- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- অক্টোবর ১, ২০২৩
কেবল সম্পাদক নন
বরাক-উপত্যকার কাব্য-আন্দোলনে তিনি আগাগোড়াই পুরোধা-পুরুষ, কেবল তাঁর কবি-প্রতিভার গুণে নয়, তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণে

অসমের প্রত্যন্ত জেলার একটি ছোট শহরে আজীবন বাস করা সত্ত্বেও বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের পরিচিতি যেভাবে সমস্ত ভৌগলিক দূরত্ব অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালির কাছে, তা এক নিরলস জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি। এই সংগ্রাম আত্ম-প্রচারের প্রলোভনকে সরিয়ে রেখে ব্যাপৃত থেকেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালির আত্ম-পরিচয়টিকে শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কাজে। মূলত কবি বলে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর মমতার । আর কে না জানে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালির আত্ম-পরিচয়ের প্রশ্নটি ভাষা-সংগ্রামের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ ?
তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁকে যেমন দিয়েছে রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, তেমনি কবি বলেই তিনি জানতেন তাঁর কাজের ক্ষেত্রটি রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে ভিন্ন। বরাক-উপত্যকার কাব্য-আন্দোলনে তিনি আগাগোড়াই পুরোধা-পুরুষ, কেবল তাঁর কবি-প্রতিভার গুণে নয়, তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণে। শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, উদয়ন ঘোষ, ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ প্রমুখ, প্রতিভাবান কবিরা তাঁর সহযোগী, কিন্তু তরুণ কবিদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কৃতিত্ব প্রধানত বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের। ১৯৬৬ সালে হাইলাকান্দি এসএস কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার পরের বছরেই তাঁর সম্পাদনায় ‘সাহিত্য’ নামের লিটল ম্যাগাজিনটির যাত্রা শুরু। তাঁর মৃত্যুর আগে পত্রিকাটির একশো ষাট তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে এটি সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রায় অখ্যাত একটি শহর থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাটি যেভাবে পৌঁছে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা কবি-সাহিত্যিকেরা যেভাবে নিজেদের এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করেছেন, তা যে কোনো সম্পাদককে গর্বিত করবে।
বিজিৎবাবুর মহত্তর দিকটি হল এই যে, তিনি একে কখনো নিজের একক সাফল্য হিসাবে দেখেননি। বরাক উপত্যকায় তথা উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালি কবির অভাব কখনো ছিল না। কিন্তু কলকাতা-কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে মফস্বল কবিদের আত্ম-প্রকাশের সুযোগ ছিল কম। ওই সময়ে কলকাতায়, প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন একদল তরুণ কবি। সেই কৃত্তিবাসীদের সঙ্গে স্বাভাবিক সখ্য গড়ে উঠল বিজিৎবাবুদের। তারই ফলে ঈশান বাংলার কবিদের নিয়ে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত গ্রন্থ ‘এই আলো হাওয়া রৌদ্রে’ প্রকাশ করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আরো কয়েক বছর পর এই বই-এর পরিবর্ধিত সংস্করণ বেরোল বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যৌথ সম্পাদনায়।
এই প্রসঙ্গে যে কথাটি বলা খুবই জরুরি, তা হল কলকাতার সংযোগটিকে কাজে লাগিয়ে নাগরিক বৃত্তে নিজের আসনটি পাকা করে নিতে পারতেন তিনি। আরও পাঁচটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের মতো ‘সাহিত্য’-কে উল্লম্ফনের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি । কারণ নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর অসাধ্য ছিল। তাই ‘সাহিত্য’ বিজ্ঞাপনের আয়ের লোভকে বর্জন করে নির্ভেজাল সাহিত্যের কাগজ হিসাবে টিঁকে রইল নামমাত্র সদস্য-চাঁদার জোরে, অথচ প্রতিটি লেখকের কাছে নিয়মিতভাবে সৌজন্য সংখ্যাটি পৌঁছে গেছে। প্রথমে কবিতা ও কবিতা-বিষয়ক গদ্যের কাগজ হিসাবে আত্ম-প্রকাশ করলেও পরে ‘সাহিত্য’তে স্থান পেয়েছে ছোটগল্প, বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, উপন্যাস।
উত্তর-পূর্বের, বিশেষতঃ বরাক-উপত্যকার, কবিদের আত্ম-প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি বলিষ্ঠ মতামত প্রকাশের বাহনও হয়ে উঠেছিল ‘সাহিত্য’ পত্রিকা। বুদ্ধিদীপ্ত ঝরঝরে গদ্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে লেখা সম্পাদকীয়গুলি এ পত্রিকার সম্পদ। কবিতা লেখা ও পত্রিকা-সম্পাদনার পাশাপাশি জনসাধারণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কখনো আসাম সরকারের আগ্রাসী ভাষানীতির বিরুদ্ধে, আবার কখনো ব্রডগেজ রেল লাইনের দাবিতে তাঁকে পথে নেমে সংগ্রাম করতে দেখেছি আমরা। আসলে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। তাঁকে কেন্দ্র করে বরাক-উপত্যকার তরুণ কবি-সাহিত্যিকেরা আত্ম-মর্যাদার যে পরিসরটি লাভ করেছেন, সেটিকে গর্বের সঙ্গে রক্ষা করে যাওয়াই হবে তাঁদের আগামী দিনের প্রধান দায়িত্ব।
♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক পরিচিতি: কবি। বরাকের উনিশের সন্তান
❤ Support Us