- প্রচ্ছদ রচনা বৈষয়িক
- সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২
সামাজিক দায়বদ্ধতার শীর্ষে বাংলার মুর্শিদাবাদ
ঐক্যের নির্মাণেও উদ্যোগপতিরা স্বতন্ত্র ছত্রধর

জাকির হোসেন । প্রাক্তন মন্ত্রী । পেশাদার শিক্ষাব্রতী, স্বতঃস্ফূর্ত সমাজ সেবক । পুজোয়, অন্তত ৩০ হাজার দুঃস্থ পরিবারকে; পোশাক-আশাক উপহার দেবেন ঔরাঙ্গাবাদের স্থায়ী শিল্পপতি । শিক্ষা ও সমাজ সেবায় জাকিরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ । এ ব্যাপারে তিনি, সম্ভবত তাঁরই নিকটাত্মীয় মোস্তাক হোসেনের ভাবাবেগের নিখুঁত অনুসারী ।
বাংলার অর্থনীতিতে মুর্শিদাবাদের সংযোজনের গুরুত্ব অপরিসীম । কুটির শিল্প, মাঝারি শিল্প আর বূহৎ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত জেলার কয়েকজন প্রথমসারির উদ্যোগী, যেভাবে শিল্প, স্বাস্থ্য পরিষেবা আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ববোধকে, তাঁদের লোকায়ত জনসেবার সঙ্গে ধর্ম পরহিতের অভিপ্রায়কে, নানাদিকে জড়িয়ে দিয়েছেন, তা সাম্প্রতিকের ইতিহাসে বিরল ।
মোস্তাক হোসেন এর নেতৃত্বাধীন পতাকা আয়তনে, সম্বৃদ্ধিতে দেশের একহাজার প্রতিষ্ঠানের অন্যতম । বিভিন্ন সমীক্ষায় তা স্বীকৃত । নিখুঁতভাবে খতিয়ে দেখা হলে, প্রমানিত হবে সোশ্যাল কর্পোরেট রেসপন্সিবিলিটি পালনে পতাকার ন্যায় আর ব্যয় দেশের বহু বহু বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে । পতাকা নিঃখরচায় অর্ধশতকের বেশি স্কুল চালায়, বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য করে, সামাজিক উৎসবে প্রান্তিক মানুষের দিকে বাড়িয়ে দেয় উদার হস্ত, বিলিয়ে দেয় আকাতরে জাকাতের টাকা, গরিব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগায়, সামাজিক সুবিচার আর দায়িত্ববোধকে ব্যক্তি আর পারিবারিক বৃত্তের বাইরে নিয়ে এসে বুঝিয়ে দিতে চায়, যে, আমাদের অর্জন আর সঞ্চয় সীমিতহাতের নির্মান নয়, আমরা স্বপ্নের কারিগর হতে পারি, বাস্তবের রূপকার আমাদের কয়েক লক্ষ্য কর্মী আর কর্মীদের পরিবার । অতএব যে কোনও সঙ্কটে, উৎসবে আমাদের অর্জনের অংশ তাঁদের ন্যায় সঙ্গত প্রাপ্য ।
আধুনিক অর্থশাস্ত্রের নির্নীত সামাজিক দায়িত্ববোধ খাতায় কলমে শিখতে হয়নি, মোস্তাক হোসেন আর তাঁর সমকালের স্বগোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের । প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস, গণদেবতার সঙ্গে নিরন্তর সংশ্রব, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং সহজিয়া ও অনুশাসিত ধর্মের নির্দেশ তাঁদের হিতাকাঙ্খাকে প্রাণিত করেছে । গল্প নয়, মোস্তাক হোসেন এর আত্মবূত্তান্ত, যা এখনও অর্ধসমাপ্ত, যার খসড়া আরম্ভয় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে, সে অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, ১৯৭৬ এর মন্বন্তরে, মোস্তাকের একজন সংবেদনশীল পূর্বপুরুষ, গরিবউল্লাহ-র বাড়িতে প্রতিদিন হাড়ি হাড়ি খিঁচুরি রান্না হত । আশপাশ সব গ্রামের দুর্ভিক্ষ পীড়িত, দুঃস্থজনকে খিঁচুড়ি খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন গরিব উল্লাহ । তাঁর নামের সঙ্গে গরিব শব্দটি বিনম্র, চিত্তের বৃত্তে তিনি ছিলেন প্রবল ধনী । অপরাজেয় । ওই গরিবউল্লাহর রক্ত মোস্তাকের শিরা উপশিরায় বইছে । একারণেই সামাজিক দুর্যোগে, উৎসবে এই রক্তেরই পরিবাহক মোস্তাকের পক্ষে উদ্বিগ্ন অথবা উজ্জ্বল হয়ে ওঠা স্বাভাবিক । তাঁর সামাজিক দায়িত্বের নৈতিকতা আমরা কাছ থেকে দেখি । দূরে দাঁড়িয়েও দেখি । প্রচার বিমুখ ব্যক্তি । তাঁর ধ্যান যেমন নিঃশব্দ, দানকথা তিনি যথাসম্ভব আড়ালে রাখতে অভ্যস্ত ।
