- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ১১, ২০২২
আপনাকে ম্যাক ডাকছে
একজন মাঝ বয়সী লোক হর্ণ দেওয়ার পর তড়িঘড়ি ঠেলে ওঠে, অদ্ভুত চেহারা, ডান চোখটা পাথরের। অনেকটা ভুতুরে গোছের, দাঁতের মাঝে নিয়ত গুটখা বা লাল রঙের কিছু খাওয়ার বেশ পুরানো ও জেদি দাগ
অলঙ্করণ: দেব সরকার
অফিসের কাজ প্রায় শেষ, এবার অপেক্ষা ড্রাইভারের। হঠাৎ বাবু জানায়, সে আসবেন না, গাড়ি মাঝপথে খারাপ হয়ে গেছে। অধিক রাতে ক্যাব কলকাতার বাইরে যেতে চায় না। অনেক কষ্টে একজন রাজি হলেও লোকেশন শোনার পর শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দেয়।ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। শ্রিয়া অগত্যা মিটার ট্র্যাক্সি ধরে শিয়ালদাহ পর্যন্ত এল। বর্ধমান লোকাল রাত বারোটা দশে, এখনও মিনিট দশেক বাকি। যাতায়াতের জন্য তার বরাবর লেডিস কামরা পছন্দ, কিন্তু যাত্রী সংখ্যা একেবারে কম দেখে সে জেনারেল বগিতে ওঠে।
কামরার এক কোণে একজন ভদ্রলোক ছাড়া সে কাউকে দেখতে পেল না। শ্রিয়া ঠিক তার উল্টোদিকের সিটটা বেছে নেয়। তারপর ব্যাগের চেন খুলে তার প্রিয় উপন্যাস টেনে বের করে।ভদ্রলোকের চোখ তার দিকেই ছিল, লেখকের নামটা তিনি বেশ কয়েকবার পড়েন। পরিচিত নাম নয়। সে কারণে দৃষ্টি সরিয়ে ইমোজি স্টাইলে হাসি রেখে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় যাবেন ?’
‘বর্ধমান!’
‘এতো রাতে অফিস থেকে ফিরছেন বুঝি, কোন সেক্টরে আছেন?’
‘আই টিতে আছি, লেট প্রায়ই হয়। মাঝে মধ্যে কোম্পানির গাড়ি ছেড়ে দিলেও রোজ সে ভাগ্য হয় না।’
‘বেশ বেশ।’
‘আপনি?’
‘আমি কর্ণেল শিবপ্রসাদ, বর্তমানে অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত ! সারাদিন ঘরে বসে সময় কাটে না, মাঝে মধ্যে শহর ঘুরতে বার হই!’
শ্রিয়া আর কথা না বাড়িয়ে গল্পের বাকি অংশ গিলতে শুরু করে।এই নিয়ে এিশ বার পাঠ চলছে ,অদ্ভুত এক ভালোলাগা জন্মে গিয়েছে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর প্রতি – “পরি বিয়ের মন্ডপ ছেড়ে ছুটে যায় কমলের কাছে, ভোজালির আঘাতে তার সমগ্র নিথর শরীর ক্রমে ক্রমে হিম ও শক্ত পাথরের মতো হয়ে আসছে। ধবলগ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা পরির এই দুঃখের সঙ্গী…
ট্রেন দমদম জংশনের এসে পৌঁছায়। একজন মাঝ বয়সী লোক হর্ণ দেওয়ার পর তড়িঘড়ি ঠেলে ওঠে, অদ্ভুত চেহারা, ডান চোখটা পাথরের। অনেকটা ভুতুরে গোছের, দাঁতের মাঝে নিয়ত গুটখা বা লাল রঙের কিছু খাওয়ার বেশ পুরানো ও জেদি দাগ। শ্রিয়া এক নজর তাকে দেখে,অনেকটা মিল রয়েছে কপিলের সাথে- পরিকে পাওয়ার জন্য সে কমলকে হত্যা করেছে।
ট্রেনের গতিবেগ বাড়ে। শোঁ… শোঁ… শব্দটা আরও জোরালো হয়। ওদিকে পরি পরিকল্পনা করে প্রতিশোধের-হত্যার বদলে হত্যা। কপিলের ধারণা ছিল পরির মতো একজন সাধারণ মেয়ে তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না…
হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।সমগ্র কামরা জুড়ে অদ্ভুত সব শব্দের আনাগোনা, সঙ্গে চিৎকার।যেন কয়েকজন দানব পুরো বগিতে দাপাদাপি করছে। হঠাৎ তরল জাতীয় কিছু পান করার ঢগ ঢগ শব্দ কর্ণেলের কানে আসে
লোকটি শ্রিয়াকে দেখে অজানা এক ভাষায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে। তার কিঞ্চিৎ শ্রিয়ার কানে প্রবেশ করতে সে আরও একবার লোকটির দিকে তাকায়।
লোকটি তাকে বলে ‘এতো রাতে ট্রেনে চড়তে তোমার ভয় করে না ?’
