Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ২৬, ২০২৫

কোকিলা

আবু নোমান
কোকিলা

 
তোর মুখটা ঠিক হাঁর মায়ের মতনরে লতিফ্যা। বুঝলি, তুই যেদিন জন্মালি, সেদিন বিজলি চমকাছিল। হামি হাঁটতে হাঁটতে সেদিন গিয়াস মাস্টারের ডহার দিয়্যা ঘিয়া মঞ্জুরের বাড়ির কান্টা পার হয়্যা তোর বাপকে খবরটা দিতে গেছিনু, বুঝলি। তোর বাপ তখন চৌধুরিরঘে আমের বাগানের জোগানদার ছিল। তিন জনমে হামার বংশে বেটি  ছিল না, তুই আলি হামারঘে ঘর আলো কোইর‍্যা। আলম মুনশি বড়ো শ্বাস নেয়। হামাকে এক ঘটি পানি দেতোরে লতিফ্যা বহিন হামার। একটু গলাটা ভিজিয়্যা লি। কলসির পানি দিস না ফের। টাটকা পানি দিস। লতিফা পানি আনতে যায়। আলম মুনশি একা একা বলতে থাকে। এখন আর কেহু হামার কথা শুনতে চাহেনারে বহিন।তুইও গেলি। পানি আনার বাহানা কোইর‍্যা আরো কত দিরও করবি। হামি তো জানি। কর… তোর কি আর হামার সোঁতে কথা কহার বয়স ? তোর তো এখন লাফিয়্যা ব্যাড়াইব্যার বয়সরে। সে কথা তুই না জানিস, হামি তো জানি।

 
আলম মুনশি অপেক্ষা করে। বৌমা, একটু দেখো তো, লতিফার আসতে দেরি কেনে হইছে ? কোথায় দেখতে যাবে লতিফার মা ? ক্ষীণ ও নিম্নত্বরে বলে, উ ঠিকই চোইল্যা আইসবে আব্বা, চিন্তা করিয়েন না।
 
উঠোনে বাঁধা কোকিলা নামের গাভী কয়েকবার হাম্বা হাম্বা ডাকে। এ সময়ে জসিম এসে গাভীটিকে খাইয়ে দেয়। জসিম দু-বাড়ির পরের বাড়ির পরোপকারী ছেলে। আলম মুনশির খুব কাছের বন্ধুর নাতি। বন্ধু এখন আর বেঁচে নেই। কাজে অকাজে এটা ওটা কাজটা করে দিয়ে যায় জসিম। আলম মুনশিকে সে দাদো ডাকে। কোকিলা গাইটা হারামি। লতিফাকে সহ্য করতে পারে না। খেতে দিতে গেলে শিং দিয়ে গুঁতো দেয়। খুব সাবধানে খড়, ভুসি, জাবনা দিয়ে আসে। ভাতের মাড় দিয়ে লালি মাখিয়ে দেয় সাথে। তবু কেন যেন লতিফাকে দেখতে পারে না কোকিলা। লতিফা দুধ দুইতে গেলেই বাম পা দিয়ে লাথি দেয়। খুব সাবধানে কোকিলাকে এড়িয়ে চলে লতিফা।কিন্তু জসিমকে কিছু বলে না। লেজ দিয়ে মশা তাড়ানোর শব্দ হয় একটু পর পর। দূরে মসজিদে আজানের সুর ভেসে আসে। আঁধার নামে মাঠের পূর্বদিকে। লতিফার অপেক্ষা করতে করতে আলম মুনশি উঠে দাঁড়ালো। আসরের অজু আছে। এ ওজুতেই মাগরিবের নামাজ পড়ে নেবে আলম মুনশি। এ কাজ মোটামুটি রুটিনমাফিক করে আসছে দীর্ঘদিন। কোনো হেরফের হয় না। মাঝে মাঝে অসুখ-বিসুখ হলে আলাদা কথা। গায়ে এখন আর আগের মতো জোর পায় না। কব্জির দিকে তাকায় আর ভাবে, এই তো সেদিন কী তাগড়া জোয়ান ছিল  সে। কদিনই বা হবে ? পাড়ার সবাই মিলে হাডুডু খেলায় মেতে উঠত সারা মাঠ। নতুন ধানের গন্ধে তখন সারা  গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজে মেতে থাকত।
 
জসিম আসে। লতিফ্যা লতিফ্যা.. কইরে লতিফ্যা তুই কুনদিকে। কহি একাদ্দিন যুতি একটু আধটু দিরঙ হয় টয়, তুই একটু গাইটাকে দেখবি ন্যা ? সাইডে কাঁড়ির আটিতে আগুন দিয়্যা একটু ধুম্ম্য জ্বালিয়ে দিবি না ? মশা কামড়াইছে অবলা জানোয়ারটাকে। লতিফার জবাব না পেয়ে দাদো… ও দাদো… ডাকতে ডাকতে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে জসিম। আলম মুনশি আঁধারে বসে আছে। বলে, জসিম তুই আলি ? ওই লতিফ্যাকে কহিনু এক ঘটি পানি দেতোরে বহিন, এখন তো আর আগের মতন একসোঁতে এত কথা কহিতে পারিন্যা। একটু টাটকা পানি চাহিনু, উ ছুঁড়ি গেল সে সাঁঝের আগে। কে জানে এত দিরঙ করবে উ। দিন-কাল তো ভালো নারে জসিম, একটু দেখবি ?
 
