- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জুন ৮, ২০২৫
মফস্বলের ঘর-গেরস্তি

এমন বেঘোর সংসার আর কারো নেই, যা আছে তা বললে মাথা ঠান্ডা রাখা দায়। ঝাড়া হাত-পা। ইচ্ছে করলে যেদিকে খুশি চলে যেতে পারে। নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, সে একা না, বোকা ? সংসার যেন এক যাত্রাপালার আসর।যে যার মতো সং সেজে থাকো। পাঁচটা হাঁস তারা সামনে দলিজপুকুরে চরে বেড়ায়। তিনটে ছাগল আদাড়ে বাদাড়ে ঘোরে।একমাত্র ছেলে গায়েগতরে বেড়েছে। স্বামী শুয়ে আছে বিছানায়। এই নিয়ে আজমিরার সংসার।
কারুর কোনো দায়িত্ব নেই। হাঁস ডিম পাড়ে না। ছাগল বিয়োয় না। বিএ ফার্স্ট ইয়ার পড়া আধা জোয়ান ছেলে কাজের নামে তামাশা করে। মোকিম অর্ধেক দিন কাজে যায়, আবার অর্ধেক দিন যায় না। যেদিন ভাঁটায় ইঁট বইতে যায়, সেদিনের টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কেনে। তাহলে সংসার চলে কীভাবে ? খোদা চালায়। এ কথায় ভরসা করে বেরিয়ে পড়তে হয়।
সকালে সবার উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে পথে নামতে হয়। দুয়ারে ব্যবসা, এই তার কাজের নীতি।
সকাল ন–টা বাজে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আশেপাশের পাঁচ পাঁচটা গাঁ ঘুরতে হয়। ফাগুন মাস, সর্বনাশা আগুন জ্বলছে চারিদিকে। একে কি বসন্তকাল বলে ? রাতে ঘরের মানুষ তার ওপর চড়াও হয় বটে, তাতে ভালোবাসার চেয়ে গাঁজার গন্ধ বেশি। ঠেলে সরিয়ে দেবে ? তাতে স্বস্তি। এ সব শাস্তি কি তার পাওনা? এমন করে ফুরিয়ে যেতে হয়। চোখের পানি চেপে রাখে। হেরে যেতে যেতে কোথাও হেরে যেতে নেই।
সাইকেলের চাকা এগোয় না—পেছন টানে। কতদিনের পুরনো কথা। জীবন তখন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়ায়। সবকিছু ভালো লাগে।ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অন্য এক অনুভূতি জাগে। শরীরের ভেতর তার ভিন্ন এক শরীর জাগে।সেসব আজ কোথায় ! দূরের মরীচিকা।
যৌবন শেষ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। দু–পাড়া ঘুরে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মোহনপুর বটতলায় সাইকেল থামিয়ে বাঁধানো চাতালে বসে। এটা তিন রাস্তার মোড়।বিশাল বটগাছটা ঝিমুনি এনে দিয়েছে। গোপালপুরের দিক থেকে একটা বাইক এসে দাঁড়ায়। খেয়াল করেনি সে।
কেমুন আচিস ?
ঝিমুনির তাল কেটে মুখ তোলে আজমিরা। ঘন কাঁচপাকা দাড়ির ভেতরে আড়াল করা মুখ ঠিক ঠাহর করতে পারে না।ভুরু কুঁচকে তাকায়।হয়তো না চেনার ভান করলে ভালো হয়।
চিনতি পারলি নে ? পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসে।
তুমি ! এবার তো চিনতে হয়।
আমি তোর কাচেই যাচ্চিলুম।
আমার কাচে ? তা কি আজগের কথা ! মুহূর্তের মধ্যে দেড় যুগ পিছিয়ে যায় সে। ধাতস্থ হতে সময় নেয়। হঠাৎ দেখা হয়েছে, সত্যি কি তার কাছে যাচ্ছিল? ধন্দে পড়ে যায় আজমিরা। আজকাল অবশ্য কোনোকিছুতে থির হতে পারে না। সবসময় আগুপিছু দ্বন্দ্ব মনের ভেতর খেলা করে।
হ্যাঁ ! মেয়েডার বে দিচি। ছেলেডারে ঘরে ফেরাব। তোর কোনো আপত্তি নি তো ?
