- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- এপ্রিল ২২, ২০২৩
স্মৃতির নববর্ষ, স্মৃতির ইদ
ধর্ম একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সেটা আর এক ধর্মের মানুষের থাকে না। তাজমহল, কুতুবমিনার বা বিশ্বনাথমন্দির এখন আর হিন্দু বা মুসলমানের নয়। সবার।
দেশভাগের পর, পশ্চিমবাংলার কোনো মুসলিম লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী আত্মবৃত্তান্ত লিখেছেন, এরকম তথ্য আমাদের চোখে পড়ে না। ব্যতিক্রম প্রাক্তন সাংসদ আর প্রাবন্ধিক মইনুল হাসান। নিজের শৈশব, স্কুল-জীবন, কলেজ জীবন ফিরে দেখতে শুরু করেছেন তিনি। নির্মোহ আবেগে, মুক্ত দৃষ্টিতে। সহজিয়া ভঙ্গিতে। তাঁর ভাবাবেগকে ঘিরে পূর্বগামী আয়নায় ভেসে উঠছে প্রান্তিকের বৈচিত্রের বহু চিত্র ও চরিত্র। আমাদের ইদ, আমাদের নববর্ষ, আমাদের সব লোকায়ত উৎসবের নির্বিশেষ বিশেষায়িত হয়ে উঠছে টুকরো টুকরো নকশায়। এসব নিয়ে তাঁর বাল্যবৃত্তান্ত ‘ফেলে আসা দিনের কথা’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এ এক বিরল দলিল, যা অতীতকে নিয়ে আসে সামনে, উসকে দেয় অবিভাজ্য স্মৃতিকে।
বাহার উদ্দিন
উৎসব, আনন্দ, হাসিকান্না বাদ দিয়ে জীবন নয়, গ্রামও নয়। এই গ্রামে সেসব ছিল তা নয়। এখন যা আছে তা আমাদের ছোটোবেলাতেও ছিল। আনন্দ বেশি ছিল— আড়ম্বর কম ছিল । বার বার বলি মুসলমান প্রধান গ্রাম— কুমারপুর । মুসলমানদের সারা বছর উৎসব হাতেগোনা ২/৩টি । গ্রামে থেকে দেখেছি দুটো ইদ ও শবে বরাত । মোট ৩টি । ব্যস । একটা রোজার ইদ ।
এই ইদে মিষ্টির প্রাধান্য বেশি। পায়েস, সিমাই, পিঠে। বাড়িতে তৈরি হবে এবং পাশের ঘোষপাড়া থেকে দই রামুকাকা সরবরাহ করবে। এক মাস ধরে রোজা, উপবাস চলবে। মিষ্টির ইদ কেন বললাম ? তার একটা কারণ আছে। এখনও বহু অ-মুসলমান বন্ধু ইদের নাম শুনলে বলেন ‘মইনুল, এটা কোন ইদ? পায়েসের না মাংসের?’ সেই অপরিচয় ? যাক।
একদম ছোটোরা ও বয়স্ক অসুস্থরা বাদে গ্রামের সবাই রোজা করেন । তখন গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু তারা রোজা রাখতেন । সন্ধের একটু আগে থেকে দাঁতন করা শুরু হত । তারপর মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে ‘ইফতার’ করতে বসা । ছোলার ডাল ভেজা, শরবত, ফল, একটা রুটি ও তরকারি দিয়ে রোজা ভাঙা শেষ । তারপর নামাজ । বাড়িতে কোনোদিন খেজুর, তেলেভাজা, মুড়ি এসব দিয়ে ‘ইফতার’ করিনি । এখন তারই প্রাদুর্ভাব দেখি । ‘হালিম’-এর কথাই শুনিনি তখন । সারাদিন গ্রামটা চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকলেও সন্ধেবেলাটা চঞ্চল হয়ে উঠত । কেমন উৎসব-উৎসব মনে হত । শেষে আসত ইদের দিন। কুমারপুর গ্রামে আমার ছোটোবেলার ঈদ আর নেই । ছাদের খলিফার তৈরি করা নতুন জামা। চোখে সুরমা। কানে ছোটো তুলোর পুঁটলিতে আতর নিয়ে কানে গোঁজা। আব্বা হাট থেকে কিনে আনতেন বড়ো রুমাল। মাথায় টুপি দিয়ে ২ কিমি দূরে ইদ্গা যাওয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে নামাজ শুরু হওয়ার আগে চলত ভাষণ। পবিত্র কোরান থেকে পাঠ। ছোটো বয়সেই আমি বহুবার কোরান শরিফের বিশেষ অংশ মুখস্থ পাঠ করেছি। খুব একটা খারাপ করতাম না। এখন ভাষণ দিই। তেলাওয়াত (পাঠ) করি না।