গতশতাব্দীর শেষবর্ষের কথা । নজিরবিহীন বন্যায় ডুবে গেল বাংলা । গাছের ডালে আশ্রয় নিচ্ছেন মানুষ । পাকাফলের মতো ঘুমন্ত শিশুরা গাছ থেকে খসে পড়ছে । গবাদি পশু আর মানুষ একসঙ্গে ভেসে যাচ্ছে । ত্রাণে টাকা দিল না কেন্দ্র । রাজ্যে হাহাকার । ত্রাণ নিয়ে অবাঞ্ছিত রাজনীতি চলছে । বাংলার নবজাগরণ এর মতো পতাকাও ত্রাণ সামগ্রী জড়ো করে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিতে শুরু করল । বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মানের দায়িত্ব কাঁধে নিল । সাহায্যের পরিমাণ বেনজির । প্রচারে ঢাকঢোল নেই । নিঃশব্দে গ্রামে গঞ্জে ত্রাণ হাতে, পুনর্গঠনে ছড়িয়ে পড়লেন পতাকার কর্মীরা । আইলার মুহুর্তেও পতাকার এরকম ভূমিকা আজ এক ইতিহাস ।
করোনা সঙ্কটে, লকডাউনে গোড়ার দিকে স্তব্ধ তাঁদের কারখানা । রাজ্যের বহু জেলায় । আয়হীন, অন্নহীন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কয়েকলক্ষ সদস্য । বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছিয়ে দিলেন পতাকার কর্মীরা । পরে লকডাউনের বিধিনিষেধ আর আরোপিত দূরত্ব মেনে শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি ক্ষুদ্রকুটির শিল্পের উৎপাদনের রসদও পৌঁছে গেল । মোস্তাকের বক্তব্যে, এব্যাপারে কোনও সংশয় নেই, ধোঁয়াশা নেই, ‘ ওঁরা, শ্রমিকরা কেবল সহকর্মী নন, আমাদের অকৃত্রিম সহমর্মীও । ওঁরাই সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখেন । জাগিয়ে রাখেন । ওঁদের জন্য জেগে থাকি আমরাও।
বাণিজ্যিক সংস্থার দায়িত্ব সচেতনতা যখন উঁচু হতে থাকে, যখন কল্যানবোধ তাঁর সহজধর্মের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, সে তখনই মাটিতে দাঁড়িয়ে, মাটির আর মানুষের উর্বরাশক্তিকে অনুভব করে তার মর্মে এবং নিজেকে সংস্থার সহকর্মী আর সহমর্মীদের ভেতরে । বাইরে বিস্তৃত করে তোলে তার বানিজ্যিক দায়িত্ব । যা অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত । স্বভাবজাত এবং ব্যক্তিগত ।
রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ অর্জুনকে দেখে, বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, অর্জুন তুমি অর্জুন । মোস্তাক হোসেনকে এরকম সম্বোধনের সাহস নেই, ভাষাও নেই আমাদের । তবু, তিনিই যে তাঁর তুলনা, একথা বলতে দ্বিধা নেই কোনও । সময় প্রায়ই জীবিত মেধা কিংবা প্রজ্ঞার অদৃশ্য অন্তরলোকে দৃষ্টিপাত করতে দ্বিধাবোধ করে । এর ভার ছেড়ে দেয় ভবিষ্যতের হাতে । জীবদ্দশায় ব্যক্তিপুজো নয়, কিন্তু ব্যক্তি আর তাঁর নিঃসঙ্কোচ অনুসারীদের, গুণমুগ্ধদের মূল্যায়ন করতে বাধা কোথায় ? সাম্প্রতিক যা বৃহত্তর সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ, তার উপাদান, তার কর্মকান্ড, তার দূরদৃষ্টি কি আলোকপাতের বাইরে থেকে যাবে ? ইতিহাস চর্চা আজ বহুপথে বিস্তৃত । দিগন্ত তার বহুমতের, বহু দর্শনের সহসঙ্গী যখন, তখন মঙ্গল সূচকের হৃদয়বৃত্তি আর কর্মের রসদ সংগ্রহের ভার কেবল আগামীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কতটা সঙ্গত? এতে অনুদানের বৃত্তান্ত আর ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় না ?