কী কোহিছো দাদ্যে ? অকে পাঠিয়্যাছো কেনে ? জসিম গরুকে কোনো খাবার না দিয়েই বেরিয়ে যায়। আকাশে মেঘ ডাকে। পায়ের নিচের মাটিও কাঁপতে থাকে জসিমের। অন্ধকার রাস্তার এবড়োখেবড়ো পথ, তাতে কি ? কোনো পথই অচেনা নয় তার। সকালে একধারা বৃষ্টি হয়েছিল। গরুগাড়ির চাকার সমান্তরাল লাইন ধরে বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে এখনো। মাঝে মাঝে সেখানে পা ডুবে যায় জসিমের। অল্প দূরে মহানন্দা নদীর বালি বিজলির আলোয় চকমক করে। জসিম কানে হাত দেয়। এমন বিজলির আলোর পরেই দ্রুম দ্রুম শব্দ কানের পর্দায় তালা লাগায়। এখন প্রতিদিন মানুষ মরছে বিজলি পড়ে। পানি বাড়ছে নদীর ডাক শুনে বুঝতে পারে জসিম। আবছা কারো ছায়া পথের ধারে। কেমন ভারী ভারী লাগে বাতাস। লতিফ্যা তুই কুণ্ঠে হারালিরে..? জসিম কোন দিকে যাবে খুঁজতে ? নদীর পাশে যে একটি টিউবওয়েল আছে সেখানেই আপাতত খুঁজবে। তারপর অন্যদিকে। ওখানে জায়গাটা বেশ অন্ধকার। সুবিধের নয়। একপাশে মহানন্দার পাড় ভেঙে পড়েছে সমান্তরাল খাড়াভাবে। ওখানে পড়লে কারো বাঁচার আশা নেই। জসিম গভীর চিন্তায় পড়ল। সেদিকেই যায়নি তো লতিফা? জসিম হাঁটতে থাকে সেদিকে।
 
কয়েকজন মানুষের কণ্ঠস্বরে এগিয়ে গেল জসিম। হ্যাঁ লতিফাই তো। অন্ধকারে ওড়নার আঁচল মাথায় দেয়ার আবছা ধরনেও মনে হয় লতিফাই। কেউ যেন টিউবওয়েল চেপে সাহায্য করছে তাকে। জসিম জোরে ডাক দেয়, লতিফ্যা ? লতিফা সাড়া দেয়, হ্যাঁ, জসিম ভাই, হামি এখানে আছি জি ভাই। জসিম এগিয়ে যায়, হ্যাঁরে লতিফ্যা, তুই এমন কাম করিস কেনেরে ? হাঁর দাদোকে তুই চিন্তাই ফেইল্যা দিয়্যা অর জানটা লিবি না কি ? 
 
না জি জসিম ভাই, একটু দিরঙ হোয়্যা গেল আসোলি। সাঁঝের ব্যালা লদ্দীর পানি কেমন উথালপাথাল করে। পচ্ছিম দিকের চিক্যাসটা যখন লাল হোয়্যা ডুবতে থাকে না ? হামার জানটাও উথালপাথাল করে জসিম ভাই। আহারে হামার দাদোর পানি আনতে আইস্যা দিরঙ করা হামার ঠিক হয়নি।
 
জসিম লতিফার চোখ দেখতে পায় না। মেয়েটি দিন দিন বড়ো হয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব নিতে শিখেছে মনে হয়।  আবারো আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই তীব্র শব্দে কেঁপে  উঠল কলের পাড়। রূপৰূপ শব্দে ভেঙে পড়ল নদীতীরের কয়েকটি ছোটো ছোটো স্থান। জসিম তাড়া দিল, চল চল। তোর হুঁশ দিশা আর হোইলো নারে লতিফ্যা। গাইট্যাকে খাইতে দিসনি। হাম্বা হাম্বা করছে। মশা কামড়াইছে।
 
হ্যাঁজি জসিম ভাই, খুব ভুল হোয়্যা গেছে। কোকিলা হামাকে দেখতে পারে না, কিন্তু অকে হামি না খাওয়াইলে হাঁর মনটা খুব খারাপ করে।
 
হেমন্তের সকালে মিষ্টি রোদের তাপ সহনীয় অনেকটাই। আলম মুনশি ড্যারা দিয়ে পাটের সাহায্যে দড়ি পাকাচ্ছিল, আর আকাশের দিকে চেয়ে লতিফাকে ডেকে বললো, কিছু বুঝতে পারছিস ?
 
