- মু | খো | মু | খি
- নভেম্বর ২১, ২০২১
নন্দীগ্রাম ইস্যুতে ভুল করেননি বিরোধীরা
'বিজেপিকে রুখতে মমতার বিকল্প কোথায়? তাঁকে সামনে রেখেই জোট গড়তে হবে।

বাম আমলে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক থেকে নির্বাচিত তিন বারের লোকসভার সদস্য লক্ষ্ণণ শেঠ– আর, আসামের বড়পেটার এখনকার কংগ্রেস সাংসদ আব্দুল খালেক পরপর, একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, নির্ভীক চিত্তে বিভাজনের শক্তিকে রুখতে হবে। সব দলকে লড়তে হবে। এক হয়ে দ্বিতীয়ত, তুখোড় তীক্ষ্ণ ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে তাঁদের সামাজিক অবস্থানটাও ঘোষণা করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের অগ্রজ-অনুজ দুই রাজনীতিক।সমান্তরাল চিন্তার এ এক অকপট দৃষ্টান্ত। আলাপচারিতায়, লালন বাহার
মু |খো|মু|খি: লক্ষ্ণণ শেঠ
► নন্দীগ্রামে কী ঘটেছিল, কার ভুলে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, আপনার ভূমিকাটাই বা কী ছিল, আপনারই জবানে তা শুনতে চাই।
♦ সরকারকে সরকারের দায়িত্ব পালন করতে হবে, বিরোধীরা বিরোধিতা করবে, এটাই গণতন্ত্রের রীতি । সুতরাং বিরোধী দলের নেতা বা নেত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, নন্দীগ্রামে তাঁদের দায়িত্ব তাঁরা পালন করেছিলেন।
বাম আমলের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন, জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ ছেড়ে দাও। আদতে জমি অধিগ্রহণের কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি। সংবাদপত্রে দুএকটা খবর বেরিয়ে ছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলে ভাবলেন, তাঁর সাদা জামায় কালির দাগ লাগবে না। মেগা কেমিক্যাল হাব করার জন্য নন্দীগ্রামকে চিহ্নিত করা, দশ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের ঘোষণা করা, সালিম গোষ্ঠীর জন্য জমি বরাদ্দ, সব দায়ই একতরফা ভাবে আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।এর মতো নির্মম অসত্য আর কী হতে পারে।
রাজ্যের তখনকার শাসকগোষ্ঠী আমাকে গণশত্রুও বানাতে চেয়েছিল। আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ভেবেছিল, তাদের গায়ে কোন কলঙ্ক লাগবে না ।বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সব জেলা কমিটিকে চিঠি দিয়ে একথা জানালেন। কিন্তু মজার বিষয়, সে চিঠিতে আমি কী শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি, সে বিষয়ে একটি কথাও ছিল না।
► ২০০৯ সালের পর, আপনি রাজনীতির শিকার হয়েছেন বলে আপনার মনে হয়?
