শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
চিত্র: দেব সরকার
রামচরণ পরম স্নেহে কাপড়ের টুকরো দিয়ে আস্তে আস্তে ধুলো ঝাড়ছেন। ভাবখানা এমন যেন পাছে ব্যথা না দিয়ে ফেলেন। সকালের নরম রোদ এসে উঠোনে পড়ছে। এককোনে পেয়ারা গাছ ডালপালা মেলে আকাশের সঙ্গে মিতালি করার চেষ্টা করছে। একটা শালিক খাবারের খোঁজে ইতিউতি লাফাচ্ছে, মাঝে মাঝে ঠোঁট দিয়ে মাটিতে মুখ ঘষছে। সুরমা কিছুক্ষণ আগেই ঝাট দিয়ে উঠোনটা সাফ করে গেছে। পেয়ারাডালে একটা কাক কখন থেকে কা কা সুরে গান শোনাচ্ছে। কাকটার দিকে চেয়ে দেখেই আবার কাজে মন দিলে রামচরন। মুখভরা কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো চুলকোচ্ছে। দাড়ি কাটার কথা, আজকাল আর বলেই না সুরমা। রোগা দেহ, জীর্ণ শরীর। কাঠের জোড়া তাপ্পি দেওয়া টুলের উপর বসে, কখনো উপুড় হয়ে আবার কখনো দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। মাঝে মাঝে খুব আস্তে এক-দুবার ট্ রিং ট্ রিং আওয়াজ তুলে বেলটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা লক্ষ করলেন রামচরণ। পাশে রাখা ব্যাগটা থেকে ছোট রেঞ্জ বের করলেন। তারপর প্যাচ ঘুরিয়ে পেছনের চাকাটা টাইট দিলেন। একখানা শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা তেল চেন কভারের ভেতর ছড়ালেন।
উঠোনের উত্তর-পূর্ব কোণে টালির, চাল বসা, দর্মার ঘরটার দিকে একবার পিছন ফিরে তাকালেন। হঠাৎ ঝনঝন করে বাসন পড়ার শব্দ, হকচকিয়ে উঠলেন রামচরণ। উদাসীন হয়ে হাতে ধরা যন্ত্রটা মাটিতে ফেলে লুঙ্গির খোট থেকে বিড়ি বের করে ধরালেন, সুখটান দিতে যাবেন এমন সময়, সুরমা খ্যাঁকিয়ে উঠল — বলি বেলাটা কতো হল, খেয়াল আছে? গা জ্বলে যায় দেখে, আদিখ্যেতার আর শেষ নেই! সেই কোন সকাল থেকে উঠে সাইকেল পরিষ্কার হচ্ছে। শরীরটা তো ভালো নেই সে খেয়াল আছে। খুক খুক করে কেশে উঠলেন রামচরণ। সুরমা আরও কী সব যেন বলছিল, কিন্তু কথাগুলো রামচরনের কানে এসে পৌঁছালো না।
বিড়ি নিভিয়ে, সন্তর্পনে সাইকেলের প্যাডেলটা হাত দিয়ে ঘোরালেন। এরপর তড়িঘড়ি সামনের হ্যান্ডেল দুহাতে চেপে ধরে দু পায়ের মাঝে ধরে চাপ দিলেন। না, পারছেন না! বার কয়েকের চেষ্টায় সফল হয়ে অজান্তেই হেসে ফেললেন। ঠিক তখনই বাইরে বেরিয়ে সুরমা বলল, হাসি দেখো! কাল থেকে সংসারের একটাও কাজ আমি করব না। রামচরণ জানেন, গৃহিণীর মাথায় রাগ চড়েছে। খানিকবাদেই সব ঠিক হয়ে যাবে। গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে সুরমার সঙ্গে একটাও কথা বলেন নি। এতেই সুরমার মাথা গেছে বিগড়ে। কী বলতেন, সাইকেল থেকে পড়ে গেছেন। একথা শুনলে তো সুরমা আরই রাগ করত। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পইপই করে বলে দিয়েছিল—সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে। রামচরণ বুঝতে পারেননি, তাঁর শরীরের জোর কমেছে। ফেরার সময় সাইকেলের প্যাডেলে তেমন জোর দিতে পারছিলেন না। তার ওপর, মাথায় সাত-পাঁচ ভাবনা সারাক্ষনই ঘুরে বেড়ায়।