আমার আবার আপত্তি ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
তোর যদি আপত্তি থাকে, তো বলিস। আমি সালিশ পঞ্চায়েত করতি চাইনে। আপসে যা হবে, তাই হোক। এই লে ফোন নম্বর দে যাচ্চি, তুই তার সঙ্গে কথা বলে আমারে জানাবি। একটা চিরকুট এগিয়ে দেয় আশরাফ মণ্ডল।
আমি পারব না। আজমিরা শক্ত হয়।
তোর জেদ একোনো গেল না।
এতদিন পর এসব কথা কেন ?
তবে ?
সে এখুন সাবালক হয়েচে।তার চিন্তা আমার ?
আশরাফ কিছু’খন আজমিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘে মেঘে বেলা বেড়ে গেছে। সেই বৌ এখন আর নেই। কোমল মুখের ওপর মেচেতা আর কঠিন কালো ছাপ। এখন সে পরের স্ত্রী। ছেলের ধমনীতে অবশ্য তার রক্ত। এটাই তাকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে। আর কোনো কথা বলে না। সে এসেছিল গোপালপুরের দিক থেকে। ওদিকে তার বাড়ি। বাইক হাঁকিয়ে চলে গেল হাড়োয়ার দিকে—বাজারে। সেদিকে ব্যবসা তার।
কত’খন বসে রইল আজমিরা। আর পাড়া ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। দমকা বাতাসের মতো এ আলাপ–সংলাপ তার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে যায়। সেসব পূ্র্ব জীবনের কথা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিরকুটটা নিয়ে তার হিসেবের খাতার ভাঁজে রেখে অন্যমনস্কভাবে উঠে পড়ে সে।
সাইকেলের চাকা এগোয় না—পেছন টানে। কতদিনের পুরনো কথা। জীবন তখন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়ায়। সবকিছু ভালো লাগে।ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অন্য এক অনুভূতি জাগে। শরীরের ভেতর তার ভিন্ন এক শরীর জাগে।সেসব আজ কোথায় ! দূরের মরীচিকা।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ছোটোমামা সোভান এসে হাজির। ভাগনির দিকে তাকিয়ে চটুল হেসে বলে, বোনাই ! মেয়েরা তো লাউয়ের ডগা! ধকধক করে বাড়ে।
এমুন কথার মানে কী ? মোকসেদমিয়া বলে।
ভাগনির জন্যি সম্বন্ধ এনেচি।
কেমন ঘর বর ?
আমি মুখে কী বলি ? খবর আনলুম, তোমরা দেখেশুনে নাও।
ঠিক আচে। মোকসেদমিয়া মাথা নাড়ে। মেয়ের বাপের কী জ্বালা— আল্লা ছাড়া কেউ জানে না ?
