- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫
হনন

সাতদিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির অবসান হলেও মাঝে মাঝে তার বিক্ষিপ্ত দামালপনা হররোজের গোয়াল বাড়ি ধসে পড়ার কারণ চিহ্নিত করার পক্ষে গ্রামের সংখ্যাধিক্য মানুষ, যদিও রহিমা ফুফুর মত ভিন্ন। সাবেকি আমলের বসত বাড়িটি এক পুরুষ গত হওয়ার পর নাকি লোকমান (হররোজের বাপ) গোয়াল ঘরে রূপান্তরিত করে নেয়। সে ক্ষেত্রে বাড়িটির বয়সের বোঝা ধসে পড়ার কারণ বলে ধরা যেতে পারে। কারণ যাই হোক, রহিমা ফুফু হররোজের এমন বিপদে নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখতে পারল না। যদিও সে তার সত্তর বছরের শারীরিক জড়ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত। ধনুকের মত বাঁকা শরীর। স্বল্প দৃষ্টিহীনতায় তার একমাত্র সঙ্গী বেউড় বাঁশের লাঠিটি নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা হয়েছে কিনা ঠাওর করা যায় না। ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরছিল।যেহেতু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; তাই অতি সন্তর্পণে হেরিক্যানটা ধরিয়ে নিয়ে মাথায় ছোট্ট মাথালি চাপিয়ে নেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে নজর আলিকে দেখতে পেয়ে শুধাল, ও বাবা নজর আলি ভাল করে বলত বাবা কী হল?
নজর আলির উদ্বেগ আতঙ্কে কন্ঠনালি চেপে ধরতে চাইছে কে যেন, তবুও ফুফুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যেতে পারে না। সে জোরে শ্বাস নিয়ে বললে, কী আর হবে ফুফু হররোজের গোয়াল ঘর ধসে সব গরুগুলো ঢাকা পড়েছে। আমি যাই দেখিগে।
সে ছুটতে গিয়ে পিছন ফিরে বলে , তুমি এই কাদায় যেওনা ফুফু কোথাও পড়ে যাবে।
রহিমা ফুফুর প্রতি এই সহানুভূতি গ্রামের মানুষের এখনও একই রকম। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই রহিমাকে ফুফু বলে সম্বোধন করে। এই “সরকারি ফুফু” হওয়ার হেতু যে কী তা ঠিকঠাক কেউ জানে না। নজর আলির কথায় রহিমাফুফু বিরক্ত হল।
এক বছরের শিশু পুত্র আকবরকে নিয়ে বিধবা হয়েছিল কত বছর আগে, তার হিসাব করতে গিয়ে মনে পড়ল এবছর দু’কুড়ি চারটে ইদ চলে গেল আকবরের বাবার ইন্তেকালের পর। দ্বিতীয় বিবাহের রেওয়াজ থাকা সত্ত্বেও আকবরকে বুকে নিয়ে কুড়িটা বছর কাটিয়ে আকবরকেও হঠাৎ হারাতে হল। সেবার বর্ষায় গোপিনাথপুরের কাঁদরের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে; প্রবল বর্ষণে মাঠ ঘাট জলে জলমগ্ন। বাঁধ রক্ষা করতে না পারলে গ্রাম ভেসে যাবে; এমনি একটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আকবর গ্রামের লোকদের নিয়ে বাঁধ রক্ষার কাজে পর পর দু’দিন দূ’রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেও বাঁধ রক্ষা করতে পারছে না। তখনই গাছের প্রয়োজন হচ্ছে। গাছ কাটতে হবে। মোটা গদি ফেলে তার উপর এঁটেল মাটি ফেলতে হবে।
তাই গাছ কাটতে গিয়ে আকবরের ঘাড়ে গাছ পড়েছে। মাথা ফেটে স্রোতের মত রক্ত ।বাঁধ রক্ষা হয়েছে। রক্ষা করা যায় নি আকবরকে! আকবরের নিথর শরীরটা যখন ঘরে এনেছিল তখন রহিমা ফুফু ছেলের জন্য ক্ষীর রান্না করছিল। না, ছেলের লাশ দেখে সে কাঁদে নি। দু’হাত তুলে ওপরওয়ালার উদ্দেশে বলেছিল, হে আল্লাহ্ তোর যা ইচ্ছে তাই কর।
হররোজের উঠানে লোকে লোকারণ্য। চিৎকার চেঁচামেচিতে কোন কথা কানে স্পষ্ট শোনা যায় না। যে কাজ তারা করছে, সে কাজও ঠিকভাবে করতে পারছে না। রহিমাফুফু ততক্ষণে পৌঁছে গেছে এবং ব্যাপার স্যাপার দেখে বিরক্ত বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। হাতের লাঠিটা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাসিমের পিঠে লাঠির ঘা মেরে বললে, ওরে ছোঁড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস্ কী? যা যা তাড়াতাড়ি খড়ের চালটা সবাই মিলে তুলে সরিয়ে ফেল।
রহিমা ফুফুর ব্যবহারে হাসিম কেন, কেউই বিরক্ত হল না, বরং চরম উদ্যমে জন তিনেক যুবক চালের উপর লাফিয়ে পড়ল।
রহিমা ফুফু এমনি হুকুম জারি শুরু করেছিল আকবরের মৃত্যুর পর থেকে। সেকেলে সমাজের মেয়েদের ঘরের মধ্যে বন্দী দশাকে কাটিয়ে একাই এগিয়ে এসেছে গ্রামের সব রকম বিপদে। উৎসাহিত করেছে যুবকদের; তার ক্রমবর্দ্ধমান ধারা আজও অব্যাহত।
– এই রহমান পা’টা ধর বে পা’টা ধর।
– না- রে শালা মাথাটা ধর।
কয়েকজন ধরাধরি করে একটা গাই গরু ও একটা বাছুরকে বের করে আনল ফাঁকা চত্বরে অক্ষত অবস্থায়। ফুফু বললে আর কটা আছে বাবা?