♦ অবশ্যই। আমার পুরনো দল, রাজ্যের তখনকার শাসকগোষ্ঠী, শুধু আমাকে ভিক্টিমাইজই করেনি, আমাকে গণশত্রুও বানাতে চেয়েছিল। আমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ভেবেছিল, তাদের গায়ে কোন কলঙ্ক লাগবে না ।কিন্তু দেখুন, তারপর থেকে বামফ্রন্টটা উঠেই গেল প্রায়।শেষ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জনগণ তাদের থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিল।
►২০১৪ সালে আপনি তো নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন।
♦ নন্দীগ্রাম ইস্যুকে ঘিরে, আমার ওপর একতরফা দায় চাপিয়ে, বামফ্রন্ট থেকে আমাকে বহিস্কার করা হল। বলা হল, আমি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সব জেলা কমিটিকে চিঠি দিয়ে একথা জানালেন। কিন্তু মজার বিষয়, সে চিঠিতে আমি কী শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি, সে বিষয়ে একটি কথাও ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই বামফ্রন্টের বহু কর্মী ও নেতা আমার সঙ্গে দল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের নিয়েই একটা নতুন দল করলাম।ভারত নির্মাণ পার্টি।তার রেজিস্ট্রেশন ঘিরে সমস্যা দেখা দিল। ভাবলাম, এভাবে তো হবে না, তখন দেশজুড়ে বিজেপি হওয়া। তাই ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলাম।কিন্তু কয়েকমাস পরেই, আমার মতাদর্শের সঙ্গে বিরোধ বেধে গেল। হিন্দু রাষ্ট্র পরিকল্পকদের সঙ্গে আমি থাকতে পারলাম না। ধর্মীয় মেরুকরণ আর সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়াই তাদের কাজ। এটা আগে আমরা জানতাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকে আরও পরিস্কার হয়ে গেল বিষয়টা। দলের মধ্যে গ্রুপবাজির চোরাস্রোত, পছন্দ অপছন্দের বিষয়। আর্থিক দুর্নীতি, এবং তীব্র মুসলিম বিরোধিতা এরকম যাবতীয় ইস্যু বিবেকে ঘা দিতে লাগল। ওরা বলতে লাগল, হিন্দুধর্মের জাগরণ করতে হবে। যদিও মূর্খরা এসব জানে না, প্রাচীন ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্য হল সাম্যের, গণতন্ত্রের, ধর্মনিরপেক্ষতার, ন্যায় বিচারের। আমাদের দেশের ইতিহাসকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, দেখা যাবে পুরাকালে আমাদের দেশের এক একটা গ্রাম ছিল স্বশাসিত। রাজশাসন ছিল, রাজাকে কৃষি উৎপাদনের একটা অংশ দিত। তবে গ্রামীণ প্রশাসন থেকে রীতি-নীতি সে গ্রামের লোকেরাই ঠিক করত, তারাই নির্বাচন করতো কে হবে গ্রামের প্রধান। সো ইন আওয়ার গ্রাস রুট, সিন্স আওয়ার সিভিলাইজেশন, দেওয়ার ওয়াজ এ ডেমক্রেসি। গ্রাসরুট ডেমক্রেসি। বি আর আম্বেদকর যে ভারতীয় সংবিধান রচনা করেছিলেন, তার সূচনায় তিনি বলেছেন সার্বভৌম, প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা। ইকুয়াল অপরচুনিটি টু অল, লিবার্টি অ্যান্ড জাস্টিস টু অল— তিনি গৌতম বুদ্ধের এই সহজিয়া দর্শন আর ভারতীয় সমাজের চিরায়ত অভ্যাসকে পাশাপাশি রেখেই গড়েছিলেন সংবিধান। মহত্মা গান্ধীও সে দর্শনটাকে গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে আমাদের দুই রাষ্ট্রনেতা ইন্দিরা গান্ধী এবং জ্যোতি বসুও সাম্য আর ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। কিন্তু বর্তমান ভারতের ক্ষমতাসীন শাসকদল সেই বহুত্ববাদী, ঔতিহ্যশীল আদর্শ চায় না। তারা শুধু বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যস্ত।
► একজন বরিষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে এই মুহুর্তে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে বিচার করবেন?