পাশে হিন্দু গ্রাম। যাকে আমরা আজও ভুল করে রিফিউজি পাড়া বলি। সেখান থেকে অনেকে আসত ইদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। শ্রী সুফল হালদার, শ্রী সন্তোষ ঠিকাদার, শ্রী গুরুদাস সরকার নিয়মিত আসতেন। তাঁরা আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন। বাড়ি ফেরার পথে আমাদের বাড়ির আটচালায় বসে দই-মিষ্টি-পায়েস খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।
এর পর বকরি ইদ। কোরবানি’র ইদ। ছাগল গোরু উট দুম্বা সবই কোরবানি হয়। ছাগল, গোরুই বেশি। আমাদের বাড়িতে উট বা দুম্বা কোনোদিন হয়নি। একইভাবে নামাজ পড়ে এসে কোরবানি করা হয়। মোট মাংসর একভাগ নিজের জন্য রেখে বাকিটা বিতরণ করা হয় আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিদের মধ্যে। ছোটোবেলায় মাংস বিতরণ করেছি উৎসাহের সঙ্গে। মনে পড়ে ছাগলের মাংস ব্যাগে করে নিয়ে শিশির সমাজদার, সুফল হালদার, সন্তোষ ঠিকাদার মাস্টারমশাইদের বাড়ি দিতে গেছি। একবার তো সুফলবাবুর স্ত্রী সেই মাংস অতিদ্রুত রান্না করে আমাকে খেতে দিলেন এবং বাড়ির সবাইকে খেতে দিলেন। সেদিনের আনন্দের কথা কোনোদিন ভুলব না। আজ সুফলবাবু বেঁচে নেই। তার উদার, সমন্বয়বাদী চিন্তা আমরা তাঁর ছাত্ররা এবং কুমারপুরের লোকজন আজও স্মরণ করি।
ইদের দিনের খাওয়াদাওয়া নিয়ে কথা বলি। খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে কোনো অনুষ্ঠান বাঙালির হবে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সাজো-সাজো রব। রান্নাঘরে মায়ের ব্যস্ততা। গরম গরম লুচি মিষ্টি পায়েস আলুর দম একদফা খেয়ে ইদ্গায় হাজির। নামাজ শেষে ফেরা। প্রায় ৫ কিমি হাঁটা। খিদের জ্বালায় পুড়ছি। আবার একদফা লুচি-মিষ্টি। এবার দুপুরের জন্য অপেক্ষা। ইতিমধ্যে বাড়িতে এসে গেছে দূর থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা। আতরের গন্ধে মাতোয়ারা পরিবেশ। ইদ মুবারক। ছেলেমেয়ে সবাই সবাইকে ইদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা রান্নায় রত। বেশির ভাগই হত পোলাও। সঙ্গে অঢেল মাংস। অন্য সবজি বাতিলের দলে। আমার মা তৈরি করতেন। ভুনা খিচুড়ি”। না পোলাও, না বিরিয়ানি, না খিচুড়ি। মোহময় তার স্বাদ। বছরের পর বছর একই মেনুতে মা স্থিত থেকেছেন। এখনও বাড়িতে তা রান্না হয়। সেই স্বাদ নেই। তবে মা’র উপস্থিতি আছে। সেটাই বা কম কী! সময় পালটে গেছে। এখন আর ‘ভুনা খিচুড়ি’র যুগ নেই। এখন অন্য কিছু। সেটাই দস্তুর। ইদের দিন হয়েছে যার বাড়িতেই ইদ মুবারক দিতে যাচ্ছি তারাই খাইয়ে দিচ্ছে। শেষে বাড়িতে এসে মায়ের রান্না আর খেতে পারি না। মা’র মন খারাপ। পরে মা ঠিক করলেন নিজ বাড়িতে খেয়ে তবে ঈদ মুবারক’ দিতে যাওয়া হবে।
