- খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
- অক্টোবর ১০, ২০২২
সমাজবাদী রাজনীতিতে হঠাৎ শূণ্যতা, চিত্তজয়ী মুলায়ম প্রয়াত
আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, কংগ্রেস আর বিজেপির প্রবল বিরোধী মুলায়েম আশির দশকে বিরোধী কনক্লেভ বা তৃতীয় ফ্রন্টের রাজনীতির অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি ।

সমাজবাদী রাজনীতিতে, মূলায়ম সিং এর মৃত্যুতে যে শূণ্যতা তৈরি হল, তা সহজে পূর্ণ হবে না । রামমনোহর লোহিয়ার প্রত্যক্ষ শিষ্য হলেও, তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন জ্যোতি বসু । বসুর আদর্শ তাঁর রাজনৈতিক চেতনার অবলম্বন, একথা জীবনের নানান পরিসরে তিনি বলেছেন । এমনকি, দলীয় সিদ্ধান্তে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী না হতে পারার বিষয়ে, জনসমক্ষে সিপিএমের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি ।
আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, কংগ্রেস আর বিজেপির প্রবল বিরোধী মুলায়েম আশির দশকে বিরোধী কনক্লেভ বা তৃতীয় ফ্রন্টের রাজনীতির অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি । এক্ষেত্রে প্রধান নেতার ভূমিকায় বসুকে দেখা গেছে । বসু যা ভাবতেন, মুলায়মের চিন্তা আর ভাবনায় তার প্রতিচ্ছবি দেখা যেত। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল, বিজেপিকে অচ্ছুত করে রাখা, কংগ্রেসকে হটানো এবং জাতপাতের বিভেদকে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যাওয়া । দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, সমাজবাদী পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সামলানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে এবং তিন মেয়াদে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি । ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ এবং ২০০৩ থেকে ২০০৭ । ১৯৯৬ সালে প্রথম বার সাংসদ হন । কেন্দ্র দেবেগৌড়া সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন । উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস এবং বিজেপির একচেটিয়া আধিপত্য রুখে নিজের এক আলাদা পরিচয় বানিয়েছিলেন তিনি । ২০০৯ সাল থেকে আমৃত্যু সংসদের সদস্য ছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘নেতাজি’ বলে পরিচিত এই যাদব নেতা ।

চিত্র: সংগৃহীত
১৯৩৯ সালে, ২২ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের ইটাওয়া জেলার সাইফাইয়ে, এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মুলায়ম । বাবা সুঘর সিংহ যাদব। মা মূর্তি দেবী । ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতির সঙ্গে সখ্য । রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর শিক্ষক পদে কর্ম জীবনের শুরু। পরবর্তীতে রাজনীতিই হয়ে ওঠে তাঁর পূর্ণ সময়ের কর্ম পরিসর । জনচিত্ত জয়ী এই বাগ্মীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় কেটেছে কুস্তির আখড়ায়। সেখান থেকেই রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ । শোনা যায়, এক কুস্তির আখড়ায় তাঁকে আবিষ্কার করেছিলেন জনতা দলের বিধায়ক নাথু সিং। ১৯৬৭ সালে প্রথমবার উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন । এরপর ৮ বার তিনি বিধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৭ সালে, প্রথমবার তিনি উত্তরপ্রদেশ মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে জনতা দলের সভাপতিও নিযুক্ত হন । ১৯৮৫ সালে দল ভেঙে যাওয়ার পর চন্দ্র শেখর এবং সিপিআই-এর সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি গড়ে তোলেন “ক্রান্তিকারি মোর্চা” । এই জোটের হয়েই ১৯৮৯ সালে তিনি প্রথমবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন । ১৯৯০ এ কেন্দ্রে ভি.পি. সিং সরকারের পতনের পর জনতা দল (সমাজবাদী)-তে যোগ দেন মুলায়ম । তখনও তিনিই ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী । এরপর ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সমাজবাদী পার্টির ১৯৯৩ এ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বহুজন সমাজ পার্টির সঙ্গে জোট গড়ে, দ্বিতীয় মেয়াদে উত্তর প্রদেশের মসনদে ফিরে আসেন মুলায়ম ।
১৯৯৬-এ উত্তর প্রদেশের মৈনপুরী লোকসভা কেন্দ্র জিতে, যুক্তফ্রন্ট জোট সরকারের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন । দুই বছরের মধ্যেই কেন্দ্রে সেই জোট সরকারে পতন হয়। কিন্তু ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ এর নির্বাচনে ফের সাংসদ নির্বাচিত হন মুলায়ম । ২০০৩ উত্তর প্রদেশ ক্ষমতায় ফিরে আসে সপা, আবারও মুখ্যমন্ত্রী হন উত্তরপ্রদেশের নেতাজি । ২০০৭-এ উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পালাবদল ঘটলেও, ২০১২ সালে বিধানসভায় সপার জয় সুনিশ্চিত করার পর পুত্র অখিলেশকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন । ২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে, উত্তরপ্রদেশের মৈনপুরী থেকে বিজিত ছিলেন তিনি ।
যতদিন তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, ততদিন গো বলয়ের কেন্দ্রভূমিতে বিজেপি মাথা তুলতে পারেনি । বিহারের লালু প্রসাদ যাদব তাঁর সতীর্থ । দুজনের রাজনৈতিক সমীকরণ ভারতের রাজনীতিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে । লালু তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব আর মুলায়েম তাঁর সন্তান অখিলেশের মধ্যে সমাজবাদের চেতনাকে অঙ্কুরিত করে গেছেন । এই রাজনীতিই ভবিষ্যতের ভারতকে নেতৃত্ব দিতে থাকবে । বিজেপি যে পথে হাঁটছে, কংগ্রেস যেভাবে আধা সামন্তবাদ আর উচ্চকোটির মতবাদকে জড়িয়ে আছে, তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সায় নেই । কমিউনিস্ট, সমাজবাদী আর আঞ্চলিক দলগুলি হয়তো বা তাঁদের ভিত আবার স্থাপন করবে। এখানেই জ্যোতি বসু, মুলায়ম আর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এর মতাদর্শ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। মুলায়ম সিং এর দৈহিক মৃত্যু মেনে নিয়ে বলতে হয়, তাঁর চেতনা মৃত্যুহীন ।
❤ Support Us