হামি ? হামি কী বুঝব ? লতিফা দক্ষিণের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হ্যাঁজি দাদো, কিসের আওয়াজ শুন্য যাইছে ?
 
তার মানে বানের বছর এটা বুঝলি ? এবার দেরি কইর‍্যা বান বাড়া শুরু। মাছ খাবি ন্যা ? হামার গতরে শক্তি থাকলে দেখতিক, কত্ত কত্ত মাছ লিয়্যা আসতুঙরে বহিন। বান বাড়ার সময় বাচা, ঘেড়া, উড়োইল, বোইল, আরো কত কি যে মাছ জালে ধরা দিত। কুনুদিন লা লিয়্যা মাঝ সদ্দীতে যাইয়্যা… ওইখ্যানে বেশি বোইল আর কালবাউস মাছ পাওয়া যাইত। বানের শেষদিকে পাওয়া যাইত, বাইম, গুঁচি, শিঙ, মাগুর, পুঠি, সরল পুঁঠি আরো কত কি যে ! এত মাছ কে খাইবে ? তোর দাদি বকাবকি করত, এত মাছ কী কইরব্যা তুমি ? কত মাছ যে বিলিয়ে দিয়্যাছি। হামার সাথে কেহু তাল মিলাইতে পারতোক না। তোর ইদিল নানাকে পুচ কোইর‍্যা দেখিস।
 
আচ্ছা দাদো, তুমি কীভাবে ঠাহর কইরতে পাইরল্যা, এটা বানের বছর ?
 
দক্ষিণের আসমানটা দেখলি ন্যা, কেমন ঘোলাটে হোয়্যা আছে। দূরে কেমন কেমন আওয়াজ। মনে হোইছে নূহ আলাহিস সালামের আমলের বান দেখা দেবে রে বহিন এবার।
 
কী কহিছো দাদো ? তাহিলে অত বড় নৌকা তুমি কুণ্ঠে পাইব্যা ?
 
কথার কথা কহিমু। তুই একটুতেই এত ভোইড়ক্যা যাইস ক্যানেরে ? জসিমকে দেখিস ন্যা কেমন সাহস। কুনুকিছুকে উ ভয় পায় না। কোকিল্যা গাইকেও লয়।
 
আর হামি যে কোকিল্যাকে সারাদিনমান খাওয়াই দাওয়াই, পুয়াল-খড়, ভুসি, ভাতের মাড়, জাবনা খাইতে দিই। তার ব্যালা ? আসলে কোকিল্যাই হামাকে দেখতে পারে না দাদো। জসিম ভাই আগাদিকে গেলে এক্কেবারে চুপ থাকে। আর হামার ব্যালা শিং দিয়্যা চুসায়। শালা মারকুইট্যা গাই একটা।
 
নারে বহিন ! এগল্যা জন্তু তো অবলা, যাকে নিরাপদ আর বন্ধু মনে করবে তাকিই ভালোবাসবে।
 
যা হোইবে হোউক গ্যা। হামিও ভয় পাইন্যা দাদো। কোকিল্যাকে হামি খুউব ভালোবাসি। মারকুইট্যা হোইলেও খুব ভালোবাসি।
 
ভালোবাসলে মাইর খাইতে হয়। যেমন গোলাপ ফুল তুলতে গেলে কাঁটা থাকে, সহ্য করতে হয়। সাহস না থাকলে ভালবাসা যায় না। সাহস রাখবি। বুঝলি ? দুনিয়াতে সাহসের বড়োই আকাল। একবার সাহস কোইর‍্যা সামনে আগাইতে পারলেই কেল্লাফতে। 
 
জসিম দুধ দুইতে আসলে কোকিল্যা কত শান্ত থাকে তুমি জানো দাদো ?
 
হামি জানব না কেনেরে লতিফ্যা ? বুঢ়া হোয়্যাছি তো সব সময় দুচোখ বন্ধ কোইর‍্যা থাকি নাকি ?
 
না দাদো। হামার মনে হয় জসিম ভাই কুনু মন্তর ফন্তর জানে। হামার বিশ্বাস।
 
ওই যে কোহিনু, অবলা হোইলেও অরা কিন্তু মানুষ চিনহে। জসিম নিশ্চয় ভালো মানুষ। 
 
সাদো… ও দাদো… ডাকতে ডাকতে জসিম প্রবেশ করে বাড়ির মধ্যে। আলম মুনশি লতিফাকে বলল, দেখ দেখ, ছোঁড়া কতদিন বাঁচবে দেখ। অর কথা কহিতে না কহিতেই বাড়িতে চোইল্যা আইসল। কহি, জসিম তুই ম্যালাদিন বাঁচবিরে ভাই। হামার লাইগ্যা একটু দুয়া করিস ভাই। মরলে যেনে আল্লাহ বেহেশতে দিয়্যা দ্যায়। আলম মুনশির দিকে তাকিয়ে জসিম হাসতে হাসতে বলে, কি যে কহো দাদো, হামি কুনু গনতির মানুষ হোইনু নাকি ? হামার দুয়া আল্লাহ নিবে কেনে ? 
 
