Advertisement
  • ব | ই | চ | র্যা
  • জুলাই ১৯, ২০২১

ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রের নজরদারি বাড়ছে: স্লাভোই জিজেক

ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রের নজরদারি বাড়ছে: স্লাভোই জিজেক

স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভোই জিজেকের নতুন গ্রন্থ প্যাণ্ডেমিকের প্রচ্ছদ

কয়েক মাস ধরে, একটা ফিসফাস ক্রমশই গভীর নিম্নচাপ তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারেই ভয়ের উপসাগরেই তা শক্তি হারিয়েছে। অতিমারির ভয়াবহতা কতটা অতি-প্রচারিত? তা প্রতিরোধের নিদান কতটা যথাযথ এবং তার সুযোগে কোনও অপ্রকাশ্য কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে কি না— এ নিয়ে জনভাবনা ক্রমাগত জট পাকিয়েছে। কোবিদবাবুর চরিত্রগঠন ও চরিত্রহনন সংক্রান্ত গবেষণার দ্রুত ক্রমবিবর্তন ও পরস্পরবিরোধিতাও সেই দিশাহীন জটকে আরও ঘোলাটে করেছে।

করোনা অতিমারি নিয়ে সমাজ-মাধ্যমে নানান পোস্টের ছড়াছড়ি। সোশ্যাল পোস্টে সমাজের চিকিৎসকরাও বেশ তৎপর। গত কয়েক মাসের রোগী দেখার অভিজ্ঞতায় তাঁরাও সোশ্যাল দেওয়ালে লিখছেন অনেক কিছু। স্থানীয় ডাক্তারদের পোস্টের মতামতে কিন্তু বিস্তর মিল। পরামর্শ খুব কাছাকাছি। সারাসরি রোগী দেখার অভিজ্ঞতা, তাই সেখানে যে সত্যতা আছে, অনুমেয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রচারের হালে তা কিছুতেই গ্রহন যোগ্যতা পায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনেক পরামর্শই যেখানে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে স্থানীয় চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ উপেক্ষিত হবে, এটাই প্রত্যাশিত! তার বদলে ভয়াবহ স্বর-ভঙ্গিতে বিতর্কিত তথ্য ও পরিসংখ্যান পরিবেশন, নিত্যনতুন নির্দেশিকা জারি করা চলেছেই। ফলে আতঙ্ক এমন যে বাড়ির, পাড়ার, পেশার লোক একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না! ঘরবন্দীত্বের সাথে জুড়ে চলেছে নির্মম সামাজিক(!) নির্বাসন।

চিকিৎসকরা ছাড়াও যে যেখানে সততার সাথে চিন্তা করছেন, তাদের মাঝে আরও কিছু মিল পাওয়া স্বাভাবিক। এই ওয়েব পত্রিকার যুক্তি তক্কো গপ্পো বিভাগে “কোভিডবাবু,  দৌড় আর কতদূর?”  শীর্ষক লেখায় বলা হয়েছিল যে পৃথিবীর মানুষের এক অংশ, যারা রোগে, সুষম খাবারের অভাবে বা অন্য কোন ভাবে জীবনীশক্তি দুর্বল করে ফেলেছেন, তাদের এই দুর্যোগে উদাসীন ভাবে মরতে দেওয়া হচ্ছে। ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তনের তত্ত্ব যে সামগ্রিক ভাবে সমস্ত জীবজগতের ওপর প্রযোজ্য। তা থেকে বেরিয়ে, শরীর-মনে অশক্ত মানুষ থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া উন্নত সভ্যতার নিদর্শন। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের ভূমিকায় সে চিত্র কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

PIC INSERTION

 

সম্প্রতি একটি আলোচনায় স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভোই জিজেকের লেখা “প্যাণ্ডেমিক” বইটির সম্পর্কে জানা গেল। সেখানে বিজ্ঞান যে দৈবদত্ত বস্তু নয়, তার প্রয়োগ ও অগ্রগতিতে যে বিস্তর রাজনীতি আছে, তা বলা হয়েছে। অতিমারির দুর্বিপাকে চিন্তাবিদরাও চিন্তিত, বহুমত। অতিমারির সুযোগে ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রের নজরদারি, যেমন কনট্যাক্ট ট্রেসিং বেড়েই চলেছে, এবং তা বিপুল জনতার সমর্থনেই! ফুকোর কথামতো, এখন আর বেত লাগে না, শাসনের জন্য “সত্য” নির্মাণ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ তখন নিজেই তার নজরদারির যন্ত্র হয়ে ওঠে। উদাহরণে, ইতালিতে স্বৈরাচারী ভাবে দেশ অচল করার কথা বলা হয়েছে। ক্যামেরা, কম্পিউটার আর ডেটা দিয়ে সরকারি বেসরকারি সকল সংস্থা নজর তীক্ষ্ণ করে চলেছে জনসাধারণের ওপরে। চিন ও আমেরিকাতেও একই গতি। তবে অভিমুখ কৌশলী ! জিজেকের মতে অতিমারিপর্বে জনতার সাথে রাষ্ট্র  ব্যবস্থাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে!  দেশভেদে তার চরিত্র ভিন্ন। কখনো সে বর্বরতার আশ্রয় নেয়, নয়ত সাম্যের মডেলে যেতে চায়। জিজেকের মতে  রাষ্ট্রের হাতে এখন মাত্র দুটোই পথ।