দুদিন গোঁসা করে থাকে আজমিরা। এখন বিয়ে নয়। বেড়াচাঁপার কলেজে পড়বে। তার বান্ধবী সব ভর্তি হয়েছে। এমন ধরাবাঁধা বিয়ে নয়। তার কী অপরাধ ? নিজের পছন্দমতো বেছে নেবে না ? তখন বোঝেনি, এখন বোঝে। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার জন্যে তাদের জন্ম হয়েছে, যেখানে মুক্তি নেই, বাঁধন আছে পাকাপোক্ত।
গোপালপুর পঞ্চায়েতের ঝুরুলি গাঁ। মণ্ডলপাড়ায় পাঁচুমিয়ার একমাত্তর ছেলে।স্বভাবচরিত্রে দাগ নেই। বাপের সাথে হাড়োয়ায় রমরমা কারবার করে।মাছের শুকনো খাবারের বড়ো দোকান। তাদের মেয়ে পছন্দ। মা তার গোঁসা দেখে, আক্ষেপ করলে, ক্লাস এইটি থাকতি আমার বে হয়েচিল। আমি থানার মদ্দি পেথ্থম হয়েচি। হরিণির মতো দৌড়ুতি পারতুম। জেলার দৌড় কমপিটিশানে যাওয়ার আগে গায়ে হলদি পড়ে। আমার যদি হাত থাকত, তাহলে তোকে গোঁসা ঘরে ঢুকতি হতো না ।
সে একথায় সান্ত্বনা পায়।
শ্বশুর শাশুড়ি আর এক ননদ। সংসারে খুব একটা ঝামেলা নেই। ননদের বিয়ে হয়ে গেছে। খোকার বয়েস যখন তিন বছর, তখন গোল বাধল। শাশুড়ি ডেঙ্গু জ্বরে হঠাৎ মারা গেল। কদিন বাদে শোকের পালাও ফিকে হয়। পাঁচুমিয়া আর বাইরে ঘাটে যায় না। আশরাফ কাজকারবার সব দেখাশুনো করে। মা মরেছে, বাপ একটু আলবোলা, আজমিরা টের পেল অন্য ব্যাপার। শ্বশুর সব সময় তার ঘেঁষ নিয়ে বসে থাকে । খারাপ কিছু ভাবে না । সেদিন মেঘলা আকাশ, ঘন বাদলা নেমেছে । খোকা বারান্দায় ঘুমুচ্ছে। কয়েকদিন প্রচণ্ড গরমের পর ঠান্ডা বাতাস বইছে। একটু এলোমেলো চোখে ঘুমের আবেশ । জানালার দিকে পাশ ফিরে আছে । ঘরের দরজা আলগা । একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে ভেতরে ঢোকে। তার গরম নিশ্বাসে ঘোর কাটে । তবে কি ফিরে এল খোকার বাপ ? পাশ ফিরে চমকে ওঠে, আপনি ?
একা ঘরে। তাই দেকতি এলুম !
কী দেকতি এলেন ?
মেঘ ডাকচে । ভয় পাচ্ছ ?
ভয় পেলে আমি তো আপনাকে ডাকতুম ?
সব ভয়ের জন্যি কি ডাকতি হয় ? পাঁচুমিয়ার চোখে নিভে যাওয়া বিজলির ঝলক।
আপনার লজ্জাশরম নেই ? মুখ ধরে আজমিরা।
ছেলে তো বাড়ি নেই।
সে আসুক। তাকে বলচি।
তোর নিজের সব্বোনাশ করবি ?
কী ভেবে বলেছে শ্বশুর, তা ভাবার সময় নেই। ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে সে। এলোমেলো শ্বশুর তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চায়।
অনেক রাতে ফিরেছিল আশরাফ। আজমিরা দোটানায় ঝুলছে। বলবে কি বলবে না ? বাপ আর ছেলের মধ্যে সম্পর্ক সে নষ্ট করে দেবে ? তার কোথাও কি বোঝার ভুল হচ্ছে ? রাতটা জেগে কেটে রইল। সকাল হতে একটা ভয় চেপে ধরে। অজানা আশঙ্কা তার গলায় সাঁড়াশি দেয়। সে আর স্থির থাকতে পারে না। তাকে দিনের কথা খুলে বলতে সে হাই তোলে, তোর কোথাও ভুল হচ্চে।
চটে যায় আজমিরা। তার যে ভুল হয়নি এবার পষ্ট মালুম হয়। ছেলে তো বাপের সুরে কথা বলবে। কানের ভেতর বাঁশি বাজে –এমন সংসারে তার নিয়তি ! চিৎকার করে ওঠে, এখানে বে হওয়াটাই ভুল হয়েচে।
কেন ? আমরা মানুষ না ? আশরাফ গম্ভীর হয়।
মানুষের চিন্তাভাবনা কোথায় ? আমি একটা কথা বললুম তার কোনো বিচার নেই ?
