Advertisement
  • মু | খো | মু | খি
  • আগস্ট ১১, ২০২১

নো গোয়িং ব্যাক: নতুন চিন্তা জরুরি

সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর একটি লক্ষ্য থাকতে হবে, এখন সেটা নেই

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
নো গোয়িং ব্যাক: নতুন চিন্তা জরুরি

ফাইল চিত্র

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি, বাংলাদেশের দৈনিক ইত্তেফাককে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তার নতুন স্বপ্নের কথা বলেছেন। ক্রীড়াঙ্গনের লোক না হয়েও তিনি ক্রীড়াঙ্গনের অতি আপনজন হিসেবে সমাদৃত। অর্জন করেছেন ‘অলিম্পিক লরেল’ সম্মাননা। অর্থনীতির লোক হয়ে, দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম এই কারিগর যখন ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে শামিল হয়েছেন, তখন তাঁর নতুন চিন্তার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। তাঁর মতে, ক্রীড়াঙ্গনের লোক আর সমাজের মধ্যে একটি কাচের দেওয়াল আছে। সেটা ভাঙতে হবে। তবেই ক্রীড়ানৈপুণ্যের সব লোকের শক্তি ব্যবহার করে সমাজ উপকৃত হতে পারে। একই সঙ্গে পৃথিবীর সম্পদের বণ্টন পদ্ধতিকে উল্টো করে সাজাতে হবে। বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সম্পদ এখন এক ভাগ লোকের দখলে। মাত্র এক ভাগ সম্পদ ৯৯ ভাগ লোকের আয়ত্তে। এটিকে উলটে দিতে হবে। ৯৯ ভাগ লোকের কাছেই সম্পদের ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে। কীভাবে? তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন বিশ্বজয়ী অর্থশাস্ত্রী। 

আলাপচারিতায়:জামালউদ্দীন

অর্থনৈতিক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা

► ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে আপনার নিবিড় সম্পর্কের শুরুটা কী করে।

•• প্রথমে বলি এটা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল যে অলিম্পিক থেকে কোনো সম্মাননা পাব। কোনোদিন এ ধরনের চিন্তাও করিনি। আমি আনন্দিত যে এর মাধ্যমে অলিম্পিকের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম যুক্ত হল। এ পুরস্কার আমার জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য সম্মানের। বিরাট গর্বের। ছোটবেলা থেকে স্কাউটিংসহ অন্য কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কাজেই খেলার বাইরের লোক হিসেবে এ ধরনের একটা সম্মাননা পাওয়া ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ক্রীড়াবিদদের শক্তি, তারুণ্যের শক্তি। এই শক্তিকে সামাজিক ব্যবসায়ের কাজে লাগাতে গিয়েই মূলত ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক হয়ে যায়। পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে ক্রীড়া জগতের আত্মিক সম্পর্ক লক্ষ করি। আমি দেখি, বিশ্বকাপের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পতাকায় দেশ ছেয়ে যায়। শহর গ্রাম প্রিয় টিমের পতাকায় ভরে যায়। চালাঘর থেকে শুরু করে শহরের বহুতল পর্যন্ত। মানুষ এত উত্সাহ কী করে পায় সেটা আমি ভাবতাম। এটা শুধু পতাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যখন তাদের প্রিয় দল জিতে যায় তারা উত্সাহ-উদ্দীপনার বন্যায় ভেসে যায়।
একইভাবে যখন প্রিয় দল হারে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই যে কে কোথাকার মানুষ, কোন দেশের মানুষ, তাকে ভালোমতো চেনেও না, জানেও না অথচ তাকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কান্নাকাটি হচ্ছে। এমনকি তাঁর জন্য মারামারি করছে। এমন কেন হয়?—চিন্তা করে দেখলাম, এটা মূলত একটি অদৃশ্য গভীর সম্পর্ক থেকে আসে। এই সম্পর্ককে যদি আরো কোনো মঙ্গলজনক কাজে লাগানো যেত, তাহলে তো সমাজের বড় বড় পরিবর্তন সম্ভব হতো। আমি সেই উদ্যোগটি নেবার কথা বলছি।