রোজা খোলা বা ইফতারের একটা ছোটোবেলাকার ঘটনা মনে পড়ছে। বাড়ির ভেতরে আব্বা, আমরা দুই ভাই, মা রোজা খুলতাম। প্রত্যেকদিনই বাইরের আটচালায় ১ ডজন মানুষ থাকতেন। যারা রোজা খুলতেন। আমাদের বাড়ি থেকেই ইফতার যেত। তারা মূলত আমাদের দূর সম্পর্কীয় নিকট আত্মীয়’ ছিলেন। একদিন মেঘলা আকাশ, অন্ধকার হয়ে আছে। আমরা সাবধান আছি। ঘড়ি না দেখে রোজা খোলা হবে না। হঠাৎ মসজিদে আজান। আব্বা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে ওঁদের বল রোজা খোলার সময় হয়নি।’ আমি যেতে যেতেই দেখি তাদের রোজা খোলা সারা। ঠিক তখনই মেঘের মধ্যে সূর্য সামান্য উকি দিয়েছে। আমরা তো হাসতে হাসতে মারি। কিন্তু যারা রোজা আগেই খুলে ফেললেন তাঁদের কান্না আজও আমার কানে বাজে। আমরা অবশ্য বললেন যে, “অজান্তে এটা হয়েছে । ৫/৬ মিনিট আগে এটা হয়েছে। রোজা হবে। তারপর তাদের কান্না থামে। ইদের আগের দিন সন্ধ্যায় থাকত চাঁদ দেখার উন্মাদনা। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। কে আগে চাঁদ দেখবে তার প্রতিযোগিতা। চুলের মতো সরু চাঁদ দেখলেই উল্লাস। এখন তো কাড়ানাকাড়া বাজে। তখন তা ছিল না। দল বেঁধে সবাই আনন্দ করতে করতে মসজিদ অথবা পাড়ার মোড়ে জমায়েত হত। আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা তখন। অনায়াসে একটা ফুটবল খেলার মাঠ করা যায়। সেখানেই লোকজন জমায়েত। একটাই কথা- কাল হল। এতেও সমস্যা কম ছিল না। মেঘলা দিন হত। চাঁদ দেখা যেত না। তখন একমাত্র ভরসা রেডিয়ো সংবাদ। কলকাতা সংবাদে ভরসা নেই। রাজশাহী রেডিয়ো শোনা হত। যেটা আমাদের গ্রামের সবাই শুনত। তার প্রধান কারণ কলকাতার চাইতে পরিষ্কার শোনা যেত। আসলে চাঁদ দেখার পরই গ্রামে উৎসবের আমেজ দেখা যেত। তবে এখনকার মতো মোড়ে মোড়ে গেট, বিচিত্রানুষ্ঠান ছিল না।
শবে বরাত। রোজা শুরু হওয়ার পনেরো দিন আগে অনুষ্ঠানটি হয়। দিনটি আমার উপসানা করার দিন। সারারাত নামাজ পড়ে কাটানোর চেষ্টা করে অনেকেই। মনে পড়ে, একবার শবে বরাতের রাতে ১০০ রাকাত নামাজ পড়েছি। ইচ্ছা ছিল ফজর পর্যন্ত পড়ব। কিন্তু রাত্রি দু’টোর মধ্যেই শেষ। সেদিন সকালে আর সময়মতো জাগতে পারিনি।
এবাদত তো হল। কিন্তু খাওয়াদাওয়া হবে না ? তাই কি হয় ? হালুয়া-রুটি প্রধান খাদ্যবস্তু। মূলত চালের ময়দা করে নরম পাকে রুটি হত। আর হালুয়া। সুজি, ছোলা, ডিম দিয়ে নানা পদের হালুয়া। সেটা আবার পাড়ায় পাড়ায় বিতরণ হত। সেটাই আসল আনন্দ। সবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সেটা জেনে আমার মা তাদের বাড়ি হালুয়া-রুটি পাঠাতেন। অনেকে বলেছেন হালুয়া-রুটি করা ইসলামসম্মত নয়। সে যাই হোক— খেতে যে খারাপ লাগেনি তা বলাই বাহুল্য। হালুয়া-রুটি মসজিদে জমা হতেও দেখেছি। তারপর বিভিন্নজনের বাড়ি বিতরণ হত। পাশের গ্রাম লক্ষ্মীনারায়ণপুর। সেখানে দুর্গা পুজো হয়েছে। আমরা তো বটেই, গ্রামের বহু মানুষ তাতে আনন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, আজও দেয়। কুমারপুরের মানুষজন না গেলে বা কম গেলে ডেকে পাঠানো হয়। আমাদের ছোটোবেলায় ৩/৪ দিন ওখানেই আড্ডা চলত। সঙ্গে পঞ্চরস গান। রাধারানীর কীর্তন। কদমা, বোঁদে আর লুচি। আজও সে স্বাদ লেগে আছে জিহ্বায়। এর মধ্যেই হত ভাইফোঁটা ও নববর্ষ। ভাইফোঁটাটা হিন্দু পাড়াতেই হত। নববর্ষে সব দোকানে হালখাতা। তারই দুটো বর্ণনা এখানে দিয়ে রাখি—