♦ দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হয়েছে।এই অবস্থায় যদি আমি চুপচাপ থাকি, তাহলে নিজের সামনে দাঁড়াতে পারব না। সেইজন্য গত বিধানসভা ভোটের আগেই, আমার যাঁরা অনুগামী ও কর্মী তাঁদের নিয়ে সভা করে বলেছিলাম, তোমরা তূণমূলকেই ভোট দাও।বিজেপিকে রুখতে হবে। আমার কথা অনেকে মেনেছে, অনেকে আবার টাকার লোভে, ক্ষমতার মোহে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারছে। সুতরাং আমার রাজনৈতিক অবস্থান খুব পরিস্কার। বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিনাশ ঘটাতে হবে।ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শকেই তুলে ধরতে হবে, এজন্যেই আমি বিজেপি ছেড়ে এখন কংগ্রেসের সাধারণ সদস্য হয়ে আছি। কোন পদাধিকারী নই। দুর্ভাগ্যের বিষয় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেস খুব চুপসে গেছে। দলে শক্তিশালী বিরোধী নেতা কেউ নেই। এরকম চলতে থাকলে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে আবারও বিজেপির ফিরে আসারা আশঙ্কা রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও বিজেপি বিরোধী ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ার প্রচেষ্টায় খামতি আছে, এর জন্য মূলত কংগ্রেস দায়ী। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সকলের বোঝা উচিত, ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা না ভেবে, বিজেপিকে পরাস্ত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস,অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে একটা বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
গত লোকসভা এবং এর আগেও অবিজেপি জোটকে ঘিরে তোড়জোড় শুরু হলেও রাজনৈতিক ভাবে সেটা খুব একটা দানা বাধেনি। এ অবস্থার যদি পরিবর্তন না হয়, অবিজেপি জোট যদি গঠন না হয়, তবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ফের সাম্প্রদায়িক শক্তি জয়ী হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কম আসন পাবে, তৃণমূলের আসন অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু ভারত জুড়ে কী হবে, এটা ভেবে দেখা দরকার।
ইকুয়াল অপরচুনিটি টু অল, লিবার্টি অ্যান্ড জাস্টিস টু অল— গৌতম বুদ্ধের এই সহজিয়া দর্শন আর ভারতীয় সমাজের চিরায়ত অভ্যাসকে পাশাপাশি রেখেই আম্বেদকর ভারতীয় গড়েছিলেন সংবিধান। মহত্মা গান্ধীও সে দর্শনটাকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ভারতের ক্ষমতাসীন শাসকদল সেই বহুত্ববাদী, ঔতিহ্যশীল আদর্শ চায় না। তারা শুধু বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যস্ত।
► আপনার রাজনৈতিক লক্ষ্যটা এখন ঠিক কী?
♦ আমাদের সব রাজনৈতিক দলের একটাই রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত, সমস্ত দল গুলোকে নিয়ে বিজেপি বিরোধী একটা জোট তৈরি করা। দেখুন এককভাবে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আঞ্চলিক দলগুলো তাদের অঞ্চলের বাইরে খুব একটা যেতে চায় না, যাওয়ার চেষ্টাও করে না। কিন্তু দেশের সব রাজ্য বিজেপি বিরোধী দলগুলো যদি একজোট হতে পারে, বৃহত্তরে স্বাৰ্থে, তবে কেন্দ্রে সরকার বদল সম্ভব। অন্ধ্রে, তেলেঙ্গানায়, কর্ণাটকে, কেরলে, তামিলনাড়ুতে বিজেপি বিরোধী জোট তৈরির সুযোগ আছে।ওড়িষা কোনদিকে যাচ্ছে না, কিন্তু তারা যাতে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নেয়, সেটা দেখতে হবে। পশ্চিম ভারতে গুজরাট বিজেপির শক্ত ঘাটি, কিন্তু যদি পার্শ্ববর্তী রাজ্য, হরিয়ানা, দিল্লি, পাঞ্জাবে যদি বিজেপি বিরোধি জোট গড়ে তোলা যায় তাহলে গুজরাটের পরিস্থিতিও বদলে যাবে। অবিজেপি দল গুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তোলা দরকার, তার জন্য একটা বিচক্ষণ বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজন। সেখানে নিজের খুদ্র স্বার্থ দেখলে হবে না।
► জোটের অভিমুখ কী হবে?
♦ শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে জোট করলে তো হবে না। তার সঙ্গে কর্মসংস্থান, দারিদ্রের হার প্রশমন, দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া তৈরি, এসব ইস্যুকে সামনে রাখতে হবে। বিশেষ করে বেকারত্ব আর দারিদ্র মোচনে গুরুত্ব দিতে হবে।
►গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের আগেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, আপনি তৃণমূলে যোগদান করতে চলেছেন? ২০২৪ সালে লক্ষণ শেঠকে কী নতুন কোন ভূমিকায় দেখা যেতে পারে?
♦ গত বিধানসভা নির্বাচনেও আমি বলেছিলাম, বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে ভোট দাও, আগামীতেও বলব,বিজেপির বিরুদ্ধে যারা অগ্রণী ভূমিকা নেবে, আমি তাদের সঙ্গে আছি। এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসই একটি অগ্রণী শক্তি, বিজেপির সম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সে জন্যই আমি তৃণমূলকে সমর্থন করছি।
►মমতা কি অল্টার্নেটিভ ফ্রন্টের মুখ হয়ে উঠতে পারেন বলে আপনার মনে হয়?