► তার মানে সামাজিক ব্যবসায়ের প্রয়োজনেই আপনি ক্রীড়াঙ্গনে যুক্ত হলেন…

•• অনেকটা তাই। বলতে পারেন সামাজিক ব্যবসায়ের টানে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি। ২০০৬ সালে জিদানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছি। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে গেছেন, ঢাকায় প্রফেশনাল খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলেছেন। তাকে সম্মান জানাতে রাস্তার দুই পাশে ছিল আবেগাপ্লুত মানুষের সারি। এভাবেই প্রথম ক্রীড়াজগতের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক শুরু হলো। ডানোনের বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ আমাকে তাদের প্রতীকী প্রধানের দায়িত্ব দেন। প্রতিবার ডানোনের ওয়ার্ল্ডকাপে পুরস্কার বিতরণীতে আমাকে নিয়ে যেত, বিজয়ী দলের হাতে পুরস্কার তুলে দেবার জন্য। বাংলাদেশ থেকেও এ ওয়ার্ল্ডকাপে আন্ডার থার্টিন ফুটবল দল পাঠিয়েছিলাম।

► বার্সেলোনাতেও আপনি বক্তৃতা করেছিলেন…

•• হ্যাঁ। বার্সেলোনা সিটি আমাকে একবার নিয়ে গেল তাদের সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগগুলোর সঙ্গে আমাকে পরিচিত করাবার জন্য। কারণ, তার আগে বার্সেলোনা নগর কর্তৃপক্ষ বার্সেলোনাকে ‘সামাজিক ব্যবসায় শহর’ হিসেবে ঘোষণা করে নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করতে শুরু করে। বার্সেলোনা নগরের এই উদ্যোগে বার্সেলোনা ক্লাব বিরাটভাবে অংশগ্রহণ করে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাকে তাদের ক্লাবে আমন্ত্রণ করল। সেখানে গেলাম। তারা ক্লাবের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।  আমার নাম লেখা বার্সিলোনা ক্লাবের একটা জার্সি উপহার দিল। তারা যে মাঠে খেলে সেখানে আমাকে নিয়ে গেল। সুন্দর মাঠ, চমত্কার স্টেডিয়াম। তারা আমন্ত্রণ জানালেন, আমি খেলা চলার সময় যে কোনো দিন এলে স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে খেলা দেখতে পারব। বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগল। জীবনে কখনো ফুটবল খেলিনি। আর এখন বার্সেলোনার মতো ক্লাবের কাছ থেকে যে কোনো সময় খেলা দেখার আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। নিজের নাম লেখা জার্সি পেয়ে গেলাম!
আমার সঙ্গে তাদের খেলোয়াড়দের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। কথা বললাম, ছবি তুললাম। মেসির সঙ্গে ছবি দিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে বড় করে সংবাদ ছাপা হল। আমার ইন্টারভিউ ছাপা হল। সামাজিক ব্যবসায়ের কারণেই বার্সেলোনার সঙ্গে যোগাযোগ। এত বড় বড় ফুটবল তারকার সঙ্গে যোগাযোগ। এভাবেই ধীরে ধীরে এ অঙ্গনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেড়েছে।

অলিম্পিক লরেল’ সম্মাননা হাতে স্বপ্নদ্রষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস

► অলিম্পিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা কীভাবে?

•• সুইজারল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলাম, তখন সেখানে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তখনও তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি। বক্তৃতা শেষ করার পর জানালেন যে আমার সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। সামাজিক ব্যবসায় সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চান। আমাকে অলিম্পিকের হেডকোয়ার্টার্সে আমন্ত্রণ জানালেন। আমার অন্য প্রোগ্রাম থাকায় খুব কাছে হলেও আমি সে সময় যেতে পারিনি। পরে যখন ইউরোপে গেলাম, তখন ওঁদের আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য গিয়েছিলাম। তাদের বিশেষজ্ঞ, কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশাল সম্মেলন করল তারা। সেখানে আমার কথা বলার বড় সুযোগ তৈরি হল।
সামাজিক ব্যবসায় কীভাবে কাজে লাগতে পারে, সে বিষয়ে বললাম, যা তাদের খুব ভালো লাগল। পরে ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে আমাকে আমন্ত্রণ করা হল, মশাল বহনকারীদের মধ্যে একজন হওয়ার জন্য। এটা আমার জন্য একটা বিরাট সম্মানের বিষয়।

