- খা | না | ত | ল্লা | শ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- মার্চ ২০, ২০২২
মাছে আলুতে বিলেতি মজলিশ
শনিবাসরীয় সাবাথে মাংস, দুধ খাওয়া বারণ ইহুদিদের । অন্যদিকে পশ্চিমী খ্রিষ্টানদের কেউ কেউ, তিথি মেনে শুক্রবারে মাংস খাননা । সাহেব মেমদের মন মজাতে মাছ মোর...

তখন সবে ইংরেজদের দেশে বাস করতে এসেছি। এক মুদিখানায় গিয়ে কাউন্টারে বসা দোকানীর পেছনের তাকে ভারতীয় ব্র্যান্ডের পটাটো চিপস এর প্যাকেট দেখে ভারি খুশি হয়ে এক প্যাকেট চিপস কিনতে চাইলাম। দোকানী ভদ্রলোক হিসেবের খাতায় ডুবে ছিলেন। আমার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে চোখ তুললেন। আমি আবার অনুরোধ করলাম চিপস দিতে। এবার তিনি যা বললেন তাতে আমি হতবাক। ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে জানালেন এটা তো চিপস শপ নয়। পাশের গলি ধরে মিনিট তিনেক হেঁটে গেলে চিপসের দোকান পাওয়া যাবে। হতবুদ্ধির মতো বললাম, তাঁর চেয়ারের পেছন দিকে তাকটায় ওই যে এতো এতো চিপসের প্যাকেট দেখছি, ওগুলো তাহলে কী! এবার তিনি নড়ে চড়ে বসে একটু হেসে বললেন, ‘আপনি বুঝি এ দেশে নতুন? ওটা তো ক্রিস্প।’
আজন্ম যাকে পটাটো চিপস বলে জেনে এসেছি আর প্যাকেটের পর প্যাকেট সাবাড় করে এসেছি, তার নামের এমন বদলে বেশ মুষড়ে পড়লাম। শেক্সপিয়রের দেশে এসেও ‘হোয়াটস ইন আ নেম’ বলে কাঙ্ক্ষিত চিপস থুড়ি ক্রিস্পের দিকে আর হাত বাড়ালাম না। তার বদলে চললাম ব্রিটিশ চিপস এর সঙ্গে মোলাকাত করতে।
পাশের গলিতে ঢুকে দু পা এগোতে না এগোতেই দেখি এক দোকানের সামনে লম্বা লাইন। দোকানের সাইনবোর্ডটা অনেকটা আমাদের ছোটবেলার কালো স্লেটের মতো, তাতে চক দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘বেস্ট ফিশ অ্যান্ড চিপস’। উঁকিঝুঁকি মেরে কাগজের ঠোঙায় চিপস এর চেহারার এক ঝলক দেখে মনে হলো, ও হরি, এ তো দেখি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, এর জন্যে এতো ভিড়! ভুল ভেঙেছিল অচিরেই। দুটি খাবারই আলুর সন্তান হলেও আমেরিকান-দের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের সঙ্গে ব্রিটিশ চিপসের চেহারায় ও স্বাদে তফাৎ রয়েছে। যাই হোক, লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আলু আর মাছ ভাজার জন্য।
এখন যেমন দেখছি, দেড়শ বছরেরও বেশি সময় যদি পিছিয়ে যাই তখনও দেখা যেত ব্রিটেনের প্রথম দিকের ফিশ অ্যান্ড চিপসের দোকানগুলোর সামনে খদ্দেরের এমনই ভিড়। ময়দা, ডিম, বেকিং পাউডার, বিয়ারের ব্যাটারে ডোবানো সামুদ্রিক মাছ, কড, হ্যাডক গরম তেলে ভাজা হচ্ছে, সঙ্গে লম্বা, মোটা করে কাটা আলু ডুবো তেল বা গলানো চর্বি থেকে ছেঁকে তোলা হচ্ছে ঝাঁঝরি হাতায়। দোকান গুলির মালিক, কর্মী গরিব ঘরের বিধবা থেকে শুরু করে বেকার, কাজ হারানো, কয়লাখনির শ্রমিক, মিল কর্মী, জাহাজের খালাসি, কসাইয়ের সহকারি, বাস ড্রাইভাররা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি পারিবারিক ব্যবসা। বাবা মায়ের সঙ্গে মাছ পরিষ্কার করতে, আলুর খোসা ছাড়াতে হাত লাগাতো স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরাও। সস্তা, সুস্বাদু ফাস্ট ফুডের পূর্বসূরি ফিশ অ্যান্ড চিপস আত্মপ্রকাশ করেই জনপ্রিয়তার শিখরে। সামান্য নুন আর মল্ট ভিনিগার ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে, খবরের কাগজের মোড়কে গরম গরম মাছ, আলু ভাজা হুশহাশ করে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অথবা নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডিনার হিসেবে খেতেন ব্রিটেনের শ্রমজীবী মানুষ। সেই প্রচলন আজও অব্যাহত।
