Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • মে ৩০, ২০২২

আরেক অপূর্ব আখ্যান

এ প্রতিভা চিরকাল ফিরে দেখার, প্রতিবার নতুন করে সংগ্রহ বাড়িয়ে নেবার

অমিত মুখোপাধ্যায়
আরেক অপূর্ব আখ্যান

চিত্র: দেব সরকার

অনীক দত্তের “অপরাজিত” সাড়া ফেলেছে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বিমুগ্ধ, বিক্ষুব্ধ বা বৈরাগী, সব শিবিরেই। তাই সে সম্পর্কে যা-ই বলা যাক না কেন, উপেক্ষা করার উপায় নেই । স্রেফ সত্যজিতের জন্ম শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য, তাঁর যুগান্তকারী প্রথম চলচ্চিত্রের উদযাপন, তার নির্মাণকাহিনি বেয়ে পর্দার পেছনে যাওয়া বা এক বিশ্বখ্যাত পরিচালকের প্রস্তুতি ও পদচিহ্ণ অনুসরণ করা হয়ে থেমে থাকে নি “অপরাজিত”, হয়ে উঠেছে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু । অতীত স্পষ্টবাদিতার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে বিরুদ্ধতা এবং শিল্পের দুর্বোধ্যতা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-হওয়ায়, অভিযোগ উঠেছে এ সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ।

অথচ অনীক বারংবার প্রমাণ করেছেন যে তিনি মাধ্যমটি কেবল ভালো বোঝেন না, তাকে আধুনিকতায় বুনতে পারেন সহজাত সহজতা অক্ষুণ্ণ রেখে। তাই এ ছবি কালানুক্রমিক জীবনীর খণ্ডদৃশ্যে না-এগিয়ে, কেবল পথের পাঁচালী গড়ার পশ্চাতপট দেখাবার বাইরেও, কখনো সখনো যেতে চেয়ে, এক বেতার সাক্ষাতকারের সূত্রে গ্রথিত হতে থাকে। তাই অবধারিত ভাবে সাদা-কালোয় মহিমান্বিত হয় । তাই এ দৃশ্যকাব্য নাটকীয় না-হয়ে এমন এক পরিচিত চরিত্রকে চোখের সামনে পৌঁছে দেয় যে উচ্চতর মানুষটি বংশগত ও যোগাযোগগত ভাবে ভাগ্যবান হয়েও অজস্র বাধা ও অপমান ডিঙিয়ে আক্ষরিক ভাবে অর্জন করেন, বলা ভালো, ন্যায্যতা দেন সকল প্রত্যাশাকে । তাই এ ছবি তথ্যচিত্র না হয়ে জীবন্ত কাহিনির লেখচিত্র হয়ে ওঠে জীবনের নানা দিক ধরে । তাই আনন্দ আর মুগ্ধতা ছাপিয়ে কখনো বিশুদ্ধ আবেগে দীপ্ত করে তোলে এ চলচ্চিত্র ।

যা সহজ মনে হয়, তা যে ঠিক তেমন নয়, এ চলচ্ছবি তার প্রমাণ । তাই অনীক এখানে কোন অযথা ঝুঁকি নেন না, নামধাম বদলে দেন, বিশদ সংলাপ ও পরিবেশ সৃজনে মনস্ক থাকেন । এমন কী, প্রথমেই পর্দাজুড়ে জানিয়ে রাখেন যে সন্দীপ রায়ের অনুমোদন তাঁর সাথে আছে । শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেওয়ার মাধ্যমেও তিনি মূলত এক সাক্ষাৎকারের ওপরে ভিত্তি করে এগোন, তাকে প্রায় নিখুঁত করে উপহার দেন, ফলে অতীত বহু সাক্ষাৎকারের স্মৃতি জাগিয়ে আরেক বহুমাত্রিকতা অর্জিত হয় । ফলে কোথাও তাঁকে পুরোনো ফুটেজ ব্যবহার করতে হয় না, অথচ বেশ কয়েক বার মনে হয় বুঝি অতীতের দৃশ্য দেখছি । তাই সাক্ষাৎকারের দৃশ্যগুলোয় দুই মুখের বয়স যা হওয়া উচিত তার উল্টোটা ঘটলেও কোন ঝাঁকুনি লাগে না । সমান্তরাল বাস্তবতা এত কাছাকাছি চলে যে দর্শক চেনা দৃশ্য, পড়া তথ্যকেও অভিজ্ঞতার অংশ করে নিতে থাকে । তাই ঐতিহাসিক স্থিরচিত্রেও নবনির্মাণ থাকে, এবং ঐতিহাসিক চেনামুখের প্রতিস্থাপন নজরকে অভ্যস্ত করে তোলে ।

