Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪

কোথাকার তরবারি, কোথায় রেখেছে ?

ড. ইউনূস বলছেন : অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তিনটি শূন্য ( থ্রি জিরো ) তাঁর লক্ষ্য। বেকারত্ব শূন্যে আনা, দূষণ শূন্যে আনা এবং সম্পদ শূন্যে আনা। তবে কার সম্পদ শূন্য নিয়ে আসতে হবে, তা পরিষ্কার নয়

কানাইলাল জানা
কোথাকার তরবারি, কোথায় রেখেছে ?

 
বাংলাদেশের ড. মহম্মদ ইউনূস সম্পর্কে আমাদের ধারণা বহুমাত্রিক। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন, মনে হয়েছিল বাহ আর এক বাঙালির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, গর্বের বিষয়। যখন জানলাম, তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কাজ করে ( মাইক্রো ফাইন্যান্স) শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, তখন মনে এল শক্তিদার কাব্যগ্রন্থ: ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছ?’ গত সেপ্টেম্বরের গোড়ায় আমি খুলনায়, তখন বাংলাদেশের টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ড. ইউনূস বলছেন : অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তিনটি শূন্য ( থ্রি জিরো ) তাঁর লক্ষ্য। বেকারত্ব শূন্যে আনা, দূষণ শূন্যে আনা এবং সম্পদ শূন্যে আনা। তবে কার সম্পদ শূন্য নিয়ে আসতে হবে, তা পরিষ্কার নয়। তাঁর নিজের কোনও সম্পদ নেই বলে শুনেছি। ব্যাঙ্কে বিপুল পরিমাণ যে সুদ আসে তা খরচ করা হয় ট্রাস্টের মাধ্যমে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তখন দেখাচ্ছে সেদিন কোন্ কোন্ আওয়ামী লীগ নেতা/ মন্ত্রী / সাংসদ গ্রেফতার হয়েছেন। বাড়ি ফিরে দেখছি, বাংলাদেশের বহুজন সেইসময় মহম্মদ আলী জিন্নার জন্মদিন পালন করছেন মহা সমারোহে। আবার উর্দু ভাষার প্রচলন চাইছেন। তখন প্রশ্ন জাগে কী চাইছেন ড. ইউনূস ? এখন শেখ হাসিনাকে ফেরৎ চাইছেন। শান্তির পুরস্কার প্রাপকের রাজত্বে এত যে অশান্তি, তা বোঝার উপায় নেই। যে কটা জেলা ঘুরেছি, সে সময় খুব শান্ত মায়া মাখা পরিবেশ। বন্ধুপ্রতিম কারাধ্যক্ষ রফিকুল কাদের আবুল বাশার আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন, এজন্য বরাদ্দ ২৪ ঘন্টা ।
 

আরব আক্রমণ প্রথমে হয়েছিল সিন্ধু প্রদেশে, এত রাজ্য পেরিয়ে বাংলাদেশে কেন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ ? তার একটা কারণ খান জাহান। ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বকতিয়ার খিলজির আক্রমণে বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে গেলে বাংলায় আরব শাসনের গোড়াপত্তন হয়, কিন্তু তিনি পরে মহাপরাক্রমশালী কামরূপের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। বলাবাহুল্য এরও বহু আগে, অষ্টম শতাব্দী থেকে বাংলায় এসেছিলেন পীর সুফি সাধক আউলিয়ার, তার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে মালদা ও দুই দিনাজপুরে।

 
চারপাশে বড়ো বড়ো প্রশস্ত রাস্তা। সবথেকে বড়ো রাস্তাটির নাম খান জাহান আলী সরণি। তাঁর নামে রাস্তা, ব্রিজ লাইব্রেরি গবেষণাগার, বাগিচা, স্মৃতিসৌধ রয়েছে এই এলাকায়। দুই, তিন বা চার রাস্তার মোড়ে প্রচন্ড ভিড়েও কোথাও ট্রাফিক পুলিশ নেই। বাশারকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘ স্যর, দ্যাশ এখন স্বাধীন ! ট্রাফিক আছে আশপাশে, নতুন বলে মুখ দেখাচ্ছে না।’ খুলনার এসপি বদলেছে। খাঁ খাঁ করছে অফিস চত্বর, জয়েন করেননি এখনও। বাশার প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা দুজনেরই ভক্ত। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ ছন্নছাড়া। কারাধ্যক্ষের মোবাইলে প্রস্তাব এল জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তনে মত আছে কিনা, বন্ধুবর আচ্ছা করে শুনিয়ে দিলেন প্রশ্নকর্তাকে। বাংলাদেশের এদিকটা আরও বেশি নদীমাতৃক। কত রকমের যে সুদৃশ্য জলযান অনবরত ছুটছে রূপসার খরস্রোতে, পারাপার করছে শুধু মানুষ নয়, পশু, মালপত্র, নানা যানবাহন এবং কী নয় ?  পারাপার করেছি আমিও।
 

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে যশোর বাগেরহাট, পটুয়াখালী, খুলনা অঞ্চলে ৩৬০ দিঘি ৩৬০ টি মসজিদ, অসংখ্য সরাইখানা, বাগিচা ইত্যাদি তৈরি করেছেন। প্রয়োজনে যুদ্ধ চালিয়ে খানজাহান একাই ভালো এবং মন্দ দুটো কাজই করেছেন সমান তালে। যা ইতিহাস ভোলেনি, ভুলে থাকতে পারে না