সাইকেল চালাচ্ছে সুরমা, ঠিকই এগোচ্ছিল, নতুন হাত গর্ত দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করল। ব্যস অমনি টাল খেয়ে গড়িয়ে গিয়ে সামনের বড়ো গাছটায় দিল সজোরে ধাক্কা।
সুরমা উঠোনের একপাশটা আবার ভালো করে পরিস্কার করতে করতে কোমরে জড়ানো শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোন মুছছে। রামচরণ তাকিয়ে আছেন বউয়ের দিকে। সুরমার স্তনগুলো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। চোখ দুটো কোটরে, হাতে-পায়ে শিরা দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সের সুরমা আর আজকের সুরমার চেহারায় আকাশ-পাতাল তফাৎ। গরীব ঘরের সুরমারা, তাঁর সুরমার মতোই সময়ের আগেই শুকিয়ে যায়? রামচরণের চোখের সামনে জলজল করে ভেসে ওঠে পূর্ব ছবি। এখনও সব কিছু জলের মতো। নতুন স্ত্রী সুরমা যখন স্নো-পাউডার, ক্রিম মেখে পরিপাটি হয়ে তাঁর সাইকেলের সামনে বসত, নাভির নীচ থেকে কেমন একটা উত্তেজনা অনুভব করতন রামচরণ। সুরমার শরীরের-চুলের গন্ধ নিতে নিতে পাড়ার মাঠ পেরিয়ে বড়ো রাস্তার নাক বরাবর কত দূর চলে যেতেন। কখনো নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতেন। সূর্যাস্তের আলোয় সুরমার ঠোঁটদুটি আরও রক্তিম হয়ে উঠত। মাঝে মাঝে সুরমা ছেলেমানুষের মতো জিদ করে বলত–আমি চালাব তুমি বসবে! রামচরণের আপত্তি ছিল তিনি জানতেন সুরমাকে সাইকেল দিলেই, ও ফেলে দেবে। একবার হলোও তাই। মাঠের মাঝখানে সাইকেল চালাচ্ছে সুরমা, ঠিকই এগোচ্ছিল, নতুন হাত গর্ত দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করল। ব্যস অমনি টাল খেয়ে সাইকেল গড়িয়ে গিয়ে সামনের বড়ো গাছটায় দিল সজোরে ধাক্কা। রামচরণ ছুটে এসে সুরমা কাছে না গিয়ে আগে সাইকেলটা টেনে তুললেন। এতে তো সুরমার রাগ দেখে কে? দিন দুই রা কাড়েনি। রামচরণ মনে মনে লজ্জা পেলেও বউয়ের কাছে মনের কথা প্রকাশ করেন নি। সাইকেলটার ওপর তাঁর যে কত মায়া তা তো সুরমার অজানা নয়! সাইকেল কেনার পর থেকে চটকলের কাজে গিয়ে দুপয়সা লাভের মুখ দেখেছিলেন রামচরণ। সবই ঠিক চলছিল, বছর না ঘুরতেই জন্ম নিল তাঁদের সন্তান। সুরমা সাধ করে নাম দিল শিবম। সোমবারে জন্ম, তাই খোকার অমন নাম। রামচরণের পোয়া বারো তাঁর ঘরে ছেলে এসেছে। সুরমার দিন কেটে যায় খোকাকে নিয়ে। ছোট ছোট পায়ে দাপিয়ে বেড়ায় খোকা। একদিন রাতে রামচরণের ঘুম আসছিল না। সুরমা ঘুমে মগ্ন। চটকলের মালিক-কর্মীদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। কারখানা যেকোনও দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে!