তুই কি চাস ?
সত্যি জিনিসটা স্বীকার করবে না ?
একদিন বাপ বলেছিল, আশরাফ ! মেয়েমানষের রূপ হচ্চে জাহান্নামের আগুন। সেখানেই বাপ হাত বাড়াল ? এ তো বিশ্বাস করা দায় ! সত্যি–মিথ্যে যাচাই করবে কে ? শান্তশিষ্ট আশরাফ তার গোঁ নিয়ে পড়ে রইল। মানুষটা এমনই। যা ভাবে সেটাই তার কাছে সত্যি।
আজমিরা গুম মেরে রইল। এভাবে এদের হাতে নিজেকে বিকোতে পারবে না। খোকাকে কোলে নিয়ে পরের দিন বাপের বাড়ি। ওদিকে বাপ ছেলের কানে বিষ ঢালে। দুকলম লেকাপড়া শিকেচে বলে এত দেমাক ? তুই ভেবে দ্যাক ! আতান্তরে পড়েছে আশরাফ। একদিন বাপের চোখ এড়িয়ে সেখানে পৌঁছে গেল। আজমিরা নিজের সম্ভ্রম থেকে সরে এল না। সে বাজারের মেয়েমানুষ না।
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে অপমানিতবোধ করে আশরাফ। তাকে নিয়ে অনত্র ঘর বাঁধতে হবে ? মেয়েমানুষের এমন হুকুমদারি ? এমন বাড় ? আর বাপ তার কী করেচে ? অনেক সময় মেয়েমানুষ দড়িকে সাপ ভাবে। বাপ তার বড়ো খুঁটি। তাকে নড়িয়ে ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়াবে ? মন স্থির করে সে। মুখোমুখি পারে না। এমন অমোঘ কথা কি সরাসরি বলা যায়? তার মুখ মাঝে মাঝে চোখে ভাসে। দুদিন পর ফোনে তালাক শুনিয়ে দেয় আশরাফ।
সত্যের এমন অপমৃত্যুতে শোক কাটাতে এক সপ্তা সময় লাগল। ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করে ভাবল, খোকাকে নিয়ে এভাবে জীবন কাটাবে। সংসারের সাধ মিটেছে। বেশ বুঝতে পারে, সংসারের ভিত্তি ছলনা ছাড়া কিছু না।
হাড়োয়া বাজারে সে এক সেলস গার্লসের চাকরি নেয়। এভাবে চলে যাবে। বাপ মা যতদিন ছিল ততদিন। তারা গত হতে সংসার আবার নতুন ভেলকি দেখায়। ঘরে যন্ত্রণা বাইরে যন্ত্রণা। তালাক পাওয়া মেয়ে সংসারের আবর্জনা, লোভনীয় বেওয়ারিশ মাংস পিণ্ড।
অন্যমনস্কভাবে সে বাড়ি ফিরছে। কাছে পৌঁছে দেখে, খোকা পাশের বাড়ির মেয়ে রুমকির সাথে আড্ডা মারছে। গা পিত্তি জ্বলে গেল। মেয়েটা তাকে দেখে আতাগাছের আড়ালে গা ঢাকা দেয়। অন্যদিন হলে সে তুলকালাম বাধাত, আজ আর কিছুতে মন নেই। সাইকেল উঠোনে রেখে মাল ভর্তি থলে দুটো ঘরে নিয়ে তুলবে, এমন সময় খোকা বলে, তুই যে তাড়াতাড়ি ফিরে এলি !
তোর যে অসুবিধে হয়েচে সে তো বুজতি পেরেচি। আতাগাছের দিকে তাকিয়ে বলে আজমিরা।
সে কথা বলিনি।
তবে ?