অভিনয় নিয়ে সকলে খুশি, পরিচালক তার প্রয়োজন সঠিক ভাবে অর্জন করেছেন । প্রধান চরিত্র নিয়ে এর মধ্যেই আলোচনা কিন্তু এক সুরে জিতু কমলকে অভিনন্দিত করেছে । এমন একটি বৈগ্রহিক চরিত্রে অভিনয় করার দায়িত্ব অনেক । ছোট চরিত্রের ক্ষেত্রে সব নির্বাচন সঠিক না-হলেও তাতে খুব বড় সমস্যা হয় না, কারণ এমন এক খেলা মগজে চলতে থাকে, যে মনে হয় দেখি তো, ওই মুহূর্তে এই নতুন চরিত্র কেমন অভিনয় করে ! দৃশ্যগুলো কখনো মূল দৃশ্যের চেয়ে লঘু হলেও অনীক পরোয়া করেন নি, কারণ তাঁর লক্ষ্য তো সেই দৃশ্যগ্রহণের অন্য দিকগুলো দেখানো । আবার কিছু দৃশ্য তার পটভূমির মজা নিয়ে সমান নান্দনিক হয়ে ওঠে । তাই দৃশ্যগ্রহণকালীন কিছু সংলাপ নতুন সংযোজন আনে, অন্য রকম আলো ফেলে । পাশাপাশি সাক্ষাৎকারে অকপটে বলা হয় যে তখন তাঁরা কী ভুল করেছিলেন, কোথায় কী ভাবে কতটা ম্যানেজ করা হয়েছিল । আলোকসম্পাতের উদ্ভাবনের, বাইরের দৃশ্যায়নের অভিনব অর্জন বা ‘ভুল’ পদ্ধতি কেমন করে নতুন ব্যাখ্যা পায়, তা আমোদ জাগায় । সুপ্রতিম ভোলের দৃশ্যগ্রহণ, অর্ঘকমল মিত্রের সম্পাদনা মুগ্ধ করে । মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডুর কথা বোধহয় এক্ষেত্রে আলাদা করে আর উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না, তিনি নিজেই খবর হয়ে উঠেছেন ।

শ্যুটিং এর বিশদ দৃশ্যগুলো কেবল সত্যজিতের অনন্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে না, উদ্ভাবন, যন্ত্রণা ও একাগ্রতাকে পেছন থেকে সামনে আনে অসাধারণ দৃশ্যগ্রহণ, আবহ, যন্ত্রবাদন ও সঙ্গীতের সমারোহে । মূল ছবি থেকে অনীকের দৃশ্য বেছে নেবার ক্ষমতারও প্রশংসা করতে হয় । তাই অসংখ্য কারিগরী বিশদের অনায়াস উল্লেখ ও রবিশঙ্করের এক দিনের বাদনসহ রেকর্ডি এর ঘুমন্ত সহকারীর ভূমিকাকেও উদ্ভাসিত করে, সত্যজিতের কাজের গভীরতার পরিমাপ দেয় । দেবজ্যোতি মিশ্র কেবল মন ভরান নি, মূল দৃশ্যের আবেদনের তাৎপর্য স্পষ্ট করেছেন সুরসৃজনে পরিণত ভাবে পাল্লা দিয়ে । আলো, বিশেষ করে ছায়ার কাজে টানা আগ্রহ বজায় থেকেছে । তা ছাড়া বর্ষার দৃশ্যে পিছল মাঠের দৃশ্যগ্রহণ কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফুটেছে । ভারি ক্যামেরাসহ যন্ত্রাদি নিয়ে কলাকুশলীদের ছোটা ও পলিচাদর মেলে ছবি তোলার বাস্তবতাকে এমন জীবন্ত অভিজ্ঞতা করে তোলে, যে মূল ছবিকে নতুন চোখে দেখার পর্ব শুরু হয়ে যায় । এটা নিশ্চিত, যাঁরা মূল চলচ্চিত্র দেখেন নি, তাঁরা এবার সেটি দেখবেন, দেখেছেন যারা তাদের অনেকেই ফের দেখার তাগিদ অনুভব করবেন ।

