- এই মুহূর্তে দে । শ
- সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর মৃত্যুর তদন্তে পুলিশ। নিরপত্তায় তৎপর কর্তৃপক্ষের একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি

বৃহস্পতিবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নং গেট সংলগ্ন ঝিলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনামিকা মণ্ডলের। শান্ত, নিবিড়, গাছপালায় ঘেরা ক্যাম্পাস চত্বরে এমন ঘটনা ঘিরে কার্যত তোলপাড় রাজ্য। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২০ মিনিটে অনামিকার নিথর দেহ ভেসে উঠতে দেখা যায়। ক্যাম্পাসে সে সময়ে ড্রামা ক্লাবের অনুষ্ঠান চলছিল। প্রশ্ন উঠছে এটি দুর্ঘটনা? আত্মহত্যা? নাকি অন্য কিছু? শুক্রবার কাটাপুকুর মর্গে ময়নাতদন্ত হয়েছে। বিকেলে পুলিশের কাছে পৌঁছয় প্রাথমিক রিপোর্ট। সূত্রের দাবি, ছাত্রীটির শরীরে বাইরে থেকে বড়ো ধরনের কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে পাকস্থলিতে মিলেছে অ্যালকোহলের গন্ধযুক্ত তরল, এমনই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। ফলে অনুমান, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অগভীর জলে মুখ থুবড়ে পড়েই মৃত্যু। তদন্তে উঠে এসেছে ‘শ্যালো ড্রাউনিং’-এর সম্ভাবনা। তবে মদ্যপানের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্ট না এলে তা চূড়ান্তভাবে বলা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই নমুনা পাঠানো হয়েছে পরীক্ষাগারে।
উত্তর ২৪ পরগনার নিমতা এলাকার বাসিন্দা অনামিকা মণ্ডল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী। মেধাবী, প্রাণবন্ত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কিং লটে আয়োজিত নাট্য অনুষঙ্গের অনুষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের পড়ুয়ারা ছিলেন সেখানে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসের কিছু অংশে ‘আনঅফিশিয়াল পার্টি’ও চলছিল। অভিযোগ, সেখানে চলছিল মদ্যপানও। ঠিক কখন, কী ভাবে অনামিকা অনুষ্ঠান ছেড়ে একা পুকুরপাড়ে গেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। পুকুরঘাটে নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন না। সিসিটিভিও নেই সেই দিকটায়। তাই ক্লু খুঁজতে এখন অনান্য সিসিটিভি ফুটেজ আর বয়ান রেকর্ডের ওপর নির্ভর করছেন তদন্তকারীরা।
এ ঘটনায় ফের একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ফের একবার উঠেছে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সরাসরি বামপন্থী সংগঠনগুলির দিকে আঙুল তুলেছেল। শুক্রবার তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল, সংগঠনের তরফে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়েছে অভিযোগপত্র। ঠিক ২ বছর আগে ইউনিভার্সিটির মেল হস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল এক প্রথম বর্ষের ছাত্রের। উঠেছিল র্যাগিংইয়ের অভিযোগ। সেবারও প্রশ্ন উঠেছিল, কোথায় নিরাপত্তা? কোথায় নজরদারি? সে ঘটনার পরে ক্যাম্পাসে সিসিটিভি বসানো হয়েছিল। রাজ্য সরকার ৩৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। বসে ৩০টি ক্যামেরা, কিন্তু এখনো ক্যাম্পাসের একাধিক জায়গা ক্যামেরা-বিহীন, অরক্ষিত। জানা গিয়েছে, যে ঝিল থেকে অনামিকার দেহ উদ্ধার হয়, সেখানে সরাসরি কোনো ক্যামেরার ‘দৃষ্টি’ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্ত নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টি মেনে নিয়ে শুক্রবার জানিয়েছেন, ‘সিসিটিভির সংখ্যা বাড়াতে আরো ৭০টি ক্যামেরার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ৬৮ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। কোর্টের নির্দেশে রাজ্য সরকারের কাছে দরখাস্ত করা হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীরও অভাব আছে, সরকারকে জানিয়েছি সেসব।’
ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন করে কড়া নির্দেশিকা জারি করেছে অরবিন্দ ভবন। মদ-মাদক ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ক্যাম্পাসে ঢুকতে হলে পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রেজিস্ট্রার দফতর থেকে জারি হওয়া একগুচ্ছ নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এখন থেকে ক্যাম্পাসে পার্কিং স্টিকার ছাড়া গাড়ি ঢুকবে না। রাত ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পরিচয়পত্র ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। ক্যাম্পাস শর্টকাট বা হাঁটার পথ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ক্যাম্পাসে মদ বা মাদক সেবনের সময় ধরা পড়লে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বহিরাগতদের প্রবেশে কড়াকড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর কথায়, ‘এ সব তো কাগজে লেখা নিয়ম। আগেও হয়েছিল। বাস্তবে ফল কোথায়?’
এদিকে, শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স। উদ্দেশ্য ছিল মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা রোধ সংক্রান্ত মতামত সংগ্রহ। কিন্তু ঘটনার রেশ গিয়ে পৌঁছয় সে বৈঠকেও। এক ছাত্র জানায়, ‘৫টি দাবির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিরাপত্তার অভাব। বহিরাগতদের ভয়। রাত্রিবেলায় ক্যাম্পাসে নিরাপত্তারক্ষী থাকেন না।’ টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান আরমান আলি বলেছেন, ‘ঘটনার কথা সবিস্তারে জানি না। তবে এমন মৃত্যু খুবই দুঃখজনক উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পদক্ষেপ যাই নেওয়া হোক নিমতা রায়পাড়ার বাড়িতে কান্না থামছে না। সন্তানহারা মা মীনাক্ষী মণ্ডলের স্টেশনারি দোকান বন্ধ। শোকাহত প্রতিবেশীরা জানান, পুজোর জন্য নতুন শাড়ি কিনেছিলেন অনামিকা, তা আর পোড়া হলো না। বেসরকারী কর্মী, বাবা অর্ণব মণ্ডল বলেন, ‘পুলিশ নিজের মতো তদন্ত করুক। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।’ তবে প্রতিবেশীদের একটাই প্রশ্ন, ‘এত বড়ো ক্যাম্পাসে কেউ দেখল না? কেউ কিছু টের পেল না।’
❤ Support Us