- দে । শ
- নভেম্বর ২৬, ২০২৪
১২৫ তম জন্মদিবসে দেশের সবাক চলচ্চিত্রের পথিকৃতের ভিটেয় বসল আবক্ষ মূর্তি

নির্বাক থেকে সবাক চলচ্চিত্রে উত্তরণ। চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের প্রবর্তন। কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। এইসব প্রযুক্তির সৌজন্যে এ দেশের চলচ্চিত্র ‘সাবালক’ হয়েছিল দেবকিকুমার বসুর হাত ধরে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সেই অমর চলচ্চিত্র পরিচালককে মনে রাখে, সেজন্যই তাঁর জন্মভিটেয় বসল তাঁর আবক্ষ মূর্তি। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রামের মাতুলালয়ে জন্ম হয় দেবকিকুমারের। গ্রামের বারোয়ারিতলায় মূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রশিল্পী শুভাশিস মুখার্জি। ছিলেন দেবকিকুমারের নাতি চলচ্চিত্র প্রযোজক দেবাশিস বসু, মূর্তি বসানোর প্রধান উদ্যোক্তা সমাজসেবী প্রণব রায়, বিশিষ্ট সিনেমাটোগ্রাফার প্রেমেন্দবিকাশ চাকি প্রমুখ। আবরণ উন্মোচন করে শুভাশিসবাবু বলেন, ‘প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক দেবকিকুমারের শৈশব কেটেছে যে গ্রামে, সেই গ্রামে আসতে পেরে আমি ধন্য।’ দেবকিকুমারের সন্তান তথা তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবকুমার বসুর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিল্পী শুভাশিসবাবু জানান, ‘সিনেমায় প্রথম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার, প্লে-ব্যাক সিংগার বা কৃত্রিম আলোয় স্যুটিংয়ের সূচনা দেবকিকুমারের হাত ধরেই। তিনিই বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের স্রষ্টা।’ আর দেবকিকুমারের নাতি চলচ্চিত্র প্রযোজক দেবাশিস বসুর প্রতিশ্রুতি, ‘গ্রামে দেবকিকুমারের নামে একটি সংগ্রহশালা তৈরি হবে। এই সংগ্রহশালাকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। গ্রামের মানুষজনই দেখভাল করবেন।’ সেইসঙ্গে ঘোষণা করলেন, তাঁর আগামী কোনও সিনেমার স্যুটিং দাদুর জন্মভিটে অকালপৌষ গ্রামে হবে। গ্রামের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যে বাড়িতে দেবকিকুমার জন্মেছিলেন, সেই বাড়ির অস্তিত্ব আর নেই। লাগোয়া একটি আগাছায় ঢাকা জরাজীর্ণ মন্দির রয়েছে। দেবকিকুমারের পিতৃপুরুষের ভিটে মন্তেশ্বরের কাইগ্রামে। সেখানে রয়েছে বসু পরিবারের জীর্ণ দালানকোঠা। তার সামনে বসানো হয়েছে দেবকিকুমারের আবক্ষ মূর্তি। তবে জন্মদিনে এলাকার কেউই তাঁর মূর্তিতে একটা মালাও পরাননি। মন্তেশ্বরের বাড়িটিও সংস্কার করে সংরক্ষণশালা তৈরির দাবিটিও গ্রাম ও লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের।
উল্লেখ্য যে, ১৯৩২ সালে সবাক যুগের ছবিতে দেবকিকুমারের আত্মপ্রকাশ ‘চণ্ডীদাস’ সিনেমায়। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, অমর মল্লিক, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যরা। সংলাপ, গান, অভিনয়ে দেশের দর্শকরা আপ্লুত হন। এরপর তাঁর ‘সীতা’ সিনেমা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আকর্ষণ কাড়ে। ‘সীতা’ সিনেমাটি ১৯৩৪ সালে ভেনিস ফিল্মোৎসবে প্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসেবে ‘অনারারি ডিপ্লোমা’ পায়। এরপর ১৯৫৯-এ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় তাঁর ‘সাগরসঙ্গমে’ ছবিটি। তবে সবথেকে বেশি চর্চা হয় ১৯৫৪ সালে তৈরি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিটি। নির্বাক ছবি, ল্যান্টার্ন প্রজেক্টরে দেখানো ছবি থেকে সবাক ছবির জার্নিতে সিদ্ধকাম দেবকিকুমার রবীন্দ্রনাথেরও ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে রবি ঠাকুরের কবিতা ‘পূজারিণী’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘অভিসার’ ও ‘পুরাতন ভৃত্য’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘অর্ঘ্য’ ছবি। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, তামিল, উর্দু ও মারাঠি ভাষাতেও ছবি নির্মাণ করেন। দেবকিকুমার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য হিন্দি সিনেমাগুলি হল, পুরাণ ভকত, দুলারী বিবি, রাজারানী মীরা। এগুলি ১৯৩৩ সালে নির্মিত হয়।
শুধু তাই নয়। দেবকিকুমার ছিলেন জাত অভিনেতাও। ১৯২৯ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দেবকিকুমারের চিত্রনাট্য নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথের প্রযোজনা ‘পঞ্চশর’ সিনেমায় ৫ নায়কের একজন ছিলেন দেবকিকুমার। তাঁর অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল মৃণাল। ১৯৩১ সালে নির্বাক ছবি ‘অপরাধী’ করার পর দেবকিকুমার সিনেমা-রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সবিতা বসুরা অভিনয় করেন। তাঁর পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘নিশির ডাক’ও তারিফ কুড়োয়। জন্মের মত দেবকিকুমারের মৃত্যুর মাসও নভেম্বর। চলচ্চিত্রের অমূল্য সম্ভার উত্তরসূরি ও গবেষকদের জন্য রেখে ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর প্রয়াত হন দু’বার জাতীয় ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড সম্মানে ভূষিত দেবকিকুমার।
❤ Support Us