আজকাল হাঁপাতে দেকি। তোর শরীল ঠিক আচে তো ?
খুব যে আমার ওপর খেয়াল রেকেচিস ! খোঁচা দিয়ে বলল আজমিরা।
সে তো রাকতি হয় ! মায়ের কটূক্তি গায়ে মাখে না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোর সঙ্গে একটা দরকার ছেলো।
বুজেচি।কী করবি ? কত লাগবে ? মনে দাগা লাগে, টাকা ছাড়া তোর সঙ্গে আর কি সম্পর্ক ?
ফোন কিনব।
চট করে মাথা গরম হয়ে যায়। নিজেকে সংযত করে বলে, একটা তো রয়েচে।
ওটা ভালো না। নোতুন একটা কেনব।
তোর বাপের কাচে যা।
তুই একটা কথা বললি। বাপ, বাপ কেডা ?
কেন ? তোর কেউ নেই ?
জবাব দেওয়ার আগে খোকার মোবাইল বেজে ওঠে।ফোনে কিছু কথাবার্তার পর মায়ের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
এতক্ষণ টের পায়নি। উঠোনের পশ্চিম গা–য় রান্নাঘর। সেদিকে পা দিতে উৎকট গন্ধ টের পায়। এদিক–ওদিক তাকাতে নজরে পড়ে খাঁ পাড়ার হেবোর সঙ্গে কলকে হাতে বসে সে। ছাগলঘরের দখিন কোণটা তারা বেছে নিয়েছে। দৃশ্যটা অসহনীয় নয়। তবু ইশারা করে।
আজগে কাজে যাওনি ?
শরীলডায় তেমন জুত নেই।
মেজাজ চড়ছে। তবু সীমানা রেখে বলে, গাঁজা টানলি শরীলি জুত আসে !
ঠিক বলেচিস। হলদে দাঁত বের করে হাসে মোকিম।
ঘৃণা করতে পারে না । গালমন্দ করতে পারে না । নিস্পৃহতা তাকে গ্রাস করে। অকারণে হেসে ওঠে। বেশ তো ! এ সংসারে তার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই, সে সবার মাথায় চড়ে বসে আছে। সবাই তা লক্ষ্যে অলক্ষ্যে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে তৃপ্তি আসে ? সে নিঃসঙ্গবোধ করে। কারোর সঙ্গে মনের কথা খুলে বলতে পারে না। মোকিমের সাথে বলতে গেলে খোকার কথা এসে পড়ে। যেন কোনো প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই। মোকিম দয়া করে মা ছেলেকে ভেসে যেতে দেয়নি। শুধু কি তাই ? তার শরীর মাঝে মাঝে জেগে ওঠে না ?
সে-সব বাসি দিনের কথা। বাপের তুল্য জুল্লু বলে, তোকে ঘরদোরের ভাগ দিয়েচি, আর পাহারা দিতি পারব না।
তাহলি কী করতি বলো ?
আমার কথা মতুন চলতি হবে।
বলো কী কথা ? মনে মনে গজগজ করে। তোমাদের কথা শুনে তো এ অবস্থা।
জুল্লু যা বললে তা শুনে কানে আঙুল দেয় আজমিরা। বলে, ওমুনটা বলো না ভাই।
আশরাফ আমার কাছে এয়েছেল। বাপের স্বভাব যে ভালো না, সে বুজতি পেরেছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। যাকগে ! শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে। তার নয়, সত্যিকথার। যে মানুষটা তাকে বিশ্বাস করল না, পরে যে আবার তাকে বিশ্বাস করবে সে নিশ্চয়তা কোথায় ?
বড়োভাই ! তোমার একথা মান্যি করতি পারব না।
তোর অসুবিধে কোথায় ?
অন্য জায়গায় বিয়ে করে আবার তালাক লিতি হবে ?