তাহিরচাচার মনোহারী দোকান। এখন যার পোশাকি নাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ছুঁচ থেকে কম্বল, সিমেন্ট থেকে হাঁড়ি-কড়াই অথবা ১ পয়সা দামের লবঙ্কুম আর রঙিন চুড়ি— সব পাওয়া যাবে। আগের দিন বিকেল থেকে সেখানে সাজো-সাজো রব। লাল-সবুজ-হলুদ রঙের কাগজ কেটে শিকলি বানিয়ে দোকানে টাঙানো হচ্ছে। বিস্তর বট আর কাঠালপাতা এনে গেট বানানো হচ্ছে। দোকানের দাওয়াটা এমন পরিষ্কার করা হয়েছে যেন মাজা কাসার থালা। আমরা দুই ভাই ১০ টাকা নিয়ে, পরনে নতুন জামা, পায়ে জুতো, হাজির সেখানে। আজ পয়লা বৈশাখ। তাহিরচাচার দোকানে হালখাতা। সব খদ্দের হাজির। যার যা পুরাতন বকেয়া মেটাচ্ছে। সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট। এখনকার মতো চৌকোনো, রাবার জড়ানো প্যাকেট নয়। কাগজের ঠোঙা। একটু অদ্ভুত গন্ধ আর মাদকতা। দাদা বলতেন তাহিরচাচা আতর মেখেছেন আর ধূপের গন্ধ দিয়েছেন। আমাদের খেতে দেওয়া হত মতিচুরের নাড়ু। সঙ্গে দুটো কাগজের ঠোঙা। একটা বড়ো খাতায় আব্বার নাম লিখে ১০ টাকা জমা করা হত। রাস্তার ফেরার সময় ঠোঙা খুলে ফেলতাম। শুনে শুনে ১০টা রসগোল্লা। কোনোদিন বেশি বা কম হয়নি। বাড়িতে পৌঁছেই দেখছি পাশের পাড়া থেকে রাসুকাকা এসে গেছে। রাসু ঘোষ। আজ নববর্ষ। মা নিচ্ছেন দই, মিষ্টি, বোঁদে আর ছোটো ছোটো গুজিয়া। বাড়ির ছোটোদের তখন আনন্দ ধরে না। পড়ালেখা বন্ধ। দুপুরে কী রান্না হচ্ছে তারই অপেক্ষায় সময় কাটানো।
আগাপাশতলা একটা মুসলমানদের গ্রাম। নববর্ষের অনুষ্ঠান হতে আটকায়নি। এ তো বাঙালিদের উৎসব। কোনো ধর্মই বাঙালিত্বকে খাটো করতে পারে না। আমাদের গ্রামে ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি ইদ বা বকরি ইদের পর বড়ো অনুষ্ঠান নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ।
আমার নানা (মায়ের বাবা) একজন ছোটোখাটো জমিদার ছিলেন। আমার মায়ের ভাষ্যে, বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পুণ্যাহ হত। অর্থাৎ সেদিন প্রজারা জমিদারের সব পাওনা মিটিয়ে দিতে চাইতেন। সবাই পারতেন এমন নয়। কিন্তু সবাই এসে হাজির হতেন জমিদার-দালানে। এক বিশাল আয়োজন সেখানে। রান্না, খাওয়াদাওয়ার এলাহি ব্যাপার। আসল ব্যাপারটা বিকেলবেলায় ঘোষণা করতেন। কাল এখানে সবার জিয়াফ। কাল নতুন বাংলা বছর শুরু হচ্ছে। পয়লা বৈশাখ। সবাই আসবেন। পাশের গ্রামের হিন্দুরা আসতেন। তাঁরা মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা। ঘোষপাড়াতে তৈরি নানা রকম মিষ্টি বিতরণ হত। সবাই নতুন জামাকাপড় পরতে পারেনি। কিন্তু জামা লুঙ্গি পাজামা সাবানে কেচে পরেছে। কানে তুলোয় মাখা একবিন্দু আতর গুঁজেছে, যেন অকালে কোনো পরবে তারা মিলিত হয়েছে। গান-বাজনা না হলে নববর্ষ ঠিক জমাট বাঁধে না । গ্রামে তখন একটাই রেডিয়ো। নানা-র বাড়ির দোতলায়। গাঁক গাঁক করে সেটাতে বিবিধভারতী বা রেডিয়ো সিলোন বাজছে। আমিন ভাইয়ের জাদুকণ্ঠ ভেসে আসছে। তবুও ফাঁকা থেকে যাচ্ছে।
