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুসালেম পোস্ট প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গাজাবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনটি সম্ভাব্য এলাকা বিবেচনা করছে। এলাকাগুলো হলো—মরক্কো এবং সোমালিয়ার পুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ড। এই তিনটি অঞ্চলের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো, এগুলো মার্কিন সমর্থনের জন্য যথেষ্ট নির্ভরশীল। সোমালিল্যান্ড ও পুন্টল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে সোমালিয়া থেকে স্বাধীন হয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে মরক্কো পশ্চিম সাহারায় নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা চায়।
 

ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনা…

 
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন , গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসন করার পর যুক্তরাষ্ট্র এই ভূখণ্ডের ‘দখল নেবে’ এবং ‘মালিক হবে’। গাজার জন্য এক ব্যতিক্রমী পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়ে দাবি করেছেন, গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরায়’ এ পরিণত করা হবে।

হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, তাঁর প্রশাসন গাজায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্ব দেবে, যা এই অঞ্চলের জনগণের জন্য ‘অসীম সংখ্যক চাকরি ও বাসস্থান’ নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার দখল নেবে এবং সেখানে আমরা কাজ করব। আমরা মালিক হব।’ তিনি আরও জানান, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন পরিষ্কার করা এবং বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র অপসারণের দায়িত্ব তাঁর প্রশাসন নেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজার ওপর দীর্ঘমেয়াদি মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবে। এটি হালকাভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই এই ধারণাকে পছন্দ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই জমির মালিক হবে, এটিকে পুনর্নির্মাণ করবে এবং হাজারো চাকরি তৈরি করবে। বিষয়টি অসাধারণ কিছু হবে।’

আর এ লক্ষ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, গাজাবাসীদের একটা বড় অংশকে জর্ডান ও মিসরকে গ্রহণ করতে বলবেন তিনি। তবে আম্মান এবং কায়রো তাঁর বক্তব্যের পরপরই এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। তারপরই গাজার ফিলিস্তিনিদের মরক্কো ও সোমালিয়ায় স্থানান্তরের পরিকল্পনার বিষয়টি সামনে এল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রসঙ্গে মুখ খোলেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘আসল ব্যাপারটি হলো যেসব বাসিন্দা গাজা ছাড়তে চান, তাদের যেতে দেয়া। এটাতে অন্যায় কী হচ্ছে? তারা যেতে পারেন, আবার ফিরেও আসতে পারেন। তারা অন্য জায়গায় পুনর্বাসিত হতে পারেন, আবার ফিরে আসতে পারেন। তবে গাজাকে পুনর্গঠন করতে হবে।’

ট্রাম্প এর আগে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি কখনোই কার্যকর হয়নি। তিনি বলেন, ‘গাজার ব্যাপারটা কখনোই কাজ করেনি। আমি গাজার বিষয়ে অনেকের থেকে আলাদাভাবে ভাবি। আমি মনে করি, তাঁদের ভালো, নতুন, সুন্দর একটি জায়গা পাওয়া উচিত। আমরা কিছু লোককে অর্থায়নে যুক্ত করব, জায়গাটা গড়ে তুলব, বাসযোগ্য ও উপভোগ্য করে তুলব।’

ওয়াশিংটনের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিশ্বশক্তি রাশিয়া, চীন ও জার্মানি তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, ‘এর ফলে ফিলিস্তিনিতে নতুন করে দুর্ভোগ আর ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হবে।’ সৌদি আরবও এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, যিনি আগামী সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সাথে দেখা করবেন, বুধবার বলেছেন যে, তিনি ভূমি অধিগ্রহণ এবং ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই পরিকল্পনা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে যে গাজার ভবিষ্যৎ ‘কূটনৈতিক আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া উচিত, একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়।’
 

আমি অন্য কোথাও যাব না… আমি এই দেশেতেই থাকব

 
ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপত্যকার বাসিন্দারা। নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে না যাওয়ার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। ইজরায়েল-হামাসের ১৫ মাসের গাজা যুদ্ধে ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন লক্ষাধিক। ইজরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। টানা ১৫ মাস ধরে বোমা হামলায় উপকূলীয় ছিটমহলের হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলসহ গাজার ৬০ শতাংশের বেশি অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনের অধীন ওয়াশিংটন ছিল ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক। তারা যুদ্ধের প্রথম বছরে নেতেনায়াহুকে ১ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে, যা দেশটিকে এযাবৎকালে দেওয়া সর্বোচ্চ বার্ষিক সহায়তা।

৫২ বছর বয়সী আবু ফিরাস গাজার বাসিন্দা। তিনি এখন থাকছেন উপত্যকার উপকূল এলাকার একটি তাঁবুতে। তাঁর বসতবাড়ি খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলে। ইসরায়েলি হামলায় তাঁর বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধে তিনি ৮০ জন আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছেন। বাড়িঘর পুনর্নির্মাণে সাহায্য চান ফিরাস। কিন্তু তিনি গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমরা মরব, তা–ও এই ভূমি ছেড়ে যাব না।’ মাতৃভূমির বিনিময় অর্থ দিয়ে হয় না।’ গাজাকে দুর্ভাগ্য, মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ট্রাম্প। তাঁদের দাবি, এই জায়গা ছেড়ে যেতে আগ্রহী ফিলিস্তিনিরা। তবে গাজাবাসী ট্রাম্পের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধের আগেও গাজাবাসীর জীবন কঠিন ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি গাজা। ইজরায়েলি অবরোধ, হামাসের কঠোর শাসন, অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্য দিয়ে বছরের বছর বছর কাটিয়ে এসেছেন গাজাবাসী। তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও গাজাবাসী উপত্যকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করে এসেছেন। ৫০ বছর বয়সী রামজ, গাজার বাসিন্দা।, চার সন্তানের পিতা। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি যেখানেই চলে যান না কেন কিংবা সুন্দর শহরে বসবাসের যতই চেষ্টা করুক না কেন, নিজ শহর, নিজ ভূমি ছাড়া তিনি কখনোই শান্তি পা বেন না। এত ধ্বংসের পরও আমরা শেষ পর্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে ও মরতে এখানে, আমাদের ভূমিতেই থাকব।’

লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন ৭২ বছর বয়সী ফাতি আবু আল-সাঈদ। খান ইউনিসের আল-কাতিবা মহল্লায় ধ্বংসস্তূপে একাকার হয়ে যাওয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গত ১৯ জানুয়ারি ইজরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজার উপকূলীয় আল-মাওয়াসি এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় খান ইউনিসে পুনরাই ফেরেন তিনি। তারপর থেকে এভাবে হাঁটা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যেস। ভয়াবহ বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপের ওপর সাবধানে পা ফেলে হাতের লাঠি উঁচিয়ে বিধ্বস্ত একটি বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করলেন সাঈদ। বললেন, ‘আপনি কি ওই মূল্যহীন ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাচ্ছেন? ওটা যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ভেতরে থাকা সবকিছুর চেয়ে বেশি মূল্যবান। গণহত্যার মধ্যেও আমরা অন্য জায়গায় চলে যাইনি, এ কারণে নয় যে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কারণ এটি আমাদের জন্মভূমি। আমাদের জমি। এখানকার প্রতিটি ইট আমাদের কাছে যত মূল্যবান, তত মূল্যবান কিছুই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দিতে পারবে না’।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!