Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪

জীবন গড়ার অন্যরকম কারিগর

মইনুল হাসান
জীবন গড়ার অন্যরকম কারিগর

 
সরাসরি অমিয় বাবু’র কাছে আমি পড়িনি। তাঁর গবেষণা আর অধ্যাপনার বিষয় আমার নয়। তবু বহুবছর তাঁকে মাষ্টার মশাই জ্ঞান করেছি।অন্যান্য অনেকের মত তাঁকে ‘আমিয়দা’ বলতে পারিনি। ‘স্যর’ বলে এসেছি। অবশ্য যশোধরা বাগচীকে অবলীলাক্রমে রত্নাদি বলে ডেকেছি। আপাত গম্ভীর মানুষটিকে খুব সহজ সরল ভাবে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আমার একটা আত্মীয়তাবোধ কাজ করত। আমিয় বাবু’র ও বোধ হয় তা ছিল। নইলে আমার জীবনের নানা জটিল সময়ে তিনি বার বার আমার কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে আসবেন কেন ?
 
বহরমপুর শহর থেকে ভাগীরথী পেরিয়ে মাত্র ৬/৭ কিমি রাস্তার মামায় কর্ণসুবর্ণ। রাজা শশাঙ্কের একসময়ের রাজধানী। তারই পাশে যদুপুর গ্রাম। সেখানে জন্মেছেন অমিয় কুমার বাগচী। বহরমপুর শহরেও তাদের বাড়ি আছে। মোল্লাগেড়ের ধারে। সেটা আমার শ্বশুর বাড়ি লাগোয়া। সে সুত্রে আমি তাঁর পাড়াতুতো জামাই। এটা আমার নয়, আমিয়বাবু’র ই কথা। আমার স্ত্রী মল্লিকাকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। তাহলে সম্পর্কটা কী দাঁড়ালো ? সহজে তা অনুমেয়। বোধহয় আত্মীয়ভাব বোধটা প্রথমে এখান থেকেই এসেছে। তাছাড়া তাঁর অধীনে ছাত্রের মতে অনেক কাজে যুক্ত থেকেছি। সেগুলো মুলত লেখাপড়ার কাজ। বিশ্বব্যাপী মননজগতে যে সীমাহীন সঙ্কট দেখা যাচ্ছে সে ব্যাপারে একাত্ম বোধ করেছি। আত্মীয়তার বন্ধন আলগা হয়নি।
 
বহুরমপুর শহরের কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে পড়েছেন। তারপর প্রেসিডেন্সি। ১৯৬০-র দশকে প্রেসীডেন্সি কলেজে পড়াতে শুরু করেন। তারপর কেমব্রিজে যান। ১৯৬৯ সালে আবার দেশে ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্সিতে আবার শিক্ষকতা শুরু। ১৯৭৪ সালে তৈরি হয় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা। যাকে সংক্ষেপে আমরা ‘সেন্টার’ বলি। সেখানেই গবেষণা ও শিক্ষার কাজে যোগ দিলেন। তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতির শিক্ষক। আমরা রাজনৈতিক কর্মী। আমাদের অর্থনীতির হালচাল বুঝতেই হয়। সেটা কেবল বাজারদর জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হয় না। একটু গভীরে যেতেই হয়। সে ক্ষেত্রে অধ্যাপক অমিয় বাগচী একটা বাতিঘর ছিলেন। সমসাময়িক পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলতেন সম্রাজ্যবাদকে প্রতিরোধ করার অন্যতম উপায় হল গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের সজাগ ঐক্য ও সংগ্রাম। দেশীয় রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এক্ষেত্রে খুব বেশি বিচার্য নয়। সব কিছুর উর্ধ্বে আন্তর্জাতিক বোধে নিজেদের ভাবনাচিন্তাকে প্রসারিত করতে হবে, অধ্যাপক বাগচী তার ছাত্রদের এ শিক্ষা দিয়েছেন বরাবর। আর একটা বিষয়ে তিনি খুবই সফল, কেবল শুকনো, বই এর পাতায় লেখা অর্থনীতির তত্ত্বের মধ্যে নিজেকে অর্গলবন্ধ রাখেননি। সাধারণ মানুষ, সমাজকর্মী, এমনকি রিকশাভ্যান চালকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। জীবনের পাঠ যেমন তিনি সেখান থেকে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনই তাঁর গৃহীত অর্থনীতির পাঠকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
 