লক্ষ্মীনারায়ণপুরে কীর্তন পঞ্চরসের আসর। আর যায় কোথা। এক ছুটে আমরা সবাই সুমতিমাসির বটতলা পেরিয়ে সোজা মজুমদার বাড়ির আঙিনায়। শ্রোতাদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। গান উপলক্ষ্যে সেখানে একটা ছোটোখাটো মেলা বসে গেছে। হাতের চুড়ি থেকে মদন-কুটকুট বিস্কুট— সব বিক্রি হচ্ছে । তখন কীর্তনের খোলে চাঁটি পড়ছে। ভাবের সাগরে ভাসছে সবাই। হঠাৎই মনে পড়ছে প্রায় ৩০০ বছর আগে জন্মেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ। তাঁর গানে মুসলমান শ্রোতারা মাতোয়ারা হচ্ছেন। সংস্কৃতিবন্ধন এটাই। ক্ষমতা এটাই। কোনো পরিচয় নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে । আবার বলি মানুষের মধ্যে। তখন মানুষের পরিচয় হয় মানুষ । অন্য সব পরিচয় থাকে, কিন্তু গাছের গায়ে থাকা শুকনো বাকলের মতো। বাংলায় যে নববর্ষ আজ আমরা পালন করি তা সম্রাট মহামতি আকবরের কাছ থেকে পাওয়া। রাজস্ব আদায় ও শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে এ কাজ তিনি ও তাঁর সভাসদেরা করেছিলেন। সম্রাট আকবর সংগীত ও উৎসবের পক্ষপাতী ও উৎসাহদাতা ছিলেন। মুঘল সম্রাটরা বহুজন দোল উৎসবে সক্রিয় অংশ নিতেন। নববর্ষে জাঁকজমক করে সংগীতের আসর বসাতেন।
এরই নাম ভারত। তাহিরচাচার মতো মানুষরা মাথায় টুপি দিয়ে, কানে আতর গুঁজে হালখাতা করেন। কেন যে মোটা লালরঙের সুতোয় জড়ানো খেরোর খাতাটির ওপর একটি হলুদ টিপ পরিয়ে রাখতেন জানি না। বড়ো হয়ে জিজ্ঞাসা করলে এক ভুবনভুলানো হাসি ছাড়া কিছু পাইনি। সত্যিই তো! সত্যিই তো ব্যক্তিমানুষের তল কে কবে পেয়েছে !
সেই ভারতেই আজ আকবর বাদশাহকে অত্যাচারী শাসক বলে ইতিহাসের পাতায় মাত্র দেড় পাতা বরাদ্দ হচ্ছে। এরও নাম ভারত । ধর্ম একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সেটা আর এক ধর্মের মানুষের থাকে না। তাজমহল, কুতুবমিনার বা বিশ্বনাথমন্দির এখন আর হিন্দু বা মুসলমানের নয়। সবার।
এখানেই ভারতের বহুত্ববাদের জয়। সেই জয়ের সামনে বড়ো বাধা হয়ে ধেয়ে আসছে দেশের শাসকবর্গের কুৎসিত সিদ্ধান্ত। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ তারা নিয়ন্ত্রিত করবে। ধর্মের উৎসবের সবার আনন্দ ভাগ বন্ধ হবে। সে কারণেই নবরাত্রির মুহূর্তে দিল্লিতে মাংসের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। হিজাব নিষেধের নামে শিক্ষার দফারফা হচ্ছে।
তাহলে আমাদের তাহিরচাচা ও রমেশ কাকারা নববর্ষের উৎসবে মেতে, মিষ্টি বিতরণ করে কোন অপরাধে অপরাধী ? অথবা আমার নানা, যিনি পুণ্যাহ ও নববর্ষে ডেকেছেন প্রকৃত ভারতাকে। যা আছে মাটির কাছে জাতি-ধর্মের সীমানা পেরিয়ে। মনে করিয়ে দেয় এ ঘটনা অক্ষয়। এই তার যেদিন কেটে যাবে (যা কোনোদিন হবে না) সেদিন আমরা মানুষের পরিচয়ে থাকব না। বাঙালির পরিচয়ে থাকব না। তাই, নববর্ষ পালনের ঝাঁ-চকচকে মৌতাতকে হারিয়ে দিয়ে তাহিরচাচার দোকানের কাগজের ঠোঙার রসগোল্লা আর মজুমদারবাড়ির উঠোনের রামপ্রসাদি গান একতারে বাঁধা পড়ে। আজও। এই আমাদের বাংলা। আমাদের সবার ইদেও এই ঝোঁক, এই প্রেম গগনচারী। অপরাজেয়।
সৌজন্য: ফেলে আসা দিনের কথা, প্রকাশক সূত্রধর
♦♣♠
❤ Support Us