শ্রিয়া তখন পুরোপুরি উপন্যাসের চরিত্রে। তার কথা কানে ঢুকলেও গুরুত্ব পায় না। উত্তর না পেয়ে সে কর্ণেলকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি ওঁর সঙ্গে আছেন ?’
‘না, তবে আপনার এত আগ্রহের কারণ আমি বুঝতে পারছি না।’ ‘বিরক্ত হবেন না… ভয় দেখাতে আমার বরাবর মজা লাগে। অনেকটা সেই ব্লু হোয়েল গেমের মতো। একটু বেহায়া গোছের হাসি দিয়ে আবার সংযুক্ত করলো, ‘কিছু মনে করবেন না, মজা করলাম।’
কর্ণেল ধরে নেয় লোকটি নির্ঘাত সাইকো, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।সে চুপ হল বটে, পকেট থেকে মোবাইল বের করে এক অদ্ভুত ধরণের মিউজিক চালিয়ে তাল মেলাতে শুরু করে। কানে লাগার পর বিরক্তি তৈরির জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল, কর্ণেল সিট পরিবর্তন করলেও শ্রিয়া কিন্তু মশগুল পরির প্রতিশোধের অধ্যায়ে।
পরবর্তী স্টেশনে দুজন কলগার্ল দুই গ্রাহক নিয়ে কামরায় হাজির হয়। লোকটি মেয়ে দুটির আপাদমস্তক দেখার পর জিজ্ঞাসা করে, ‘কোন হোটেলে যাবেন ?’
ওদের মধ্যে একজন বলে ‘আপনার জেনে কি লাভ, যাবেন নাকি ?’
বিদঘূটে হাসি হেসে সে বলে ‘টিকিট কেটেছেন!’
‘আমাদের টিকিট লাগে না, সব ফ্রি।’
‘টিকিট দেখান !’
ওদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ জোর গলায় জিজ্ঞাসা করে, আপনি টিটি নাকি, আপনাকে কেন দেখাতে যাব ?
‘শাস্তি পেতে হবে… শাস্তি… হা হা হা !’
‘কীসের শাস্তি ? আর কে দেবে ? আপনি?’ কোথা থেকে চলে আসে কে জানে,যত্তো সব।
লোকটি হাসি থামায় না, তারা কামরা পরিবর্তন করতে চাইলে লোকটি তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা করে, ওদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। কর্ণেল দুপক্ষকে ধমক দিয়ে বলেন, এসব কী করছেন ?
আপনারা শান্ত হয়ে বসুন !
শ্রিয়া উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে।হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন।সমগ্র কামরা জুড়ে অদ্ভুত সব শব্দের আনাগোনা, সঙ্গে চিৎকার।যেন কয়েকজন দানব পুরো বগিতে দাপাদাপি করছে। হঠাৎ তরল জাতীয় কিছু পান করার ঢগ ঢগ শব্দ কর্ণেলের কানে আসে, রক্ত নিশ্চয়। হা হা রক্ত- মনে হতেই কণের্ল তড়িঘড়ি মোবাইলের টর্চ অন করে। কামরায় শ্রিয়া ছাড়া আর কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না।
কিছুক্ষণ পর লাইট আসে। লোকটিকে দেখা যায় মুখ নাড়তে নাড়তে সিটের দিকে এগিয়ে আসছে, তার ঠোঁটের একধারে লাল রক্তের মতো কিছু লেগে আছে। কর্ণেল একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করার পর জিজ্ঞাসা করেন, ‘ওরা কোথায় ? কী করেছেন ওদের সাথে ?’
কোনো উত্তর নেই। লোকটি শুধু বিকট হাসে, হা হা হা… কর্ণেল কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগেই বাংকারের ওপর থেকে রক্ত টুপিয়ে টুপিয়ে পড়ে তার হাতে উপর। কর্ণেল উঠে দাঁড়ান, যে মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে ওর সাথে তর্ক করছিল তার মৃতদেহ। গলার কাছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দুটো দাঁতের দাগ-এতো মানুষের নয় কোন দানবের কাজ !