♦ মমতার ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা আছে। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই আমি তাঁর সমর্থক হয়ে গেছি। সে দলেরই একজন সমর্থক হিসেবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, ভারতীয় রাজনীতির বৃহত পরিসরে নেতৃত্ব দিতে গেলে, ছোটখাটো ভুল ত্রুটি এড়িয়ে যেতে হয়।
► বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে আপনি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জোটকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, কিন্তু ভবানীপুরে উপনির্বাচনে এবং সম্প্রতি গোয়ায় গিয়েও মমতা বন্দোপাধ্যায় সরাসরি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন?
♦ উনি যা করছেন, হয়তো দূরবর্তী লক্ষ্যপূরণের জন্য এই পদক্ষেপ। আশা করি আমরা সবটা জানতে পারব।
কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সকলের বোঝা উচিত, ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা না ভেবে, বিজেপিকে পরাস্ত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একটা বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে।নইলে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে আবারও বিজেপির ফিরে আসারা আশঙ্কা রয়েছে।
► গত লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচনের পর বেশকিছু জনকল্যানমূলক প্রকল্প সামনে এনেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এবিষয়ে আপনার মত?
♦ দেখুন ওইসব জনকল্যানমূলক প্রকল্প নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কোভিড প্যান্ডেমিকে লকডাউনের সময়, নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, মানুষের হাতে টাকার যোগান দিতে হবে, দরকার হলে ঋণ, করে, টাকা ছাপিয়ে। এটা এক ধরণের বক্তব্য। কিন্তু সমস্যা হল রাজ্যের হাতে টাকার যোগান নেই, টাকা আসবে কোথা থেকে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত উৎপাদনমূলক উন্নয়ণে খরচ করা প্রয়োজন। এতে সুদূর প্রসারী লাভ।
► সীমান্ত উত্তপ্ত করে কোথাও কী ভোট রাজনীতিতে ফায়দা তুলতে চাইছে বিজেপি? সামনেই তো উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে ওরা বিভাজনের সমীকরণ কষছে ?
♦ ইতিমধ্যেই তো সেখানে তারা সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে দিয়েছে, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ করছে। এটাতো অনৈতিক কাজ, ইতিহাসের কোথাও রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। আর রাম বলে কোন ঐতিহাসিক রাজা ছিল না। এগুলি হল অসিহিষ্ণুতার পরিচয়। এগুলো হচ্ছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা, কিন্তু রামের ভয়ে খুব বেশী বিরোধিতা দেখা গেল না কোন দলের পক্ষ থেকে। সরকার স্পন্সর করছে এত জমি, এত টাকা, মন্দির গড়বার জন্যে। কেন্দ্রীয় সরকার সবাইকে রামের শিষ্য তৈরি করবে।
আসন্ন এই নির্বাচনে মেরুকরণ তীব্র হবে। আর উত্তরপ্রদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক নেতার সেভাবে উত্থান হয়নি। কংগ্রেস এখন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সামনে আনছে, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ২০২২ এর জানুয়ারি -ফেব্রুয়ারি মাসে। অনেক দেরি হয়ে গেছে । দ্বিতীয়ত, প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক উত্তরণে বড়ো বাধা তাঁর স্বামী।তাঁর কাজকর্মে অনেক অসচ্ছতা আছে, রবার্ট ভদ্র যদি তাঁর স্বামী না হতেন, তাহলে রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে সুবিধা হত। অন্যদিকে যোগী অনেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ভয়ঙ্কর হিন্দুত্ববাদী, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত ক্যালকুলেটিভ। ফলে অ্যাডভান্টেজ পজিশনে আছেন।
► ভারতজুড়ে এই মুহুর্তে যে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে কি মনে হয় সহনশীলতার রাজনীতি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে?