দিল্লির দরিয়াগঞ্জের রবিবার সকালে ফুটপাতে বই বাজার বসে । পুরনো বই-এর সম্ভার । সোনার খনি। সেখানেই অমিয় বাবুর বিখ্যাত কাজ স্টেট ব্যাঙ্কের ইতিহাস সংক্রান্ত বই-এর খন্ডগুলি দেখি । পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত ওজনদরে তা কিনেও ফেলি । সময় নিয়ে তা পড়ে ফেলি । একদিন এক আড্ডায় তাঁকে সামনে পেয়ে বললাম তাঁর গবেষণা কর্ম পড়ার কথ । যখন শুনলেন, আমি বইগুলো দরিয়াগঞ্জের ফুটপাতে কিনেছি, তখন প্রায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন

 
জীবনভর অসাধারণ সব গবেষণামূলক কাজ করেছেন। ২০০ টি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন। তাঁর একটা যুগান্তকারী কাজ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’র ইতিহাস ও কার্যকারিতা নিয়ে। ভারতের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ও আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ স্টেট ব্যাঙ্কের ঐতিহাসিক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। একটি অসাধারণ মহাফেজখানা তৈরি করে গেছেন। এ কাজ সর্ম্পকে আমার আগ্রহ প্রবল। অমিয়বাবুর যাঁরা সরাসরি ছাত্র, তাঁদের অনেকেই আমার মাস্টারমশাই। কলেজে পড়াকালে এসব কথা তাঁদের কাছে শুনি। তার মধ্যে একজন অধ্যাপক প্রাণতোষ সেন। অধ্যাপক মনোজ সান্যাল, অধ্যাপক জয়ন্ত আচার্য। এঁরা সবাই আমার অতি ঘনিষ্ট এবং আমি তাঁদের প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম। অমিয়বাবু সম্পর্কে একটা সশ্রদ্ধ ধারণা তাঁরা আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তখন নিয়মিত দিল্লিতে থাকি। দিল্লির দরিয়াগঞ্জের রবিবার সকালে ফুটপাতে বই বাজার বসে। এক রবিবারে আমি সেখানে হাজির। পুরনো বই-এর সম্ভার। সোনার খনি। কী নেই ? সেখানেই অমিয় বাবুর বিখ্যাত কাজ স্টেট ব্যাঙ্কের ইতিহাস সংক্রান্ত বই-এর খন্ডগুলি দেখি। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত ওজনদরে তা কিনেও ফেলি। আমি নিজে চাকরি না করেও ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। নীতিনির্ধারণের কাজে তো বটেই। সময় নিয়ে তা পড়ে ফেলি। একজনের বাড়ির আড্ডায় অমিয়বাবু ছিলেন। আমিও উপস্থিত। কফি সহযোগে সান্ধ্য আসর। শীতের সন্ধ্যা। কী যে মাথায় পোকা ঢুকল। তাঁকে বললাম, আপনার গবেষণা কর্ম পড়ার কথা, তিনি শুনে অবাক। যখন শুনলেন, আমি বইগুলো দরিয়াগঞ্জের ফুটপাতে কিনেছি, তখন প্রায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আজও আমার বহরমপুরের লাইব্রেরিতে সেগুলো সংরক্ষিত আছে।
 
তখনও অমর্ত্য সেন নোবেল পাননি। কার্ল মার্কসের মৃত্যু শতবর্ষে দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখলেন ‘মার্ক্স আফটার হান্ড্রেড ইয়ারস্।’ পড়ে আমি মুগ্ধ ও ঋদ্ধ। অধ্যাপক জয়ন্ত আচার্য আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমার অগ্রজ। দুজনে একসঙ্গেই প্রবন্ধটি পড়ি এবং হঠাৎ ঠিক করি অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দেখা করতে বোলপুর যাব। তিনি তখন বোলপুরে। বহরমপুর থেকে বাসে চড়ে রওনা দিলাম। এত নিরাপত্তার বাড়বাড়ি তখন ছিল না। ছাত্ররা মাস্টারমশাই’র সঙ্গে দেখা করবে এটাই যথেষ্ট। ওখানেই জানার সুযোগ হলো, অমিয়বাবু সপরিবারে শান্তিনিকেতনে এসেছেন, অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দেখা করতে। আমরা তাঁর দেশের লোক। নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাড়ি যাবার জন্য। সে সময়ে, সব কিছুতে রাজি হওয়া ছিল দস্তুর। অমিয়বাবু একবারও ভাবেননি যে, আলটপকা মানুষকে বাড়িতে নিয়ে গেলে কীরকম অসুবিধা হয়। কিছুই হল না। রত্নাদি হাসি- মুখে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন– একটু পরে আমরা খেতে বসবো। বুঝলাম নতুন করে ভাত করতে হচ্ছে। পরে যতবার রত্নাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে শান্তিনিকেতনের সে দুপুরের কথা উঠে এসেছে। বার বার বলেছেন, তোমাদের স্যরের কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। মিটমিট করে হাসতেন অমিয়বাবু। বলতেন– ওরা আমার দেশের লোক। ওদের ফেলে আসব কী করে। এই যে বোধ, সেটা তো আত্মীয়তা। কেউ কেউ বলেন এটা এক ধরনের গ্রাম্যতা। আমরা সে গ্রাম্যতাকে মাথায় তুলে রেখেছি।
 