মোস্তাক হোসেন থেকে জাকির হোসেন, শাজাহান বিশ্বাস, সাংসদ খলিলুর রহমান পর্যন্ত যাঁদের জন্ম কৃষিভিত্তিক মুর্শিদাবাদে, ভেজা আর লালমাটির একাংশে, যাঁদের কর্মস্থল জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, সংলগ্ন জেলাগুলিতেও বিস্তৃত , তাঁদের হয়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে সামাজিক ন্যায় আর দায়িত্ববোধের নির্মাণ আর বিনির্মানকে নাগরিক কলকাতা এড়িয়ে যেতে পারে, হেয় করতে পারে, কিন্তু কল্যাণপ্রসূ অর্থনীতির বিদ্যাদাতা আর গবেষকরা অবজ্ঞা করবেন বলে মনে হয় না । মোস্তাক হোসেনের সামাজিক দায়িত্ববোধ আর সাম্প্রদায়িক ঐক্য তৈরির নিদর্শনের দিকে প্ৰথম আমাদের দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছিলেন অর্থনীতির শিক্ষক আর অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী । স্মৃতি তাঁর জাগ্রত । তিনি প্রায়ত । তাঁর ওই দৃষ্টিপাতের পরিসরকে আজ সদিচ্ছার নানাবর্ণে সাজিয়ে তুলেছেন মোস্তাক আর তাঁর ভাবাদর্শে প্রাণিত, অনুগত অন্যান্য উদ্যোগীরা । যখন সঙ্কট ঝাঁপিয়ে পড়ে, দুর্যোগে শ্রমিককর্মীরা দিশা হারায়, যখন নিশ্চিদ্র অন্ধকারকে অতিক্রম করে সমাজের বঞ্চিত, নিষ্পেষিত জনসত্তা সূর্যালোকের অপেক্ষায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখনই মুর্শিদাবাদের কয়েকগুচ্ছ উদ্যোগী, ছোটো বড়ো শিল্প কারখানার মালিক তাঁদের সঞ্চিত পুঁজির সঙ্গে হিতকর্মকে জড়িয়ে দিচ্ছেন । এটাও একধরনের আসক্তি । সদকায় এ জারিয়া— অনিঃশেষ, নিঃস্বার্থ দাতব্যকর্মের বিস্তৃতি । এর সঙ্গে খয়রাতির অহঙ্কার নেই, বিত্তবানের দেখানোপনা নেই, নেই আত্মউন্মোচনের প্রদর্শনকামিতা । পুজোর প্রাক্কালে, রমজানের ইদে, বড়ো ইদের উৎসর্গে খুদে, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের ( কর্মীসংখ্যার নিরিখে) উদ্যোগীদের পুণ্যঅর্জনের মোহকে ছাপিয়ে যায় তাঁদের মনের শাশ্বতধর্ম । এটাও একরকমের আসক্তি, বিবেকের জাগৃতি এবং মঙ্গলময়তার নিঃস্বর কর্মমুখর সংলাপ । ধর্মের নৈতিকতা এখানে সবিচারের উৎস হতে পারে, ধর্ম বিনিময়ে পুন্যঅর্জনের আশ্বাস দিয়েছে, আর আশ্বাসকে দাতা ব্যক্তি, সমষ্টি ভালোবাসায় রূপান্তরিত করে, নির্বিশেষের সমাজকেই মোহহীন উষ্ণতায় আলিঙ্গন করতে অধিকতর ব্যস্ত আর চঞ্চল হয়ে ওঠে ।
যেমন ইদে, অন্যান্য উৎসবে জাকির হোসেন, তাঁরই পূর্বগামী মোস্তাক হোসেনের মতো নিজের হূদয়কে জনবৃত্তের সামনে খুলে দেন, পুজোর আয়োজনেও ঠিক সেরকম উন্মুক্ত করে রাখেন, চিত্তের বুলন্দ দরোজা । জাকিরের প্রস্তুতি এবার শেষ পর্বে । দুর্বৃত্তদের বোমা তাঁকে সবদিক থেকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল । পারেনি । বাংলার সবচেয়ে বড়ো উৎসবের প্রাক্কালে অম্লান হাসি আর সংযত ভাষ্য পেশ করে, পোশাকের; বহুবর্ণ হাতে নিয়ে জাকির সম্ভবত বলবেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার । লাকুম দ্বিনুকুম, ওয়া লিয়া দ্বিন । আর গাইবেন উৎসবের চিরন্তন সত্যের, সীমান্তহীন সৌন্দর্যের, মহারবের সঙ্গায়িত বিভার নির্মলতম, অভীস্পিত সমসঙ্গীত ।
❤ Support Us