Advertisement
  • দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
  • ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫

এত ঢেউ, শরীরে শব্দ-সফেন

ইমরাজ হাসান
এত ঢেউ, শরীরে শব্দ-সফেন

পকেট গড়ের মাঠ। তবু বইমেলায় গিয়ে দাঁড়ালেই শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শব্দ-সফেন। রবিবারের সন্ধ্যা, ভিড়ে ইতিউতি ঘুরছেন পৌঢ় পাঠক। গলা শুকিয়ে কাঠ, জল খুঁজতে খুঁজতে অনেকেই উপচে পড়লেন লিটিল ম্যাগাজিন চত্বরে। কবিতা পাক্ষিকের আলোচনা সভায় হাজির তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বাজারের থলি হাতে ভুটানের বদলে চলে এলেন ধুলোমাখা, নন্দিত প্রাঙ্গনে। এলেন সেকালের রবীন্দ্রনাথ, চলে এল জীবনানন্দের অলৌকিক ইস্টিমার। তাহলে, আমরা এতদিন কি ভুল পড়েছি? সবই বানানো, কষ্টকল্পিত! প্রশ্ন উঠলো ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের কোন সংস্করণ কেনা উচিত? জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার কোনটা নকল, কোনটা আসল? তালগোল পাকিয়ে যায় পাঠকের।
 

সাধ থাকলেও সাধ্য নেই – বইয়ের দাম আকাশছোঁয়া, পড়ুয়া মনে অসন্তোষ। এরকম কিছু কিছু প্রশ্নময় অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো এক তরুণ প্রকাশকের বেবাক উত্তর — হ্যাঁ, এই ক্ষোভ আমাদেরও। বই তো পবিত্রতম পণ্য। খেটেখুটে নির্মাণের বস্তু নয়, তার এত দাম হবে কেন? পাঠক বই কেনেন না — এই ফিসফাস ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল — আজকাল অভিযান আনন্দ দে’জ, দীপ পত্রভারতীর সম্মুখে, পাঠকের লম্বা লাইন । আরোপিত সংশয়ের বিরুদ্ধে, বিঘোষিত প্রচারের বিরুদ্ধে এ যেন বিষ্ফোরিত প্রতিবাদ।
 

পুস্তকমেলায় মুস্তাক হোসেন । বেনজির কান্ড অভিযানের । স্টলে স্টলে গহন কমল

 
৩০ জানুয়ারি, সশরীরে না হলেও বাংলার দিকবিজয়ী শিল্পোদ্যগী, অন্যতম শিক্ষাব্রতী মোস্তাক হোসেনের উপস্থিতি অনুভব করল পুস্তকমেলা। তাঁর জীবন, তাঁর দীপ্তি, এবং তাঁর চিন্তায় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে ঘিরে প্রকাশিত হয় — ‘মোস্তাক হোসেন : জীবন ও ঐতিহ্য’। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন নাট্যকার ব্রাত্য বসু আর লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। গুরুত্বপূর্ন পুস্তক । শতাধিক লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ। প্রকাশক উদার আকাশ।
 
স্ফূর্ত, যুক্তিময় আবেগ নিয়ে ওইদিনই অন্যরকম বইবিপ্লবের সূচনা করল অভিযান পাবলিশার্স। একসঙ্গে ১১২ টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন যে সম্ভব, এ অভিব্যক্তি নিঃশব্দ উচ্চরণে জানিয়ে দেন মারুফ হোসেন।
 
টগগবে, ভিড়ঠাসা আবহ আর হালকা বসন্তের আমেজ মেখে শনিবার অপ্রত্যাশিত ভাবে মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর অভ্যস্ত, মৃত্যুহীন হাসি ছড়ালেন মৌ রায়চৌধুরী। আজকাল থেকে প্রকাশিত সেদিন তাঁর গদ্য ও পদ্য সংকলনের মোড়ক খুললেন লেখক কবি আর শিল্পীরা । বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন একজন দিলদরাজ। কে উনি? যোগেন চৌধুরী।
 