পুরস্কৃত হবার পরে দেশের বহু দর্শকের মতবদল, কফি হাউসে স্বতঃস্ফূর্ত সমবেত হাততালি, বক্স অফিসের সামনে বা ছবি-শেষের মন্তব্যস্রোত, এমনকী সিনে ক্লাবের সম্বর্ধনায় উদ্বেল করে তুলে এ ছবি শেষ হয় না । এক দশকের সময়-ঝাঁপ দিয়ে, অনেক মাইলফলক উহ্য রেখে এক নৈশ টেলিফোনে নিউ ইয়র্ক থেকে ভেসে আসা স্বরের আবেগে শেষ হয় এ ছবি, যেখানে অপু-ট্রিলজিতে মুগ্ধ নবীন পরিচালক নম্বর সংগ্রহ করে তাঁর মুগ্ধতা জানান । কারণ এ প্রতিভা চিরকাল ফিরে দেখার, প্রতিবার নতুন করে সংগ্রহ বাড়িয়ে নেবার ।

তবু, স্পষ্ট কারণে এ ছবির তীব্র নিন্দাও হয়ে চলেছে । মূল অভিযোগ, এখন এমন চলচ্চিত্র করার উপযোগিতা কী । কোন নতুন দিক দিল এ নির্মাণ ! উত্তর হলো, ব্যক্তি সত্যজিতের মনোজগত, পরিবেশ-পরিজন, বন্ধুত্ব, চাকরির পরিসর, সিনে ক্লাবের উসকানি, দেশি-বিদেশি দিকপালদের প্রভাব কেমন করে তাঁর মনন ও সৃজনধারার দিকবদল করেছিল, যা তাঁকে সঠিক কারিগরী জ্ঞান না নিয়েও অপেশাদার অভিনেতা, এমনকী নতুন কলাকুশলী নিয়ে এগোনোর আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল, তা দর্শকের জানার দরকার ছিল । কেউ বলছেন না যে এ ছবি এত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে এগিয়েছে, যে “পথের পাঁচালী” এবং “পথের পদাবলী”র মধ্যে অজান্তে এক লুকোচুরি খেলা চলেছে ।

এ কথা ঠিক, অনেকেই “পথের পাঁচালী”র নির্মাণ ও প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য জানেন, কিন্তু তার সাথে কিছু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনা এখানে ধরা হয় যা প্রকাশিত ছিল না । সে সব সন্দীপ রায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আরও নানা সূত্র থেকে মিলেছে বলে পরিচালকের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় । স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তাতেও মানুষ সত্যজিতের মানসিকতা ধরা পড়ে বাড়তি পাওনা হিসেবে । শব্দছক খেলার সময় তর্কে বা প্রযোজনার টাকা পাবার অনিশ্চয়তার সময় লক্ষী-প্যাঁচার উল্লেখে স্ত্রীর প্রতি তাঁর সংলাপ (যা একেবারে শেষের দিকেও ব্যঙ্গ হয়ে উপস্থিত) খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে ।