লতিফা এ কথার জবাব দেয়ার জন্য রান্নাঘর থেকে দৌড়িয়ে এসে বলল, হ্যাঁজি জসিম ভাই, তুমি খুবই ভালো মানুষ জি ভাই। হামি কিন্তু বুঝ্যাছি। হামি খালি লয়, হামারঘে কোকিল্যা গাইটাও তুমাকে কত্ত ভালোবাসে। তুমি জানো ? 
 
জসিম হেসে লজ্জার ভাব করে বলে, শোনো কথা, হামি ফের কেমন কোইর‍্যা ভালো মানুষ হোইতে পারি, কহা ?  হামার কি সংসারের কুনু জ্ঞান-বুদ্ধি আছেরে বুবু ? আর গাইয়ের কি কুনু বুদ্ধি শুদ্ধি আছে নাকি যে, গাই ভালোবাসলেই ভালো মানুষ হোয়্যা যাইবে ? গরু- গাইয়ের ভালোবাসাতে কী আসে যায় ? কহা বুবু ? বাদ দে তো, দে তোরঘে ডোল বালতিটা দে। দুধ দুহ্যা দিয়ে যাই। কাইলক্যা একটু কাম আছে। আসতে দিরঙ হোইতে পারে।
 
খুব ভোরে আলম মুনশি সুর করে কোরআনের আয়াত পড়ে, আয়াতুল কুরসি পড়ে। তারপর বাড়ির চারপাশটা ধীরে ধীরে হাঁটে। সাথে একটা লাঠি থাকে তার। লতিফা তড়াক করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। জানো দাদো, আইজ আর জসিম ভাই আইসবে না। কোইহ্যা দিয়েছে। হামাকেই কোকিলাকে খাওয়াইতে হোইবে। লতিফা ব্যস্ত হয়ে ভাতের মাড়, তরকারির খোসা, কলার খোসা, জাবনা আর লালি একসাথে মিশিয়ে কোকিলাকে খেতে দেয়। কোকিলা হুঁশ হুঁশ করে শিং বাঁকিয়ে লতিফার দিকে তেড়ে আসে। লতিফা একপাশে সরে নিজেকে বাঁচায়। আর গালাগালি করে কোকিলাকে, হামি তোকে খাওয়ার দিই আর তুই কিনা হামাকেই শিং মারতে আসিস। কত নিমকহারাম রে তুই। একা একা বকতে থাকে নিজের মনেই। 
 
আলম মুনশি লতিফাকে বলে, এত পঁহত পঁহত তুই গাইকে খাইতে দিলে তো তোকে মারবেই রে। জসিম তো কুনুদিন এ সময়ে খাইতে দেয় না। তুই দিতে গেলি আর তখন কোকিলা মনে করল, কুনু শত্রু টক্র আইল বুঝিন।
 
তাই নাকি জি দাদো ? আর বাছুরটাকে যে হামি বাঁইধ্যা থুইয়্যাছি, এটারই রাগ তুলছে নাকি, আল্লাই জানে।
 
হোইতে পারে।
 
বাড়ির পশ্চিম দিকের রাস্তার কিছুদূর গেলেই বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে দুপুরের পরেই লতিফার বান্ধবীরা আসে। কারো কারো তেঁতুলের দিকে নজর থাকে। কেউ কেউ খেলাধুলা করে। লতিফার বয়সিরা বেশির ভাগই গুজুর-গুজুর, ফুসুর ফাসুর গল্প করে। লতিফা মাকে বলে, মা খেলতে যাব। ওই যে তেঁতুল তলায় অরা আছে। মা বলে দেয়, এতবড় বিতি মেয়ে হয়েছিস, আর কিসের খেলারে? তোরা খেলতে যাইস, নাকি বসে বসে খালি খাজুরে আলাপ করিস ? যত্তসব।
 
কথাটি মিথ্যে নয়। আগে যে এক্কাদোক্কা, বৌচুরি, বদন-গাদ্দি, কানামাছি ইত্যাদি খেলা খেলত, এসব এখন আর কেউ খেলতে চায় না। শুধু শুধু আলাপ। মোবাইল, টিভি, কোন বাড়ির কে কার সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদিই আলাপের বিষয়বস্তু। লতিফার মা চুলের খোপা বাঁধতে বাঁধতে বলতে থাকে, এগল্যাকে খেলা কহে। যাবি তো যা, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবি ন্যা। ধাইনগরের রহিম শেখের বাড়ি থাইক্যা কাইল তোকে দেখতে আসবে। আইজ তোর হাত পা-গুলা একটু সাবান টাবান দিয়্যা পরিষ্কার করবি তো। নখটখ  কাইট্যা পরিষ্কার কোইর‍্যা ধুইতে হোইবে। চুলে  সাবান-শ্যাম্পু দিবি। সময় লাগবে। তোর বান্ধবী আছে না, সুমা ? অর মাকে আইজ ডাকিস তো, কোহবি মা ডাইক্যাছে। ওই তোর একটু যত্ন-টত্ন নিতে পারবে। হাতে-পায়ে, গায়ে-গতরে ঝামা-খোসা ঘইষ্যা দিবে। একনাগাড়ে কথাগুলো লতিফার মা বলে গেলে একেবারেই থমকে যায় লতিফা। পরক্ষণেই ছুটে বেরিয়ে যায় তেঁতুলতলার দিকে। 
 