এরপর রিও অলিম্পিকে আরো একটি বড় কাজ ছিল আমার। অলিম্পিকের বার্ষিক সাধারণ সভায় সবার উদ্দেশে একটি ভাষণ দেওয়া। ক্রীড়াজগতের টপ লোকদের অ্যাড্রেস করার মহাসুযোগ এল আমার। বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমি আমার অনুভূতির কথাগুলো বললাম। আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরলাম, যা তাদের খুব মনে ধরেছিল। অলিম্পিক কমিটিও চেষ্টা করে যাচ্ছিল সামাজিকভাবে কীভাবে অ্যাকটিভ হওয়া যায়। আমার কথাগুলো শুনে তারা অনুপ্রাণিত হল।
এরপর থেকে একটা একটা করে ঘটনা যোগ হতে আরম্ভ করল। প্যারিস নগরীর মেয়রের আহ্বানে ফ্রান্সের লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল। তাদের ক্রীড়াজগতের শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক হল। তারা আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ডিনারের আয়োজন করল। প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো বললেন, আমরা ২০২৪ সালের অলিম্পিককে আমাদের শহরে নিয়ে আসতে চাই। অলিম্পিককে কীভাবে আমরা সামাজিক ব্যবসায়ে রূপান্তর করতে পারি, সে বিষয়ে আমার কাছে জানতে চাইল। আমি সেটা ব্যাখ্যা করলাম। এরপর বিরাট অনুষ্ঠান হল আমাকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য। এর প্রস্তুতি হিসেবে সিটি কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে অনারারি সিটিজেনশিপ দেওয়ার প্রস্তাব পাশ হল। অলিম্পিক বাস্তবায়নের জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি মুখপাত্র দল গঠন করা হল, যেখানে আমাকে রাখা হল। এর প্রধান হলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। আরেক জন হলেন মেয়র হিদালগো। লুজানে অলিম্পিক কমিটির কাছে আমরা তিন জন প্রস্তাব নিয়ে গেলাম ২০২৪ সালে প্যারিসে অলিম্পিক অনুষ্ঠানের জন্য। আমাদের যুক্তি সেখানে তুলে ধরলাম। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে অলিম্পিকের অনুমোদন পেয়েছে প্যারিস। এভাবে ক্রীড়াজগতের বাইরের লোক হয়েও প্যারিস অলিম্পিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম।

ক্রীড়াঙ্গনের তারকাদের সঙ্গে

► ক্রীড়াজগতের লোকেরা সমাজের অন্য সবকিছু থেকে আলাদা। তাদের এক করার কাজটি চ্যালেঞ্জের। আপনি কী মনে করেন?

•• এটা সত্য যে ক্রীড়াজগত্ অন্য জগত্ থেকে কিছুটা আলাদা। ক্রীড়াজগত্ অন্য জগতের সঙ্গে মিশতে চাইছে, মিশতে পারছে না। সমাজ তাদের দেখছে, তারাও সমাজকে দেখছে। কিন্তু মাঝখানে একটা কাচের দেওয়াল আছে। আমি যেটা করলাম, তাদের বলেছি এই কাচের দেওয়াল ভেঙে দিতে হবে। দুই জগৎকে এক করে দিতে হবে। খেলোয়াড়দের যে শক্তি, তা সমাজের কাজে লাগাতে হবে। সেটা করতে পারলে সমাজের অনেক উপকার হবে। ক্রীড়াজগতেরও উপকার হবে।
ক্রীড়াজগতের মানুষ নিজেদের ‘আলাদা’ভাবে ভেবে এসেছে। সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করেছে। অলিম্পিক মুভমেন্ট চেষ্টা করছে এ কাজ করার জন্য। এই সময়েই আমি নতুন করে তাদের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য সামাজিক ব্যবসায়ের কথা বললে তারা আগ্রহ সহকারে তা গ্রহণ করেছে। আমার কথায় তারা অনুপ্রাণিত হয়েছে।

► ক্রীড়াজগতে আপনার এই অন্তর্ভুক্তি ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিবর্তনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন?

•• খেলাধুলা আসলে বিরাট শক্তি। এর বিন্দুমাত্র শক্তিও যদি আমরা সমাজের উপকারে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে তা খুব ভালো ফল বয়ে আনবে। আমি খুবই আনন্দিত যে আমি এই আহ্বান নিয়ে এ জগতে ঢুকতে পেরেছি। স্পোর্টসের শক্তি কোনো একটি বিশেষ দেশের মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধনী দেশ হোক, অতিদরিদ্র দেশ হোক, কোনো দেশই ক্রীড়াজগতের বাইরে নয়। কোনো মানুষই এর প্রভাবের আওতার বাইরে নয়। আরেকটি বড় বিষয় হল স্পোর্টস আর তারুণ্য সমার্থক। এটার সঙ্গে সৃজনশীলতা যুক্ত। সৃজনশীলতার চূড়ান্ত রূপ পায় তরুণ বয়সেই। এ তিনটার সমন্বয় করে আমরা সমাজের বহু সমস্যার সমাধান করতে পারি। একইভাবে ক্রীড়াজগতে নিজের সমস্যারও সমাধান করা যায়। খেলোয়াড়দের খেলার বয়স খুব সীমিত। সর্বোচ্চ বয়স বড়জোর মাত্র ৩৫ বছর। এরপর কেউ বলুক আর না বলুক, খেলোয়াড়দের কদর কমতে থাকে। খেলোয়াড় জীবনে তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে—চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। প্রথম হতে হবে। এই সময়ে অন্য কোনো সাধনা থাকে না। তাই ক্যারিয়ার শেষে তাদের মধ্যে হতাশা চলে আসে। অন্য কোনো জায়াগায় যাওয়ার সুযোগ পায় না। আমরা বলছি, এ সময় তাদের মনে উদ্যোক্তা হওয়ার শক্তি দিয়ে দিতে হবে, যাতে তাদের স্পোর্টস ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এগোতে পারে।