♦ আমি ডিলিটের জন্য একটা থিসিস লিখেছি, জমাও দিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গৌতমবুদ্ধের দর্শন নিয়ে। গৌতমবুদ্ধ যা যা বলেছিলেন, আমি আমার বাস্তব জীবনে দেখেছি অনেক মিলে যাচ্ছে।
► বুদ্ধিজমের যে বিষয়টার কথা আপনি শুরুতেই বলেছেন, সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, এই জায়গার সঙ্গে মার্কসিজমের কোন মিল খুঁজে পেয়েছেন?
♦ মার্কসিজম নিয়ে আমার রিসার্চে আমি উল্লেখ করেছি। কার্লমার্কসও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ল্যান্ড-মাইনস, কলকারখানা সবই রাষ্ট্রের হাতে আসবে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা তিনি বলেছেন। একদলীয় শাসন মানেই ডিক্টেটরশিপ চলবে, মানে একনায়কতন্ত্র। আর গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, সম্যবাদী ব্যবস্থা। হিন্দুধর্মের কিছু গোড়ামি, সংঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল। হিন্দু ধর্মে জাত-পাতের যে বিভাজন আছে, তার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। শিষ্যরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করত, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তিনি বলতেন তুমি নিজে ভালো হও, মানুষের ভালো করো।তিনি বলতেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা, এটা প্রচারের দরকার নেই। আত্মায় আমি বিশ্বাস করিনা, এটাও প্রচারের বিষয় হতে পারে না, তুমি মানুষের ভালো কাজ করে যাও। অহিংসার পথ, শান্তির পথের কথা বলেছেন। যদিও রাষ্ট্রের কথা বলেননি, কারণ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সেভাবে ছিল না। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন মানুষের দুঃখের কারণ কী? গ্রিড অ্যান্ড ইগনরেন্স, লোভ এবং অজ্ঞতা। বিশ্বে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে দিয়ে সব মানুষের সমান অধিকার, ন্যায় বিচার এই কথাটা তুলে ধরলেন। এবং কী পথে চলতে হবে তাও বলেছেন। মার্কসবাদের সঙ্গে গৌতমবুদ্ধের একটাই পার্থক্য, শেষ পর্যন্ত সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে একনায়কতন্ত্রের জন্ম দিলেন মার্কস, আর গৌতম বুদ্ধের দর্শনে সে কথার উল্লেখ নেই।
► পুরনো রাজনৈতিক সঙ্গী যাঁরা, আপনার পুরনো দল, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
♦ বামফ্রন্টের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু সিপিএম থেকে যারা বেরিয়ে এলেন আমার সঙ্গে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আমার আছে।
► ২০১১ সাল থেকে আইকেয়ার পশ্চিমবঙ্গের প্ৰথম বেসরকারি স্তরে মেডিক্যাল পড়ানোর সুযোগ পায়। এই মূহুর্তে প্রায় ১৯টি আলাদা আলাদা কলেজ গড়েছেন আপনারা। তবু কেন এখনও বিশ্ববিদ্যালয় গড়লেন না?
♦ ২০১৪ সাল থেকেই আমরা বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি, কিন্তু মনে হয় রাজনৈতিক কারণেই বঞ্চনার শিকার হয়েছি। অনেকে আমাদের পরে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তারা ইউনিভার্সিটি গড়ার অনুমতি পেয়ে গেল, শুধু আমাদের হল না। এবার আবার জমা দিয়েছি, কিন্তু আটকে আছে।
দেশের যুবশক্তিকে শক্তিশালী করতে গেলে শিক্ষার প্রসার গুরুত্বপূর্ণ। সেইজন্য আইকেয়ারের উদ্যোগে আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ারও চেষ্টা করছি। কিন্তু এজন্য কখনো আমি আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ চ্যুত হব না। রাজ্যের শাসকদলকেই সমর্থন করে যাব। যতক্ষণ না সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আমরা হ্রাস করতে পারছি, ততক্ষণ লড়ে যাব।
♦=♦=♦ ♦=♦=♦
আরও পড়ুন: ‘বিভাজকরা মানুষ নয়, অমানুষ, এদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়ে যাব আমি’: আব্দুল খালেক
❤ Support Us