আইজক্যা দিরঙ করলি যে ? তুইই তো হামারঘে আগে আসিস এখানে। লতিফার বান্ধবী শেফালি বলে।
 
আমার কিছু ভালো লাগে নারে। তোরা গল্প কর। হামি যাই। লতিফা মিছামিছি উঠার ভান করে।  
 
ওদের মধ্যে কারিমা বেশ বুদ্ধিমতি ও চঞ্চল প্রকৃতির। সে তার ডান হাত ধরে ফেলে বলে, কিরে তুই কুন্ঠে যাবিরে? আর তোর মনই বা খারাপ কেনে? না কোহ্যাই চোল্যা যাবি ?
 
আসলি তো এমনি দেরিতে। আবার চোইল্যা যাবি আসতে না আসতেই। আচ্ছা যাবি তো যা। বলে শেফালিও উঠতে চায়। কারিমা বলে, শুন শুন, তোরা মন ধরাধরি করিস না।হামি কিন্তু জানি লতিফ্যার মন খারাপ কেনে ?
 
শেফালি চঞ্চল হয়ে উঠে বলে, কহাতো কহাতো, হামার বান্ধবীর মন খারাপ করল কে ? ওই কোকিল্যা ঢিস মাইরল নাকি ? নাকি ঐ গাঁয়ের রফিকুল্যা কিছু কোহ্যাছে ?
 
নারে না। ধাইনগরের রহিম শেখের বড়ো ব্যাটার সোঁতে বিহ্যার সম্বন্ধ আইসছে। 
 
লতিফ্যা ফ্যাল ফ্যাল করে কারিমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তুই কীভাবে জানলি ?
 
হামার ছোটো খালার ভাসুরের ব্যাটা ওই পলাশ।
 
পলাশ অর নাম নাকিরে ? শেফালি জিজ্ঞেস করে।
 
হ্যা। নামটা তো খুব সুন্দর। খুব ভালো ছেলেরে। তোর ভাগ্য কত ভালো দেখ! ওই স্কুল থাইক্যা কয়েক কেলাস পাশ কোইর‍্যা এখন আমের ব্যবসা করে। খুব ভালো ব্যবহার। উচা, লম্বা, গামাঠা স্বাস্থ্য। সবাই হিহি করে হাসতে থাকে।
 
লতিফা শুনে বলে, কিন্তু হামি অকে বিহ্যা করবুই না।
 
কেনেরে ? অরঘে বংশ ভালো, কিছু জমিজমাও আছে। দু ভাইয়ের সম্পর্কও খুব ভালো। বুঝলি। হামার খালা কোহ্যাছে, বর হিস্যাবে ছাইল্যা এক নম্বরের। আর দেখ, কুনু বিড়ি সিগারেটের ধার ধারে না। পান খায় না। আর কি চাইস তুই ? এ রকম ছাইল্যারা বউকে খুব ভালোবাসবে। বুঝলিরে লতিফ্যা।
 
তাইলে তুইই বিহ্যা কোইর‍্যা লে। যাহ।
 
হামার খালা একবার মুখ ফইসক্যা এ কথা কোহ্যাই দিয়্যাছিল। কিন্তু হামারখে যে অবস্থা, অরা হামারঘে দিকে আসবে নারে। তুই তো জানিস যৌতুকের টাকার লাইগ্যা কয়েকটা বিহ্যা হইতে হইতে হইল না।
 
ক্যানে ? অরা কি যৌতুক ফৌতুক চাহিবে নাকি রে ?
 
আরে নাহ। হামারঘে লতিফ্যার চেহারাসুরত তো অরা একবার দেখ্যাই গেছে। ছাইল্যা অকে দেখ্যাই তো পাগলা। ফের-আবার কিসের যৌতুক? তবে হ্যাঁ বাড়ির অবস্থা না থাকলে তো অরা আগাইতোকই না। এ কথা ঠিক।
 
লতিফা বলে, যাইরে, মা হামাকে তাড়াতাড়ি ডাইক্যাছে। তোরা কিছু মনে করিস ন্যা। লতিফা দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পিছন ফিরে বলে, ও আর সুমার মাকে একটু খবর দিস তো কারিম্যা, মা ডাইক্যাছে।
 
আচ্ছা। তারাও চলে যেতে লাগল তেঁতুলতলা থেকে। 
 
লতিফা সকালে উঠে দাদুকে দেখতে না পেয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়। দেখে একটা ভেঙে পড়া ডালের উপরে বসে আছে আলম মুনশি। দৌড়ে আসতে লেগে লতিফা কিছুটা হাঁপাচ্ছিল। বলে, দাদো, তুমি কি ধাইনগর গেছ কুনুদিন ?
 