আমি সব ব্যবস্থা করব।
বেশ তোমার ইনসাফ।
কেন ?
কথাটা বলে কী করে ? পাপ হবে না ? তবুও মিনমিন করে, দোষ করল একজন, আর শাস্তিভোগ করবে অন্যজন ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জুল্লু। বোনকে ছোটোবেলা থেকে কোলে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। মায়া–মমতা ক্ষীণ হয়ে এলেও একেবারে শুকিয়ে যায়নি। সে এবার ঠান্ডা মাথায় বলে, তাহলি কী করতি চাস ? বুজিস তো—তারপর গলা নামিয়ে বলে, আমারও তো সংসার করতি হবে। মেয়েরা তো মেয়েদের শত্তুর!তোর ভাবি—চুপ করে যায় সে।
আজমিরাও ভাবতে থাকে। তারপর মাথা তুলে বলে, তোমার কাচে অনুরোধ। বিয়ে যদি দাও, তবে ছাড়ান কাড়ানের ব্যবস্থা করতি হবে না।
আশরাফ জুল্লুর সঙ্গে বার কতক কথাবার্তার পর বুঝেছে যে, ভাঙা আয়নার মতো ভাঙা সংসার আর জোড় খায় না । বাপ আবার বিয়ে করেছে। সে ভিন্ন হয়েছে। কিন্তু একা কি বাঁচা যায় ? আজমিরার আশা ছেড়ে দিয়ে নতুন করে সংসার পাতে । মা যেখানে নেই তার খুদকুঁড়ো নিয়ে আর অশান্তি কেন? খোকাকে আর ফেরত নেইনি।
এমনিতে বাতিল মেয়েমানুষ, তার ওপর লেজুড়। ভালো ঘরবর জোটে কি ? তবুও যৌবন শেষ হয়ে যায়নি। শেষ অবদি নশিবে আদমপুরের সরকার পাড়া। মোকিমও কলঙ্কহীন না। সংসারে তার বুড়ি মা। শাশুড়ি বৌয়ের খিটিমিটিতে শেষ পর্যন্ত ঘর ছাড়ে বৌ। মোকিম পণ করেছিল মায়ের দাফনের পর বিয়ে করবে। মা তাকে বিয়োয়েছে। ঘরছাড়া কী করে করবে ?
একদিক দিয়ে ভালো হল। চাকরি তাকে ছাড়তে হতো। মালিকের কুনজর ছিল। তাছাড়া আটটা থেকে রাত দশটা ডিউটি। শত ছিন্ন হলেও তো সংসার। কে না চায় তা টিঁকে থাকুক ! তার মতো ঘর পোড়া মেয়েমানুষের দায়টা আরো বেশি। তবে সবকিছু বিফল হয় না, অভিজ্ঞতাটুকু কাজে লেগেছে।এই বিয়ের পর সেলস গার্লসের চাকরি ছেড়ে হকারি নিয়েছে।সময় কমেছে। সকাল ন’টা থেকে জোহর পর্যন্ত। মেয়েদের ছোটোবড়ো জামা নিয়ে ফেরি করে।
বেলা গড়িয়েছে। খোকা ফিরে আসেনি। মোকিম গান্ডেপিন্ডে গিলে উঠোনে আমতলার মাচায় নাক ডাকিয়ে বেহুঁশ। হাঁসগুলো প্যাঁকপ্যাঁক করতে করতে ফিরে এসেছে। তারা গাদাগাদা মালসায় ভেজানো খুদকুঁড়ো সাবাড় করছে। ছাগল তিনটে গাদাগাদি করে ফ্যানের বালতিতে ঠোকাঠুকি করে মাথা গলাচ্ছে।
সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে এল খোকা।
এত’খন কোথায় ছিলি ?
সে কোনো জবাব দেয় না। দলিজ পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে বলে, ভাত দে মা !
কী এমুন কাজ করে এলি যে ভাত দিতি হবে ?