সুরমার ডাকে আবার হকচকিয়ে গেলেন। সুরমা সাদা থানটা ছুঁড়ে দিল। রামচরণ ধীরে ধীরে ঘরমুখো হয়ে পুরনো খাটিয়াটা কোনক্রমে টেনে টেনে আনলেন। তারপর সাদা থানটা বিছিয়ে দিলেন। সুরমা হাতে বানানো পাপড় গুলো এক এক করে মেলে দিতে দিতে বলল, ঘরে যে টুকু ডাল ছিল তাতে একটাই পাপড় হয়েছে। রামচরণ দেখলেন সুরমা আজও পাপড় শুকোনোর কাজে কত পটু, চটকলের কাজ চলে যাওয়ার পর ছেলের মুখে দুবেলা অন্ন তুলে দিতে সুরমাই এই প্রস্তাব দিয়েছিল রামচরণকে। প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও আস্তে আস্তে সামলে নিযেছিলেন রায়চরণ। সাইকেল চালিয়ে দূরদূরান্তের পাড়ায় গিয়ে বউয়ের হাতের বানানো জিনিসগুলো বেঁচতেন। খুব বেশি লাভ না হলেও চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিপত্তি, সেদিন বাড়ি ফিরে রামচরণ শুনলেন খোকার শরীর ভালো নেই। গ্রামের বদ্যির ওষুধ কাজে দিচ্ছে না। ছেলেটা কেমন যেন ছটফট করছে। রামচরণ আর না ভেবে সুরমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যেভাবেই হোক ছেলেকে বাঁচাতে হবে। সাইকেলের প্যাডেল ঘুরছে। সুরমা পেছনে খোকাকে জড়িয়ে বসে আছে। সদর দপ্তরের হাসপাতালে যখন পড়িমড়ি করে ওরা ঢুকল, ছেলের দেহ তখন নিথর। ডাক্তার বললেন, দেরি হয়ে গেছে। সেই থেকে সুরমার যত রাগ গিয়ে পড়ল ওই সাইকেলটার ওপর। সুরমার বিশ্বাস সেদিন সাইকেলটা যদি আরও জোরে আর দ্রুত পৌঁছতে পারত। তাহলে ওর খোকা এভাবে হারিয়ে যেত না। রামচরণ এই নিয়ে আর কথা বাড়ান না।
এখন এই বাড়িতে তাঁরা দুটি প্রাণী। এখন তাঁদের গ্রামটারও ভোল বদলে গেছে। বাড়ি, দোকানপাট, রাস্তাঘাট সব অন্যরকম। শুধু তাঁরাই যেন কেমন থমকে আছেন।
বেশ কয়েক দিন ধরে খুক খুক করে কাশছেন রামচরণ। মাঝে মধ্যে জ্বর হচ্ছে। দিন-দুই পর গতকাল বেরিয়েছিলেন। ডাল-মশলাপাতি না কিনে আনলে সুরমা পাপাড়, বড়ি দিতে পারবে না। কয়েকটা বাড়িতে পাওনা টাকা তুলে নিতে গতকাল সাইকেল চেপে বেরিয়েছিলেন। সুরমা বলেছিল, ধীরে চালিয়ো। ফেরার পথে সন্ধ্যে নেমে আসবে তা ভাবতে পারেনি রামচরণ। বড় রাস্তার লাইটপোস্ট দিন কয়েক হল খারাপ হয়ে গেছে। গলির মুখটা অন্ধকার।টার্ন নিতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। রাস্তাটা ঢালু, সাইকেলটা গড়িয়ে যায়। ভাগ্যিস ডাল-মশলা সঙ্গে ছিল না। না হলে সব পড়ে গিয়ে আরও ক্ষতি হত।
কোনক্রমে বাড়ি ফিরেছেন, শরীরে তেমন জুত নেই। সাইকেলটার সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তা সারতেই সকাল থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রামচরণ।
দিন দুই কেটে গেল তবু রামচরণের থামছে না। সুরমা চোখের জল মোছে। কাল সারারাত মানুষটা কেশেছে, এখন একটু ঘুমোচ্ছে। গ্রামের বদ্যির নিদান, ভালো পথ্য খেতে দিতে হবে। ভালো পথ্য তো দূরের কথা, আলু সেদ্ধ ভাতই জোটানো দায়। সুরমা কাল সারারাত ভেবেছে। এভাবে আর নয়! মানুষটাকে বাঁচাতে হলে তাকেই কিছু করতে হবে। আর দেরি করেন না সুরমা। কৌটো হাতড়ে খুচরো কয়েনগুলো একজায়গায় জড়ো করে। চটপট শাড়ি ঠিক করে। চোখেমুখে জল দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কী যেন ভাবে। তারপরই সাইকেলটার হ্যান্ডেল ধরে ধীরে ধীরে বাইরে আসে। পূব কোন লাল হয়ে আসছে। সুরমা সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে হাঁটতে থাকে। একসময় প্যাডেল ঘুরিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে। চাকা ঘুরছে। সুরমা এগোচ্ছে, জোরে আরও জোরে।
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34