আলম মুনশি লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কেনেরে বহিন? বহুত আগে কাজে কামে গেছি। এখন তো আর অত মনে নাই। 
 
তুমি কি ওইখ্যানকার রহিম শেখকে চিনহো ?
 
নারে বহিন। আইজ হামার মন টন খুব খারাপ আছে রে। শরীরটাও ভালো লাগছে না।
 
কেনেজি দাদো ? তোমার মন খারাপ কেনে ? তুমি কিছু জানো নাকি ? 
 
হামি ফের কী জানব ? হামি এখন বুড়া মানুষ। তোরঘে কুনু ব্যাপারে তো আর নাক গলাইতে যাই ন্যা।
 
ও বুইঝ্যাছি, বাপুর সোঁতে কুনু ব্যাপারে মন খারাপ কোইর‍্যাছো নাকি ? নাকি মায়ের সোঁতে। শুনো দাদো, সব সময় মন ভালো রাইখব্যা। তুমি হোইল্যা এ বাড়ির সব থাইক্যা বড়ো মড়ল মানে অভিভাবক। সাহস কোইর‍্যা সবাইকে বকা দিব্যা, কুনু ব্যাপারে রাগ অভিমান কোইরব্যা না। তুমি তো কহো, সাহস কোইর‍্যা আগাইলে সবকিছুই হয়। 
 
তুই এত কথা কুণ্ঠে শিখলি রে ?
 
কেনে তোমার কাছেই তো। আলম মুনশি হেসে উঠে।
 
চল, তোর কোকিল্যা গাইয়ের দুধ রোইজ রোইজ হামাকে খাইতেই হোইবে। না হোইলে নাকি হামি দুর্বল হয়্যা তাড়াতাড়ি মর‍্যা যাব। চল তো খাইয়াই লি। এগল্যা তোর মায়ের কথা। বুঝলি ? হামি কহি, একটু আধটু ভাজাভাজি, মরিচ-লবণ-ঝাল খাইতে, তোর মা হামাকে এগল্যা দিবে ন্যা। কহা, রোইজ রোইজ দুধভাত আর দুধ রুটি আন্যা আন্যা খাওয়া যায় ?
 
ও এই কথা ? মা তো ঠিকই কহে।
 
তুইও ?
 
হ্যাঁজি দাদো। তোমাকে হামরা বেশিদিন বাঁচাতে চাহি। তুমি মরতে চাহিলেও কি হামরা তোমাকে মরতে দিব ভাইব্যাছো ?
 
আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। এবার কহা তোর সেই ধাইনগরের কী কথা কহছিলি ?
 
ওইখ্যানকার রহিম শেখের বড়ো ব্যাটা পলাশের বিহ্যা। 
 
তো ? তোকে জাফত কইর‍্যাছে নাকি ?
 
আরে নাহ। দাদো শুনো, ওই ব্যাটা নাকি আইজক্যা হামাকে দেখতে আইসবে। তো সুমার মা হামাকে সাজিয়্যা-গুজিয়্যা দিবে। হামি কহছি কি যে, তুমি চিনহো কিনা ?
 
আসতে চাহ্যাছে, আসুক না। দেখি। দেখলেই বুঝতে পারব। তারপর খোঁজ-খবর লাওয়া যাইবে।
 
তা ঠিক। হামার বান্ধবী কারিমার ছোটো খালার নাকি ভাসুরের ব্যাটা।
 
আরে, আগে অকে আসতে দে।
 
ঠিকই কহ্যাছ্যে হামি যাই, কোকিল্যাকে খাইতে দিতে হোইবে।
 
লতিফা ভাতের ফেন, ধানের গুঁড়া, গুড়ের লালি মাখিয়ে কোকিলাকে খেতে দিতে যায়। কোকিলাও লতিফার দিকে এগিয়ে আসে। লতিফা মাগো বলে দূরে সরে আসে। গালাগালি দিতে থাকে। তোর ভালো করতে নাইরে, শালা গরুর বাচ্চা গরু। হামি না থাকলে  কে তোকে খাওয়াইতো শুনি ? তুই একটা নিমকহারামের বাচ্চা। তোর লাইগ্যা হামি কি-না করছি, আর তুই হামাকে ঢুসাইতে আসিস ?
 