লোকডার সঙ্গে দেকা হয়েচে, কই আগে বলিসনি তো ?
কোন লোকডা ?
আমার সাথে নকশাবাজি হচ্চে ?
তুই এমুনভাবে কথা বলচিস কেনো ! তোকে পেটে ধরে অপরাধ করেচি !
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে আশরাফ আরো অনেক কথা বলেছে। তার ব্যবসা অনেক বেড়েছে। একমাত্তর মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। তার এতসব কে ভোগ করবে ? বৌ সামেনা বোরখা পরে। এ জগৎ থেকে সে নিজেকে আড়াল করতে চায়। তাহলে কার সঙ্গে তার চলাচলতি ? অচেনা লোকের মতো এসব কথা শুনে গেছে আজমিরা। কোন তাপ উত্তাপ জাগেনি। ছেলের কথাবার্তায় ভেতরে ক্ষরণ শুরু হয়।
আজ রাতটা বড়ো অদ্ভুত। গভীর নিশীথে মোকিম ফিসফিস করে। আজমিরা বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার আবার কী হলো ? আজকে সে বড়ো আপনহারা। তার সত্তা খণ্ড-বিখণ্ড।শরীর মন কোনোকিছুতে সাড়া দিতে চায় না।
খোকা সাঁজের ম্লান আলোয় মায়ের মুখের দিকে তাকায়। সেখানে কি কোনো বেদনার ছাপ ? ঠিক বুঝতে পারে না। নিচু গলায় বলে, সালাম আমাকে ফোন করে ডেকেলো। বললে, একটা লোক তোর সঙ্গে কথা বলতি চায়। আমি ভাবলুম কাজের কথা বলতি চায়। কত লোককে তো বলা আচে।
আজমিরা জবাব দেয় না। নিঃশব্দে বারান্দায় ভাত বেড়ে যায়। এটাই যেন তার প্রধান কাজ। ভেতরের রক্তাক্ত হৃদয়ের উন্মোচন সে চায় না।
কী হোলো ! আমার কথা শুনতি পাচ্চিস নে ? ওই যে সালাম যার সঙ্গে থানায় সিভিক পুলিশির ফর্ম জমা দিচি।
বল ! শুনচি !
সালাম আমারে গাং–এর ধারে একটা নির্জন ক্যাওড়াগাছের কাচে লে যায়। দেকি সেখানে একটা লোক দেঁড়িয়ে আছে। সালাম বললে, আমার দূর সম্পকের আত্মীয়।
তাহলি আমাকে ডেকেছিস কেন ?
কী বলে শোন !
লোকটা এবার গলা ঝেড়ে বলে, খোকা ! তোমার খায়েশ কী ?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, আপনাকে তা বলব কেন ?
আহা ! বলেই দেকো না।
আমি একটু ইতস্তত করি। মাথাডা কেমন গুলিয়ে গেল। বললুম, একটা ফোরজি ফোন।
কত দাম হবে ?
চল্লিশ হাজার টাকা।
আমি যদি দেই ?
আপনি দেবেন কেন ?
তোমার মা–র সাথে কথা হয়েচে।
কী কথা ?
বাড়ি গেলি জানতি পারবে।
যতখন জানতি না পারি ততখন আপনার দান আমার চাইনে।
ধরো ! আমি যদি তোমার পরমাত্মীয় হই !
এতদিন যারে চিনি নি সে পরম কুটুম হয় কী করে ?
রক্তের সম্পক্ক যদি থাকে ?
শুধু থাকলে কি হয় ? তাকে টিকিয়ে রাকতি হয়। এই কি সেই লোক যার কথা কানাঘুষোয় শুনেছে ? মা কখনো খোলসা করে বলেনি।
ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আজমিরা। খোকাকে শুধু খোকাই মনে করেছে। মেঘে মেঘে তার যে বয়েস বেড়েছে। সে আনমনা কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করে, তা এখুন কী করবি ? তুই তো বড়ো হয়েছিস ?