শ্রিয়া বলল,’ড্রাকুলা !’
‘একদম,তাহলে এই ব্যক্তি… কর্ণেল তারদিকে এগিয়ে যান।কিছুক্ষণ তার চেহারা নিরুক্ষণের পর বলেন, ‘আপনি এটা ঠিক করেননি !’
লোকটি বিকট হাসতে থাকে-হা হা হা…
কর্ণেল আবারও জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেন ওদের মারলেন ?’
‘ধূর মশাই, আপনার কি মনে হয় আমি ভূত নই, পিশাচ? চার-চারজনকে একসাথে মেরে মুহূর্তেই হাপিস করে ফেলবো… একটু মজা করতে ভালোবাসি, হা হা হা !
তবে ভীতু লোক আমি একদম পছন্দ করি না… এই বগির শেষাংশ দেখছেন, ওখানেই ওরা ম্যাকের গলায় ছুরি ধরে তার প্রথম মাসের মাইনেটুকু কেড়ে নেয়। যাওয়ার সময় পেটে ছুরি ঢুকিয়ে যায়… আই হেট বাস্টার্ড ভীতু ম্যাক। শালার কোনো মুরোদ নেই !
‘ও আপনি তাহলে সেই ম্যাক অথবা ম্যাকের অতৃপ্ত আত্মা।’
‘গল্প পড়তে পড়তে আমি ম্যাক হয়ে গেলাম ? ও আমার বন্ধু ছিল। ব্যাটা আমার বাড়িতে গিয়ে হাজির। কী করতাম, হাতে নেই টাকা, রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। তারপর, লাশটাকে রেলের পাটিতে রেখে যাই। শালা ঘুমোতেই দেয় না,অনেকেই নাকি রাতের ট্রেনে ওর আত্মাকে দেখেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব
‘আর ওরা চারজন ?’
‘চিনি না, এই প্রথম দেখা !’
‘গভীর রাত, অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেঙে পরি রক্তাক্ত পায়ে হেঁটে চলেছে। হাতে তার সিদুঁর মাখা খড়্গ, আজ কপিলের পর্ব শেষ হতে চলল !
লোকটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে শ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টি কর্ণেলের ভালো লাগল না,নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আটছে।আকস্মাৎ লোকটি তার দিকে এগিয়ে আসতে কর্ণেল বললেন, ‘আপনি ওকে টাচ করবেন না।’
কর্ণেলের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে লোকটি শ্রিয়ার দিকে হাত বাড়াতেই কর্ণেল তার হাত চেপে ধরলেন। লোকটি কর্ণেলের দিকে তাকিয়ে তার ভয়ঙ্কর হলুদ রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়। আপনি… আপনি কে? আমাকে ছেড়ে দিন। আমি কোনো দোষ করিনি ! বিশ্বাস করুন আমি শুধু ম্যাককে খুঁজতে এসেছি।’
তৃষ্ণার্ত কর্ণেল তার কোন কথায় গুরুত্ব না দিয়ে লম্বা দাঁত দুটো লোকটির গলায় বসিয়ে দেন।তারপর,গম্ভীর স্বরে বলেন,’আপনাকে ম্যাক ডাকছে……!’
পাঠ শেষ, শ্রিয়া কর্ণেলের দিকে তাকিয়ে হাসে, তারপর,তৃপ্তি সহকারে বলেন, ‘আজ সত্যিই কপিলের মৃত্যু উপভোগ করলাম !’
‘আমাকে দেখে ভয় লাগছে না ?’
‘কার্গিল যুদ্ধের সময় শহিদ তালিকায় আপনার নাম এবং ছবি পেপারে দেখেছিলাম, শহিদ কর্ণেল শিবপ্রাসদ দত্ত !
আমাকে নামতে হবে, চলি।আপনার উপকার মনে থাকবে।’
স্টেশনে নামতেই শ্রিয়ার সারা শরীর হলুদ আকার ধারণ করে। সামনের দিক থেকে বেরিয়ে আসে বড়ো দুটো দাঁত। স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাঁ চোয়ালের পাশ থেকে গড়িয়ে পড়া টাটকা রক্ত !
♦–♦–♦–♦
❤ Support Us