 
অনেক আগেই প্রশ্ন জেগেছিল। আরব আক্রমণ প্রথমে হয়েছিল সিন্ধু প্রদেশে, এত রাজ্য পেরিয়ে বাংলাদেশে কেন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ ? তার একটা কারণ এই খান জাহান। ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বকতিয়ার খিলজির আক্রমণে বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে গেলে বাংলায় আরব শাসনের গোড়াপত্তন হয়, কিন্তু তিনি পরে মহাপরাক্রমশালী কামরূপের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। বলাবাহুল্য এরও বহু আগে, অষ্টম শতাব্দী থেকে বাংলায় এসেছিলেন পীর সুফি সাধক আউলিয়ার, তার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে মালদা ও দুই দিনাজপুরে।
 
খান জাহান আলী ছিলেন দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলকের প্রিয়পাত্র এবং তাঁর সেনাপতিদের একজন। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে যশোর বাগেরহাট, পটুয়াখালী, খুলনা অঞ্চলে ৩৬০ দিঘি ৩৬০ টি মসজিদ, অসংখ্য সরাইখানা, বাগিচা ইত্যাদি তৈরি করেছেন। প্রয়োজনে যুদ্ধ চালিয়ে ভালো এবং মন্দ দুটো কাজই করেছেন সমান তালে। যা ইতিহাস ভোলেনি, ভুলে থাকতে পারে না ।
 
সুন্দরবনের ‘করমজল’, যেতে হবে মংলা বন্দর হয়ে। নতুন করে মংলা বন্দর খুলেছে ২০০৯ সাল থেকে। খুলনা থেকে কিছুদূর যেতেই দেখি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মাছ চাষের প্রয়াস। বিশাল বিশাল ভেড়ি। তারপর শুরু প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ সংস্থা। ‘বসুন্ধরা’ গোষ্ঠী গ্যাস সরবরাহ করে দেশের বাইরেও। আছে কাগজ , তেল কল ও নানা কারখানা। পথে পড়ল বেশ কিছু  নদী যেমন বলেশ্বর, ভোলা, ভদ্রা, শিবসা…। গোটা সুন্দরবন অঞ্চল জুড়েই ঘর ভাঙার কাহিনি। কোন্ নদী যে কার ঘর ভেঙে কোথায় যাবে বলা যায় না। এখানে রূপসাকে ঠেলা মেরে দ্রুত আলাদা হয়েছে পশুর নদী। টানা চলে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। মংলা বন্দর ঘুরে একটি ময়ূরপঙ্খি লঞ্চ ধরে যাই সুন্দরবনের ‘করমজল’।  পশুর নদীর জলে পিঠ দেখিয়ে রোদ পোহাচ্ছে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের দুটি কুমির। শীতকালের তুলনায় করমজলে এখন ভীড় কম। সুন্দরবনে তো সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছ থাকবেই। তবু ভুলি না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অকাট্য উচ্চারণ, পৃথিবীর সবথেকে অসুন্দর বন হচ্ছে সুন্দরবন। কারণ সব গাছই বেঁটে। বেঁটে হলেও দেখতে ভাল লাগে হলুদ পাতা ও ফুলে ভরা কাঁকড়া গাছ। সে গাছ কম, বরং আছে বড়ো দৈর্ঘ্যের পশুর গাছ। বাশারের কথায়, আসবাব তৈরিতে এ কাঠ খুব মূল্যবান । জোয়ারের তোড়ে মাইল মাইল বনাঞ্চলে খাইখাই করে ঢুকে গেছে জল, তাতে অসুবিধা নেই। উঁচু করে কয়েক কিমি ব্রিজ কাম রাস্তা। বানরের সংখ্যা অগুনতি। প্রজনন কেন্দ্রে জন্মাচ্ছে কুমির, হরিণ, বানর, কচ্ছপ ইত্যাদি। বন্দর এলাকায় দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। বাশার দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে খাওয়াচ্ছেন। ইলিশ, গলদা, পাবদা আর কী কী খেতে চাই ? মন ভরে খেলাম সুস্বাদু সব পদ।
 
এবার বাগেরহাট। আছে খানজান আলীর সমাধি, তাঁরই খনন করা মিষ্টি জলের ‘খাঞ্জালি’ দিঘি। তাঁর ছিল দুটি পোষা কুমির: কালা পাহাড় ও ধলা পাহাড়। তাদের নিয়ে বহু গল্প শুনলাম। তারা খান জাহানের এতই অনুগত ছিল যে কালা পাহাড়ের পিঠে চড়ে তিনি জলবিহার করতেন হাসিমুখে। কালা ধলা স্বামী স্ত্রী। প্রজনন ঘটিয়ে মিষ্টি জলে লালন পালন করা হতো প্রচুর কুমির। কালা পাহাড়কে স্টাফ করে রাখা আছে বাগেরহাট মিউজিয়ামে।
 

সমাধির মাঠে চৈত্রমাসে বসত এক মাস জুড়ে সামাজিক মেলা, যেখান থেকে বহু মানুষ সংগ্রহ করতে তাল পাতার পাখা। বাগেরহাট  মিউজিয়ামের কাছেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সবথেকে বড় প্রার্থনালয়, ষাট গম্বুজ মসজিদ। যে যার মতো করে নমাজ পড়ে চলে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে মিউজিয়ামে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে আমি অবাক।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!