তুই কি আমাকে পর করতি চাস ?
অত টাকা দিতি পারব না।
কে চেয়েচে তোর কাচে ?
এই তো সকালবেলা বললি।
ফোনে আমার ম্যাসেজ এয়েচে। কাল থানায় দেকা করতি হবে।
কেনো ? একটু যেন ভীত হয়। ছেলেটা কোথায় কী করে রেখেছে কে জানে ?
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মজা পায়। বলে, সেসব কিচু না। সিভিক পুলিশে কাজ পেয়েচি। কালকে বড়োবাবুর সঙ্গে দেকা করতি হবে। মনের মতো কাজ পালি কে আর নতুন ফোনের বায়না করে ?
আজ রাতটা বড়ো অদ্ভুত। গভীর নিশীথে মোকিম ফিসফিস করে। আজমিরা বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার আবার কী হলো ? আজকে সে বড়ো আপনহারা। তার সত্তা খণ্ড–বিখণ্ড।শরীর মন কোনোকিছুতে সাড়া দিতে চায় না।
খোদার কসম ! কাল থেকে সব বাদ দিলুম।
জ্ঞান হলি তো ভালো।
খোকাই তো জ্ঞান দেলে।
কী রকম ? আজমিরা এদিকে ফেরে।
রক্তের সম্পক্কডা বড়ো কথা না।মানুষের সাথে জুতে থাকাটা কুটুমের লক্ষণ। সুখে দুখে তাকে জাগিয়ে রাকতি হয়।
পরদিন সকালে হাঁসের ডোব খুলে হতবাক হয় আজমিরা। পর পর পাঁচটা ডিম সাজানো সেখানে। ছাগলের ঘর খুলতেই তারা ডাকতে ডাকতে অন্যদিকে ছুটল। বোধহয় ওদিকে কোনো পাঁঠা চরছে। কাজে যাওয়ার সময় মোকিম আবার শপথ করলে, গাঁজা আর লটারির টিকিট ছোঁবে না। একটু বেলায় মায়ের সাইকেল নিয়ে থানার দিকে বেরিয়ে গেল খোকা।
আজ বেরোতে পারেনি। এখনো সকালের সূর্য কিশোর-রেখা পার হয়নি। একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে বেরোতে পারে কিন্তু ইচ্ছা নেই। শূন্য ঘরে বারান্দায় সে পা ছড়িয়ে বসে। সংসার কি এমন হয় ? পরস্পরের মধ্যে শেকড় ছড়ায় ? এতদিন বোধহয় টের পায়নি। ভারি মেঘ যেমন বৃষ্টি ঝরিয়ে পৃথিবীকে নতুনভাবে চেনায় তেমনি আজমিরার দু–চোখের পাতা ভারি হয়। বিবর্ণ সংসার সবুজ রূপ ধারণ করে।
কিছুক্ষণ বাদে কী মনে করে উঠে পড়ে। ঘরে ব্যাগ রাখা আছে। ফোন হাতে চিরকুট বের করে, হ্যালো— হ্যালো—
খোকার কথায় সে কি বিভ্রান্ত ? যাচাই করে নিতে চায় ।
ওপার থেকে ভেসে এল, বল্—
খোকার সাথে কথা হয়েচে ?
কোন খোকা ?
যাকে ফেরত নিতে চেয়েচ।
এ তো সে না, যাকে আমি চিনি। অথবা সম্পক্কে ছ্যাতলা ধরেচে। আমার কোন দাবি নেইকো।
ফোন রেখে নিশ্চিন্ত হয় আজমিরা। বেলা বাড়ছে।কাজে মন দেয়। তবু এক সময় গভীর বেদনা জাগে। বেদনার ঘনঘন আওয়াজ বাজে বুকে, আজমিরার শূন্যতায়।
♦–♦•♦–♦•♦–♦•♦–♦
❤ Support Us