এক. মানবিক মুখের কৌশলী আড়ালে বর্বরতার পথে চলা, যেমন ইতালি ঘোষণা করেছিল, পরিস্থিতি ঘোরতর হলে আশি পেরোনো অসুস্থদের সোজা বিনা চিকিৎসায় মরতে দেওয়া হবে! পরে আরও কিছু রাষ্ট্র একই পথ অনুসরণ করেছে।

এই প্রসঙ্গেই ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথা, বিবেচনাহীন ও নির্দয় ভাবে নিজেদের সুবিধার জন্য অনুসরণ করার কথা বলেছেন তিনি। সত্যি বলতে অমানবিক রাষ্ট্রের এমন মনোভাবের কারণে বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে। এটাকে তিনি বর্বরতা ছাড়া আর কিছু বলতে রাজি নন। কারণ এমনকি যান্ত্রিক অনুশাসনময় সামরিক আচরণবিধিতেও গুরুতর আহতকে সবচেয়ে আগে চিকিৎসা দেওয়া হয়! মা তার দুর্বল সন্তানকেই সবচেয়ে বেশি নজর দেন।

দ্বিতীয় পথ, পারস্পরিক সহযোগিতার। কোভিড-উনিশ বুঝিয়ে দিয়েছে যে অন্য দেশ অতিমারির উৎস হলেও নিমেষে তা আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। তাই উৎস থেকে সময়ে খবর চাই, ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সহযোগিতা চাই, সব দেশের বিমান চলাচল ও বিমানবন্দরে সমান সতর্কতা চাই, যথাসম্ভব অভিন্ন চিকিৎসাবিধি চাই, অন্য নিয়মের পালন, যেমন লকডাউন চালু করা, ইত্যাদি চাই। ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা লাগবে।

অন্য দিকে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয়করণের প্রবণতা  বাড়বে বলে আশা করছেন জিজেক। উৎপাদকের প্রয়োজনীয় উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়তে পারে। ভ্যাকসিনের আবিষ্কার এখনো হয় নি, তবু তা ব্যবহারের অধিকার নিয়ে নানা দেশ নানা কথা বলছে। সেখানেও সহযোগিতা দরকার। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি পরিস্থিতিতেও যেমন তেমন কিছু বোঝাপড়া দরকার। জিজেকের অনুমান, ঊনিশশো আঠেরো সালে সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধকালীন কমিউনিজমের মতো একটা পরিস্থিতি হতে পারে। এবং তা আসতে পারে দক্ষিণপন্থী নেতাদের হাত ধরেই। প্রগতিশীলরা যে সব পদক্ষেপ নিলে নিন্দে ও প্রতিবাদ হতে পারত, তা চালু করবেন রক্ষণশীলরাই। তাদের বিরোধীরা এক্ষেত্রে বাধা দেবার কথা বলবেন না।

জিজেকের অনুমান মিলে যাবে কিনা তা ইতিহাস বলবে, কিন্তু একথা নিশ্চিত যে দুনিয়া এক সংকটের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। আর চারদিকে ক্রমাগত জীবনীশক্তি যাদের কম, তারা মারা যেতে থাকবেন, এমন হলেও তার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব কম হবে না। তাই নেতাদের নড়েচড়ে বসে বিকল্প প্রকল্প ঘোষণা করতেই হবে, ফলপ্রসূ হবার চিন্তা উপেক্ষা করেই।

খেয়াল রাখা দরকার যে সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো কেন্দ্রীয় শক্তি ছাড়াই বড় বড় দিক পরিবর্তন শুরু হবার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। বাতাসে যে বেশ কয়েক ঘণ্টা করোনা-র ভাইরাস বেঁচে থাকে, তা কিন্তু ডাক্তারদের একটি দল মানতে বাধ্য করেছেন। উপসর্গহীন রোগী যে সংক্রমণ ঘটাতে পারেন না, তা-ও আতঙ্ক জাগানোর প্রকল্পের বাইরে গিয়ে স্বীকার করতে হলো।

ছোট উদাহরণে দেশে ফিরে আসা যাক। বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীরা, কর্মচারী বা শ্রমিকরা এগিয়ে এসেছেন সমস্যা সমাধানে। উত্তরবঙ্গে চা-বাগানের শ্রমিকরা বিনা মজুরিতে প্রাথমিক কাজ করতে এগিয়ে এসে খবর তৈরি করেছেন। চকিত হয়ে চা কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ বিরিয়ানি বা কখনো ডিম-খিচুড়ি খাওয়াবার বন্দোবস্ত করেছেন। মাইনে চালু হয়েছে। সম্প্রতি মাইনে বেড়েছেও! অতএব আশা হারাবার কিছু নেই।


  • Tags:
error: Content is protected !!