স্টলে স্টলে হাজির কবি কমল চক্রবর্তী। বৃক্ষনাথ ছড়িয়ে আছেন নাগরিক বইমেলায়। তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংকলন বের করেছে ‘গহন’। অসাধারণ সম্পাদনা, নিখুঁত লেখক নির্বাচন। দুই মলাটের ভিতরে সম্পূর্ণ কমল। সৌষ্ঠব আর শৃঙ্খলাহীন যাপনের কারিগর। তাঁর শিল্পিত বিস্তারকে তুলে ধরেছেন মননশীল সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ। গহনের ‘কমল সংখ্যা’ এবারের বইমেলার আরেক বিস্ময়।
 

ট্রেন্ড থ্রিলার । স্টলে স্টলে তিন বাঁড়ুজ্জের সম্ভার । আরম্ভ – এ হাসছেন সাঁঝের নাট্যকার

 
মেলার প্রধান ট্রেন্ড থ্রিলার-রহস্য উপন্যাস হলেও কোনো কোনো স্টলে বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্করের ত্রিভুবন ঝকঝক করছে। আরম্ভ, মান্দাস, তৃতীয় পরিসর, ধানসিঁড়ির মতো স্টলে স্টলে কেবল পুরনো বৃক্ষ নয়,অবিরাম চলছে তরুণ তুর্কিদের আনাগোনা। আরম্ভ-র সবসময়ে নিজেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। লেখক, নাট্যকার আর চিত্রকরদের আপোষহীন প্রতিনিধি। জাতিসত্তার ইতিহাসের নির্মাণ আর বিস্তৃতিকে জানবার এবং জানাবার আগ্রহ তার অপরিসীম। এই আগ্রহের অভিমুখ খুঁজতে উপচে পড়ছে যেমন তারুণ্য, তেমনি বহুমুখী প্রতিভার বৈদগ্ধ। দেখা গেল নলিনি বেরা, গোলাম রসুল, দেবশিষ ভট্টাচার্য, অমিত মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী সরকারকে। ঘুরতে ঘুরতে আচমকা ঢুকে পড়লেন বিধায়ক তাপস চ্যাটার্জি, হাতে তুলে নিলেন একটি শিল্পকর্ম। বলা দরকার, বই আর চিত্রশিল্পীদের প্রদর্শনে আরম্ভ এবারও অভিনব। ‘সাঁঝের রোদে নাট্যকার’ – মনোজ মিত্রকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর কন্যা ময়ূরী মিত্র। এই সময়ের ‘ক্রুশবিদ্ধ চরিত্ররা’ কেমন আছেন, খুঁজে দেখেছেন দেবাশিষ ভট্টাচার্য। দুটি বইয়েরই প্রকাশক আরম্ভ। মনোজ মিত্রের জীবন ও দর্শনের প্রতি পাঠকের যে কী প্রগাঢ় আগ্রহ, তা প্রতিদিনই বোঝা যাচ্ছে। ছবি আর বইয়ের ভেতরে চকচক করছেন আরম্ভ-র প্রকাশক লালন বাহার ও তাঁর সহকর্মী ও সহমর্মীরা। লালন নেপথ্যচারী, প্রচারবিমুখ নওজোয়ান। তাঁর সহযোগীরাও একই ধাঁচের, একই মননের। এই ওয়ারিশানা কীভাবে তৈরি হল হয়তো খুঁজতে হবে আমাদের।
 

হে বিরহি হায়! বুকে কাঁটাতার, তবুও

 
বইমেলা কি শিল্পীদের বাদ দিয়ে ভাবা যায়? এবার ব্রাত্য কেন রঙ তুলির ঘোড়ারা, সামনে বাঁশের ব্যারিকেড? মুক্তমঞ্চ কোথায়? বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন নেই – বুকে কাঁটাতারের রক্ত, তবুও অভিযান, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, নয়া উদ্যগের মতো প্রকাশকদের সৌজন্যে হাতে হাতে ঘুরছে ড.মহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আহমেদ শরীফ, আহমেদ ছপা, আরজ আলী মাতুব্বর – হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, হরিশংকর জলদাশ, হুমায়ুন আহমেদের বইপত্র। পত্রিকা থেকে প্রকাশক; নতুন প্রকাশনে ছয়লাপ পুস্তকমেলা প্রাঙ্গণ। ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, উত্তরাধুনিকতা, কিংবা হাল আমলের বিজ্ঞানচর্যা থেকে রহস্যাবৃত ভূত প্রেত — কি নেই আনন্দযজ্ঞে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!