আছে আরও চকিত উন্মোচন: ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’-এ অভিনয় করে বক্স অফিসে ঝড় তোলা তারকা সুনন্দাদেবীকে স্টুডিওপাড়ায় পাশে দাঁড়িয়েও গুরুত্ব দিতে অনাগ্রহী নবাগত পরিচালক অপরাজিত রায়৷ বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমাদেবী অপরাজিত রায়কে যখন তিনি ‘পথের পদাবলী’ ছবি করার অনুমতি দিচ্ছেন, পিছনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবছা প্রতিকৃতি দৃশ্যায়নের অন্য মাত্রা এনে দেয়৷ একইরকম দক্ষতায় ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে সুকুমার রায়ের প্রতিকৃতি৷ তাঁর পরিচালক হয়ে ওঠার সলতে পাকানোর পর্ব যে শুরু হয়েছিল বিজ্ঞাপনের অফিসের স্টোরি বোর্ডে, সেই প্রসঙ্গ এ ছবিতে তাৎপর্যপূর্ণ৷ সেখানে দপ্তরের নানা সংলাপ কমিক রিলিফ দেবার সাথে শান্তিনিকেতনের চিত্রশিক্ষার পরিচয় দেয়, বিজ্ঞাপনের বডিকপি বানানোর ও লণ্ডনে প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে। তা ছাড়া জাহাজে ফেরার সময় বউকে সরিয়ে রেখে সময়কে কাজে লাগাতে স্টোরি বোর্ডে চিত্রনাট্য করে চলা ব্যক্তিমানুষটির অদম্য মানসিকতার পরিচয় দেয় ।

মৃত ইন্দির ঠাকরুণের শেষ যাত্রার শুটিং নিয়ে অনাবিল রসময়তাকে নিঁখুত ভাবে বড়পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক অনীক দত্ত । ছবির বিভিন্ন দৃশ্যে দেখতে দেখতে মনে হতে পারেই যে দর্শক যেন সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ বানানোর সময়কালকে চাক্ষুষ করছেন । তবু এখানে কি খুঁত কিছু নেই! এই অপু-দুর্গার উচ্চারণ ও তাকানো অনেক সময় সফল নয় । দুর্গার মৃত্যুর পরে হরিহর ফেরার দৃশ্যের কথা বলতে ও লেখার সময়ও সত্যজিৎ জানিয়েছেন কেমন করে সর্বজয়া তাঁর আবেগ লুকিয়েছেন, কবজি বেয়ে বালা কেমন করে তার ফলে নেমে এসেছে । সেই সূক্ষ্মতা কাজে লাগাতে পারেন নি অনীক, কান্নার অংশ দেখিয়েও তা বলা যেত ।

তবু বলি, আজও “তিনখান গান”, বিশেষ নায়িকা, আশাময় সমাপ্তি ও রোমান্সের ভূত বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার ঘাড়ের দখল বজায় রেখেছে । আজও বাস্তবতা, তীব্র দারিদ্র ও সততার প্রতিফলন দেখানোর লোক খুব কম । তার চেয়েও বড় কথা, এ ছবি এ দু:সময়ে নতুন করে আশা-ভরসা জোগায় । সত্যজিতের প্রতি অনুসন্ধিৎসা বাড়ায়, তাঁর নির্মাণগুলো ফের নতুন দৃষ্টিতে দেখার আগ্রহ জাগায় এবং ফের ভালো সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে । শেষে কোথায় যেন মনে হয় শহুরে আধুনিক “অপরাজিত রায়” কখন সিনেমা করতে গিয়ে আম আঁটির ভেঁপুর প্রচ্ছদের ভেতরে পরিবর্তিত হয়ে আরেক অপু হয়ে যান । পুরস্কার মেলার পরে নানা দৃশ্যের সরল সবল সেই হাসি কি এ চলচ্চিত্রের বড় পাওনা নয় !


❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!