অমিয় বাবু’র কয়েকটি ভাষণের কথা বলব। প্রথমটা অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রসদনে তাঁকে একটা সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। অমর্ত্য সেখানে ভাষণ দিলেন।তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্য, রাজ্যের বহু গণ্য মান্য বরেণ্য মানুষ হলে উপস্থিত। মঞ্চে দুজন শিক্ষক অমর্ত্য সেন এবং অমিয় বাগচী। প্রথমে অমিয় বাগচী অধ্যাপক সেনের গবেষনামুলক কাজগুলির নির্মোহ পর্যালোচনা করলেন। সেই ভাষণ এখনও আমার কানে লেগে আছ । তাঁর ওই ভাষন দুসংখ্যায় ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা তো যে কোন ব্যাপারে ঠাট্টা ইয়ার্কি করার মাস্টার আর আমাদের ‘লেগপুলিং’-এর শিকার হননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। অমিয় বাবুই বা বাদ যাবেন কেন ? এক ভরা আড্ডায় বলেছিলাম– ‘স্যর, আপনার ওই ‘মেড ইজি’ টাই অমর্ত্য সেনকে বুঝতে যথেষ্ট। ওই যে বলে না, ঠাকুর তোমার কে চিনতো ? যদি না লিখত অচিন্ত্য।’ স্যর, হাসতেন।
 

গল্পবলার ভঙ্গিতে, স্কুল-কলেজ থেকে কেমব্রিজ পর্যন্ত, গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকরা, তাঁর জীবনে কীরকম প্রভাব ফেলেছে, তাঁরই বর্ণনা। শুনতে শুনতে আমরা অভিভূত। পরেও অনেককে তাঁর এমন ভাষণের কথা বলেছি। আমার তখনই মনে হয়েছিল, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া, বাধা ধরা ছকের বাইরে হৃদয় থেকে কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে

 
রাজ্যের সাধারণ গ্রন্থাগারের কর্মীদের একটা রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল বহরমপুরে। অমিয় বাবু সম্মেলনের উদ্বোধক। কেমন করে জানি না, আমি সেখানে প্রধান অতিথি। উদ্যোক্তাদের হুঁশজ্ঞানের উপর আমার একেবারেই ভরসা হল না। অনুষ্ঠানটি শুরু হল দেরিতে। অমিয় বাবু বললেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরতে হবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক তাঁর সামনে আমাকে আমার ভাষণটা দিতে হবে না। আবার কখন পড়া ধরবেন, তার ঠিক নেই। অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু হওয়ায় তাঁর স্কুল জীবন, বহরমপুরের কলেজে পড়া ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা শুনেছিলাম। তিনি সেদিন গল্প বলার মেজাজে ছিলেন। গ্রন্থগারিকদের সামনে, ভাষণ বললেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা।জানালেন, মৃদুস্বরে গল্পবলার ভঙ্গিতে, স্কুল-কলেজ থেকে কেমব্রিজ পর্যন্ত, গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকরা, তাঁর জীবনে কীরকম প্রভাব ফেলেছে, তাঁরই বর্ণনা। শুনতে শুনতে আমরা অভিভূত। পরেও অনেককে তাঁর এমন ভাষণের কথা বলেছি। আমার তখনই মনে হয়েছিল, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া, বাধা ধরা ছকের বাইরে হৃদয় থেকে কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে। এই ছিলেন অমিয় বাবু। আমাদের স্যর। তাঁর মৃত্যুতে, ব্রিজের তলার শূণ্যতা আরও ভারি হয়ে উঠলো ।
 

♦–♦♦–♦♦–♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!