হালের বলদ দুটো এখনো মাটি চাপা পড়ে আছে ফুফু।
– তাড়াতাড়ি কর বাবা, তাড়াতাড়ি কর। উদ্বেগ নিয়ে বলল রহিমা ফুফু।
অন্ধকার গাঢ় না হলেও খুব স্পষ্ট দেখা যায় না কিছু, কে কোথায় দাঁড়িয়ে কিংবা কে কী করছে। আবার টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি। প্যাচ প্যচে কাদা। রহিমা ফুফু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- হে আল্লাহ্ একটু রহম কর্। এই গরিব ছেলেটার প্রতি একটু রহম কর্। বহু কষ্টের উপার্জনের হালের বলদ দুটো তুই কেড়ে নিস না।
কিছুক্ষণের মধ্যে ধরাধরি করে একটা হালের বলদ তুলে আনল কয়েকজন। সুস্থ বলদটা দেখার পর হররোজের বউ আমিনা ডুকরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে সূর করে বললে, কী গুনাহ্ করেছি আল্লাহ, যে আমার উপর এত গজব তুমি ঢেলে দিলে।
রহিমাফুফু শাসনের সুরে বললে, এই ছুঁড়ি কাঁদিস্ না। ঘরে যা দেখগে মরদ’টার কী হল, গায়ে মাথায় তেল বুলিয়ে সান্ত্বনা দে। গতর খাটালে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমিনা দুহাতে ফুফুকে জড়িয়ে ধরল।
– যাঃ যাঃ এবার ঘরে যা। একগ্লাস সরবত করে দে হররোজকে ব্যাটা আতঙ্কে পাথর হয়ে গেছে হয়তো।
– ওরে নজর আলি আলোটা ধরতো একটু, এই বলদটা বুঝি মরে গেছে রে। কথাটা কানে আসতেই রহিমাফুফু ফোঁস-ফোঁস করে উঠল। তৎক্ষণাৎ একজনকে ভীড়ের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বলল, যা না ছোড়া তাড়াতাড়ি মান্নানকে ডেকে আন, জড়িবুটি অসুধ পানি কিছু দিয়ে দেখুক। যা বাবা তাড়াতাড়ি যা।
কয়েকজন বলদটাকে বের করে ফাঁকা চত্বরে আনল।
একসঙ্গে কয়েকজন বললে, নারে মরেনি জান আছে।
– তবে আর দেরি করিস্ না, ছুরি আন্, হালাল করে দে। গোস্ত বিক্রি করে কিছু টাকা তো উঠবে। যা দিনকাল গরু কেনা কি মুখের কথা। কিছু তো টাকা পাবে।
না, না, মরে গেছে দেখতে পাচ্ছিস্ না। ও গরু জবাই করা হবে না। জবাই করলে ওর গোস্ত হারাম হয়ে যাবে।
তু শালা মৌলবি হয়ে গেছিস্।
ও’বে আমি হাদিসের কথা বললাম।
– ক’টা হাদিস পড়েছিস্, আন ত ছুরি – জবাই করে দি এখুনি।
বিতর্ক চরমে। এখন আর চিৎকারে কারো কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। রহিমা ফুফু স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সে যেন অভূত যন্ত্রণা অনুভব করছে। ওর অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার । একরাশ হিংস্রতা তাকে চঞ্চল করে দিচ্ছে কোন সুদূর হতে কার করুণ আর্তনাদ বাতাসে ভেসে ভেসে তার কানে ধ্বনিত হচ্ছে। তার নূজ্ব্য শরীর আরো দুমড়ে মুচড়ে তাল পাকানো এক টুকরো মাংস পিণ্ডের মত হয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত চোখ করুণা ভিক্ষা চাইছে। এবার আরো স্পষ্ট চিৎকার, ওরে তাড়াতাড়ি ছুরি’টা আন দম গেলেও ভেতরে জান থাকে। জবাই হবে।
অন্ধকার-আরো ঘন হয়ে আসছে। হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকে দেখা গেল, হাতে ফুট খানেক লম্বা চকচকে ছুরি নিয়ে হাসিম ছুটতে ছুটতে আসছে। রহিমা ফুফু আর্তনাদ করে উঠল, ওরে হাসিম দাঁড়া বাবা দাঁড়া, অমন করে জবাই করিস্ নে। অবলা জীবটার প্রতি একটু রহম কর। ওই গরুটার যা দাম, আমি হররোজকে দিয়ে দেব।
ততক্ষণে বিদ্যুতের আলো বেহদিস। অন্ধকার, আরও গভীর অন্ধকার রহিমাফুফুর চোখ ঢেকে দেয়।
বিদ্যুতের আলো এলে দেখা গেল , হাসিম চকচকে ছুরিটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে গরুটার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে।
আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলক! অবিরাম ধারায় বৃষ্টি নামল। রহিমা ফুফুর ঝাপসা দুচোখের কোল বেয়ে জলের ধারা। বিস্ময়ে হতবাক গ্রামের লোকজন, তারা এই প্রথম রহিমা ফুফুর বুকের পাথর গলা জল চোখের কোণায় ঝরতে দেখল।
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
লেখক, সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক। সাকিন দুবরাজপুর।
❤ Support Us