► এক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের হার কেমন হতে পারে?

•• খেলোয়াড়দের মধ্যে আগে থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যথেষ্ট গুণাবলি থাকে। তারা প্রতিযোগিতা পছন্দ করে। সাফল্য পছন্দ করে। ফলে তাদের উত্সাহ জোগালে, পুঁজি জোগালে উদ্যোক্তা হিসেবে তারা সফল হবে এবং হতাশাপূর্ণ পরিস্থিতির অবসান হবে।

► ইউনূস স্পোর্টস হাব সম্পর্কে যদি কিছু বলেন…

•• স্পোর্টসের শক্তির কথা তো আগে থেকে বলে আসছি। এর সঙ্গে মানুষের সমস্যার সমাধান করার কাজে একে ব্যবহার করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। যখন অলিম্পিকে যুক্ত হয়ে গেলাম, চিন্তা এল এ কাজের পেছনে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করার। সে চিন্তা থেকেই ইউনূস স্পোর্টস হাবের জন্ম। এখন ক্রীড়াজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সামাজিক ব্যবসায়ের উদ্যোগ এর মাধ্যমে করতে পারছি। এর ফলে কাজ সহজে এগোতে পারছে। এখানে খেলোয়াড়জীবন-পরবর্তী সময়ে করণীয় বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণসহ অনেক কাজ করা হচ্ছে। যেহেতু আমাদের বেশির ভাগ কাজ এর আগে ফ্রান্সে হচ্ছিল, ইউনূস স্পোর্টস হাবও ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এর কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী।

► তিন শূন্য থিওরি কীভাবে কাজ করবে বলে আপনি মনে করেন?

•• পৃথিবীকে ভয়ংকরভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে অনেকগুলো বিষয় কার্যকর থাকলেও এর মধ্যে তিনটি বিষয়ের ভূমিকা খুবই মারাত্মক ও জরুরি। প্রথমত, বৈশ্বিক উষ্ণয়ন। এটা আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে চলেছে। দ্বিতীয়ত, বিস্ফোরণোন্মুখ বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ। পৃথিবীর ৯৯ ভাগ সম্পদ এখন এক শতাংশ লোকের কাছে। আর এক ভাগ মাত্র সম্পদ আছে ৯৯ ভাগ লোকের কাছে। এই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। তৃতীয় বিপর্যয় আনছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এতে মানুষের আর কোনো কাজ থাকবে না। এটা মানুষের সৃজনশীলতার সমাপ্তি টেনে দেবে, যা ভয়ংকর একটি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের উলটো পথে যেতে হবে। কার্বন নিঃসারণ থেকে মুক্ত হতে হবে। সম্পদ আর মানুষকে একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সঠিক পৃথিবী গড়ার জন্য আমাদের গন্তব্য, চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তি ঠিক করতে হবে। আমরা পুরোনো চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকলে আমাদের পুরোনা আত্মঘাতী পথেই থেকে যেতে হবে। নতুন গন্তব্যে যেতে হলে নতুন রাস্তা বানাতে হবে। তাই নতুন চিন্তাই আমাদের একমাত্র পরিত্রাণের পথ। পুরোনো চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে পৃথিবীতে অতি দ্রুত আমাদের সমাপ্তি নিশ্চিত।

► অলিম্পিক পুরস্কারের সময় দেওয়া বক্তব্যেও এটি বলেছেন…।

•• হ্যাঁ। অলিম্পিকে পুরস্কার দেওয়ার সময় আমাকে বলা হল আপনার বক্তৃতার জন্য আমরা মাত্র এক মিনিট সময় বরাদ্দ করতে পেরেছি, শুধু ধন্যবাদ জানানোর জন্য। তখন আমি ভাবলাম এক মিনিটে কী বলব? আমি ঠিক করলাম এই এক মিনিটের মধ্যে আমি ‘তিন শূন্যে’র পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাব। তাই করলাম, আমার আহ্বানটা আমি জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পৃথিবীর ২০০ কোটি থেকে ২৫০ কোটি মানুষ টেলিভিশনে দেখে। এদের মধ্যে কেউ কৌতূহলবশতও যদি তিন শূন্যের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করে সেটাই হবে আমার বড় প্রাপ্তি।

► আপনি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ঋণ পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এখন যুক্ত হয়েছে সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণা। উভয়ের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে সম্ভব?

•• ধারণাগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই কাজ করছি। ক্রমে ক্রমে এগুলো স্পষ্টতর হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরাই গ্রামীণ ব্যাংকের ৯৭ শতাংশের মালিক। ৩ শতাংশ মালিকানা ছিল সরকারের। গরিব মানুষের টাকায় গরিব মানুষের মালিকানা—এ ধারণাটাই সামাজিক ব্যবসায়ের অন্যতম মূল বিষয়। বাইরে থেকে এসে কেউ লাভ নিতে পারবে না। দরিদ্র নয়, এমন লোক যদি মালিকানায় থাকে, তবে তিনি এই মালিকানার জন্য কোনো মুনাফা নিতে পারবেন না। এটাই সামাজিক ব্যবসায়ের মূল ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতে আমরা অনেক কিছু করেছি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র করেছি, হাসাপাতাল করেছি, সৌরশক্তি মানুষের ঘরে ঘরে নিয়ে গেছি। মুনাফাবিহীন অনেক ব্যবসায় সৃষ্টি করেছি। এই ব্যবসা হলো সমস্যা সমাধানের ব্যবসা। ব্যক্তিগতভাবে কেউ মুনাফা নিতে পারবে না। সামাজিক ব্যবসায়ের মুনাফা সামাজিক ব্যবসায়েই ব্যায় করতে হবে। এরপর তো আরো অনেক কিছু হয়েছে। জয়েন্ট ভেঞ্চার করলাম। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বই লিখলাম। ক্রমশ সামাজিক ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকে বিতর্ক করছে, এর ভবিষ্যত নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করছে। এ ব্যবসায়ের মূল বিষয় হলো মানুষের মঙ্গল। তবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীতে অনেকের কাছে এটা উদ্ভট চিন্তা বলেও মনে হয়েছে।

► আপনি বলেন যে চাকরি না খুঁজে চাকরি দিতে হবে। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করেছে। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

•• এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় কিছু পরিবর্তন আসছে। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির কারণে চিন্তায় আরো পরিবর্তন আসবে। নতুন চিন্তা প্রসারের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি বিষয় স্পষ্ট করেই জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে যে, ব্যবসায় দুই ধরনের—একটা হলো ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য, আর আরেকটা হলো সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য। এখন বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ব্যবসায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩৪টি দেশে ৯৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা জন্মগতভাবে যে ধারণা পেয়েছি তা হলো পড়াশোনা করে চাকরি করতে হবে। অন্নদাতার গোলামি করতে হবে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে এ চিন্তাভাবনা নিয়ে জন্ম নেয় না। আমাদের শিক্ষা আমাদের মনে এমন ধরনের চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ ধারণা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। মানুষের নিজস্ব শক্তিতে ফিরে যেতে হবে। নতুন পৃথিবী তৈরি করতে হলে নতুন চিন্তা করতে হবে। পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে হবে নতুন চিন্তা দিয়ে। নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। জিডিপি হলো বড় লোকের লক্ষ্য। এটা গরিব মানুষের লক্ষ্য নয়। সব মিলে পৃথিবীর কোনো লক্ষ্য নেই। ব্যক্তি-মানুষের লক্ষ্য আছে। আর তা হলো সর্বোচ্চ মুনাফা করা। আর গুটি কয়েক ব্যক্তি মানুষের লক্ষ্যকে পৃথিবীর লক্ষ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ সেটা হতে পারে না। পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। জিডিপি হতে পারে বড় লোকের লক্ষ্য। এটা গরিব মানুষের লক্ষ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। এর মাধ্যমে পৃথিবীর গরিব মানুষ কিছু পায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী রেখে যাওয়াই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিন শূন্যের পৃথিবী সেই পৃথিবী।

সৌজন্য দৈনিক ইত্তেফাক

♦=♦=♦   ♦=♦=♦


❤ Support Us
error: Content is protected !!