কিরে লতিফা তুই রেডি হোয়্যা লে। ধাইনগরের লোকজন চোইল্যা আসবে, সুমার মা চোইল্যা আইসছে দেখ। রান্নাঘর থেকে মায়ের তাড়া।
 
এবার বুঝ ? হামি চোইল্যা গেলে তোর কেমন মজা হোইবে ? তখন বুঝবিরে কোকিল্যা, তখন বুঝবি।
 
জসিম ধাইনগরের রহিম শেখ আর পলাশকে নিয়ে লতিফাদের বাড়িতে যখন আসল, তখন মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওদের সাথে একজন মহিলাও আছে। সম্ভবত পলাশের মা। তেমন কথাবার্তা হলো না। খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হতেই রহিম শেখ আলম মুনশিকে বলল, হামারঘে হাইল্যা লতিফাকে আগেই দেখ্যাছে। এখন আর কুনু কথা কহার নাই। আপনারঘে যুতি কুনু আপত্তি না থাকে তো এখন খালি একটা ভালো দেখে দিন করলেই হয়, আরকি! লতিফা হঠাৎ চমকে উঠে। সে কি ? একেবারে দিনক্ষণ ঠিকের কথা বলছে যে।   
 
আলম মুনশি আড়চোখে জসিমের দিকে তাকায়। আলহামদু লিল্লাহ উচ্চারণ করে চোখের চশমাটা খুলে একবার মুছে নেয়। দূরে দাঁড়িয়ে জসিম হঠাৎ মুখ ঘুরে দাঁড়ায়। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে কোকিলার দিকে ছুটে যায় জসিম। কী একটা ভীষণ যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরে সে।
 
রহিম শেখ ডান হাত নিজ মাথায় বুলোতে বুলোতে আলম মুনশির দিকে চেয়ে বলে, কি চাহাজি, মন খারাপ করছেন ? হামরা আপনার পোতিনকে কষ্ট পাইতে দিব না। বুঝলেন, মনে কুনু দুশ্চিন্তা করবেন না।
 
না বাবা, দুশ্চিন্তা লয়। এই পোতিন হামার খুব ভাগ্য লিয়্যা আইসছে। তোমারঘে বাড়িতে গেলে তোমরাও বুঝভ্যা। কিন্তু হামি ভাবছি ওই চোইল্যা গেলে আমারঘে বাড়িটা তো কানা হোয়্যা যাইবে।
 
বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। বৃষ্টি আর বন্যার খবরও আসছে সাথে সাথে। লতিফার কান্না আসছে। কেন আসছে সে নিজেও জানে না। তেঁতুলতলার বান্ধবীদের কথা খুব মনে পড়বে। মনে পড়বে মা আর বাপুর কথা। জসিম ভাইয়ের কথা। আর এই দাদোর কথা, যে সব সময় আগলে আগলে রাখত তাকে মনে পড়বে কোকিলা গাইটার কথা, যে কখনো কাছে ভিড়তে দিত না, কিন্তু লতিফা তাকে কখনোই ভুলতে পারবে না।
 
রাতে ভালো ঘুম হয় না লতিফার। একবার জাগে, একবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে একবার বান্ধবীদের সাথে ঝগড়া করে তো একবার সবাই মিলে গলা ধরে নাচানাচি করে। কোকিলা তাকে তেড়ে আসে। এ সময় সে পালাতে গিয়ে জসিম ভাইয়ের সাথে ধাক্কা খায়। ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার করে জেগে ওঠে লতিফা। কিরে কী হলো তোর ? পাশে শুয়ে থাকা তার মা জিজ্ঞেস করে। লতিফা কোনো উত্তর না দিয়ে পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আবার। বৃষ্টির শব্দে শেষ রাতেও কয়েক বার ঘুম ভেঙেছিল লতিফার। সকালে দেরি করে ওঠে। আজ আর কেউ সকালে উঠায়নি তাকে। দাদুও ডাকেনি আজ। চারদিক কেমন যেন সাড়াশব্দহীন। ঘরের পেছনে সজনে গাছের ডাল চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি কচু পাতার উপর পড়ে এক ধরনের তরঙ্গ সুর সৃষ্টি করছে।
 
ধাইনগর কত দূর হবে ? কেমন হবে তার নতুন শ্বশুর বাড়ি, সবাই কেমনভাবে গ্রহণ করবে তাকে ? পলাশ ছেলেটাই বা কেমন, এ সকল চিন্তা লতিফাকে বিক্ষিপ্ত করেছে। লতিফার বাবা বাড়িতে এসেছে, কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। শেফালি, কারিমা আর সুমাও এসেছিল। কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে চলে গেছে। বিকেলে গাঁয়ের কয়েক ঘর লতিফাকে দেখতে এসেছিল। তারা পলাশের প্রশংসা আর লতিফাকে কিছু উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে গেছে। দুপুরের পরে তেঁতুলগাছের তলার আড্ডা আজ আর জমেনি। লতিফার মা প্রথমে যেতেই দিচ্ছিল না। পরে বান্ধবীদের জোরাজুরিতে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে আসে লতিফা। দাদুকে আজ দেখা যায়নি। মনে হয় বাড়ির পেছনে পড়ে থাকা নিম গাছের ডালের উপরেই একা একা বসে বসে সময় কেটেছে তার।
 