তেলেভাজার সঙ্গে ভুঁড়িওয়ালা বাঙালির নাড়ির যোগ । কিন্তু গামলা গামলা তেলে ভাজা মাছ আর আলুর মজলিশে স্বাস্থ্য সচেতন ইংরেজরা কী করে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে চলেছে তা আশ্চর্যের ! আসলে শনিবাসরীয় সাবাথে (ইহুদিদের বিশ্রাম দিবস) মাংস, দুধ খাওয়া বারণ ইহুদিদের । অন্যদিকে পশ্চিমী খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ, তিথি মেনে শুক্রবারে মাংস খাননা । ফলে, এই দুটো দিনে সাহেব মেমদের মন মজলো মাছে । তাই তেলতেলে আঙুল চেটে কুড়মুড়ে মাছ আর মুচমুচে আলু ভাজার আসনটি রানির সিংহাসনের মতোই অনড়, অটল ।
যুগলে ফিশ অ্যান্ড চিপস ব্রিটেন জয় করলেও, এ দেশে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল আলাদা আলাদা। ইনকা-দের কাছে আলুর সন্ধান পেয়ে স্প্যানিশরা প্রথম আলু নিয়ে আসে ইউরোপে। সেই সময় বেলজিয়ামে বরফ পড়লে মাছ পাওয়া যেত না, মাছের বদলে আলুকে মাছের টুকরোর মতো লম্বা করে কেটে ভাজা করতে আরম্ভ করলেন গৃহিণীরা। তাদের হেঁশেল থেকে আলু ভাজা আস্তে আস্তে সারা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমে ইংরেজরা আলু সেদ্ধ করে খেত, অল্প মাখন বা পশুর চর্বি ছড়িয়ে। আলুর পাইও খেত। ক্রমে আলু ভেজে খেতে শিখল। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে মাছের অভাব কখনোই ছিল না। বেক করে কিম্বা স্যান্ডউইচে পুরে মাছ খেতে অভ্যস্ত ইংরেজদের ভাজা মাছ খেতে শিখিয়েছে অভিবাসী ইহুদিরা। ক্যাথোলিক চার্চের ইনকুইজিশনের শিকার হয়ে, স্পেন, পর্তুগাল থেকে অনেক ইহুদি চলে আসে ব্রিটেনে। নিজেদের ধর্মাচরণ, ধর্মীয় বিশ্বাস লুকোতে তাদের সাহায্য করলো ভাজা মাছ। প্রতি সপ্তাহের শনিবার দিন ইহুদিদের বিশ্রাম দিবস বা সাবাথ। মাংস, দুধ খাওয়া সেদিন বারণ। আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবারে মাছ ভেজে রেখে দিত তারা। কেউ কেউ রাস্তায় সেই ভাজা মাছ বিক্রি করতেও আরম্ভ করলো। এদিকে শুক্রবারে পশ্চিমের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের অনেকের আবার মাংস আহার ছিল নিষিদ্ধ (হিন্দুদের একাদশীতে শস্যদানা, নবমীতে লাউ খেতে মানা-র মতো ব্যাপার বোধহয়)। কাজেই মাছ ভাজা হু হু করে বিক্রি হতে শুরু করলো শুক্রবারে। ইহুদিদের পকেটও ভরল, প্রাণও বাঁচল। পরে, সপ্তাহের অন্যান্য দিনেও দেখা গেলো লোকে মাছ ভাজা খাচ্ছে। আসলে, সারাদিনের বিক্রিবাট্টার পরও অনেক মাছ পড়ে থাকতো বাজারে। মাছ বিক্রেতারা দেখলো কাঁচা মাছ কম দামে বিক্রি না করে ভাজা করে রাখলে বা বিক্রি করলে লাভ অনেক বেশি। প্রথমে বন্দর শহরে, পরে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে স্টিম ইঞ্জিন চালু হলে সারা ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ে মাছ ভাজার দোকান।