সন্ধ্যের পরে লতিফার খুব কান্না পেল। খুব করে কাঁদল। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে ঘরের মধ্যে বসেছিল লতিফা। বৃষ্টির তোড়ে কোথায় যেন সজনে ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ হলো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই জোরে সোরে আকাশ ভেঙে বাজ পড়ল কোথাও। 
 
বিয়ের দিনের সকালের আকাশটা কিছুক্ষণ মেঘে ঢাকা ছিল। বর, বরযাত্রী আর ডুলিবিবিদের জন্য একটি ঘরে বিছানা-কাঁথা পেড়ে দেয়া হয়েছে। আর তখনই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। কিছুক্ষণ থেমে আবার বৃষ্টি।
 
দাওয়ায় এসে লতিফা দেখে, জসিম একটি পিঁড়িতে বসে বসে একা একা কী যেন আঁকিবুকি করছে। কী আঁকছো জসিম ভাই ?
 
নারে। কিছু লয়। ওই গাইটাকে একটু দেখতে আইস্যাছিনু। ভাবনু এখানে একটু বসি। তাই।তুমি খুব ভালো মানুষ জসিম ভাই।
 
ভালো মানুষ হোয়্যা কী লাভ, কহা ? জীবনে ভালো মানুষের কষ্ট বেশি। বুঝলি ? অরা পরের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথা ভাবতে ভুল্যা যায়।
 
লতিফার কান্না আসছে ভীষণ। এই জসিম ভাইটা এত ভালো কেনে ? কান্নায় কথা বলতে পারল না। হঠাৎ জসিম ভাইয়ের জন্য মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এত ভালো মানুষটা মনের মধ্যে এত কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
 
তিনটা গরুর গাড়িতে বরের বাড়ির লোকজন এসেছে। বিয়ের পর শুরু হয়েছে ঝমঝম বৃষ্টি। দুপুরে অতিথিদের খাওয়াপর্ব শেষে বৃষ্টির তোড় বেড়েছে ভীষণ। নতুন লাল শাড়িতে লতিফাকে দেখে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না।
 
বিদায়ের মুহূর্তে কোকিলার ডাক শুনতে পেল লতিফা। এ সময়ে কোকিলা হাম্বা হাম্বা কখনো করে না, আজ করছে কেন ? লতিফা চমকে কোকিলার কাছে ছুটে যায়। ঝমঝম বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে গোয়াল ঘরে পৌঁছতে গিয়ে তার নতুন শাড়ি ভিজে যায়। কিছু ভূসি, গুঁড়া, জাবনা, খড়ের আঁটি, ভাতের ফেন আর লালি মিশিয়ে কোকিলাকে এগিয়ে দেয় লতিফা। সকলেই আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে। কোকিলা আজ শিং নিয়ে এগিয়ে আসে না। কোকিলা তার খাবারে মুখ না দিয়ে লতিফাকে দেখতে থাকে। লতিফা সাহস করে এগিয়ে যায়। কোকিলা তার মুখ আর মাথা লতিফার দিকে এগিয়ে দিয়ে আদর গ্রহণ করে। লতিফা কোকিলার মাথা মুখ, চোখের পাতা, কান, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দেয়। কোকিলার চোখের নিচে জলের ধারার ভেজা কালো রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। এ কি ! কোকিলা কি কেঁদেছে ? লতিফা চলে যাচ্ছে তাই কোকিলার এই কষ্ট ? লতিফা খাবারগুলোকে আরেকবার নেড়ে দেয়। খুশিতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে দাদো, ও দাদো, দেখো হামার কোকিলা, হামার কোকিলা ! লতিফা কাঁদতে কাঁদতে লাফাতে থাকে, হাসে আবার পরক্ষণেই কাঁদে। হামাকে চুঁড়ছিলি কোকিলা ? এই শেষব্যালায় চিনেছিত তুই হামাকে ? তুই হামাকে এত ভালোবাসিস কোকিলা ? এত ভালোবাসিস ? আগে বলিসনি ক্যানে, আগে বলিসনি ক্যানে ? চোখের জল বাঁধ মানে না, হু হু করে ডুকরে কেঁদে ওঠে লতিফা।
 
দূরে দাঁড়িয়ে জসিম গভীর বিস্ময়ে দেখছে তখন, ভেজা নতুন লাল শাড়িতে অশ্রুসিক্ত লতিফার ডানহাত চেটে চেটে তার দেয়া খাবারগুলো খাচ্ছে কোকিলা। আর বামহাতে লতিফা কোকিলার গায়ে, গলায় বুলিয়ে দিচ্ছে আদর।
 

♦•♦♦•♦–♦•♦♦•♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!