এমনি করে, রাস্তার এক দিকে আলু ভাজা, অন্য দিকে মাছ ভাজার দোকানে ব্রিটিশ খদ্দেরের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। মাছ আর আলু ভাজার মিলন ঘটিয়ে এক ছাদের তলায় কে যে এই দুটি খাবারকে প্রথম নিয়ে এলো তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ই যে ব্রিটেনে প্রথম ফিশ অ্যান্ড চিপস এর দোকান খোলা হয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
এক সময়ে যুক্তরাজ্যে ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিশ অ্যান্ড চিপসের দোকান ছিল। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় আর কোনো দোকান থাকুক না থাকুক ফিশ অ্যান্ড চিপস শপ থাকবেই। যৎসামান্য মূলধন নিয়ে আয়ের ভালো সুযোগ দেখে ইউরোপ, এশিয়া থেকে ব্রিটেনে আসা অভিবাসীরা যুক্ত হলেন এই ব্যবসায়। আর খদ্দেরের লাইনে কেবল ব্রিটিশ ওয়ার্কিং ক্লাসই নয় আস্তে আস্তে পর্যটক, ছাত্রছাত্রী, এমনকি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মন্ত্রী, বাকিংহাম প্রাসাদের কর্মচারীদেরও দেখা যেতে লাগলো! ফিশ অ্যান্ড চিপস হয়ে উঠলো ব্রিটেনের আইকনিক ডিশ। সাহেব মেমদের আদরের ‘চিপিজ’। শুধু ডিশ নয়, এ যেন একটা আবেগ। হবে নাই বা কেন? ফিশ অ্যান্ড চিপস যে কেবল উদরপূর্তি আর রসনা তৃপ্তির জন্য ব্রিটিশ-দের পাতে উঠেছে তা তো নয়। অসময়ের বন্ধু হিসেবেও এই খাবার-কে পেয়েছে ব্রিটেনবাসী। ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের লেখা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রত্যেক পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার। অন্য অনেক খাবার রেশনের তালিকায় থাকলেও, ফিস অ্যান্ড চিপস-কে সে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছিল। আলু আর মাছ ভাজা ব্রিটিশ জনসংখ্যার এক বড় অংশকে কর্মহীন হতে দেয় নি, খালি পেটে ঘুমতেও দেয়নি। অরওয়েলের মতে ব্রিটেনে যে রাশিয়ার মতো সামাজিক বিপ্লব হয়নি, এর অনেকটা কৃতিত্ব ফিশ অ্যান্ড চিপস এর!
বেগুনি, চপ, কাটলেট, ফুলুরি, তেলেভাজার সঙ্গে ভুঁড়ি ওয়ালা বাঙালির নাড়ির যোগ। কিন্তু গামলা গামলা তেলে ভাজা একটি খাবার স্বাস্থ্য সচেতন ইংরেজরা কী করে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে চলেছে এত বছর ধরে সেও এক আশ্চর্যের ব্যাপার। তবে, ফিশ আর চিপস অগুনতি ইংরেজ হৃদয় জয় করলেও, এর জয়যাত্রার পথটি মোটেই নিষ্কণ্টক ছিল না। দোকানের আশেপাশে থাকা বড় লোকদের বাড়ি থেকে কমপ্লেন যেত স্বাস্থ্য দফতরে, বিকট গন্ধ, ধোঁয়ায় তাদের অসুবিধে হচ্ছে। তৈলাক্ত খাবারটি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক-এ নিয়েও কম হৈচৈ হয়নি। স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে বারে বারে ব্যবসাটি বন্ধ করার কথা উঠেছে। কিন্তু বিপুল জনমত সবসময় ফিশ অ্যান্ড চিপসের পক্ষে। তাছাড়া এর সঙ্গে অসংখ্য মানুষের জীবিকা জড়িত। আইন করে খবরের কাগজের মোড়ক বর্জন করা হয়েছে, বদলে ব্যবহার করা হয় গ্রিজ মুক্ত কাগজ। কিছু গবেষণা, চিকিৎসকের মতামত ফিশ অ্যান্ড চিপ্স-এর পুষ্টিগুণের ব্যাখ্যা করে। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে দোকানের আঁশটে গন্ধ, ধোঁয়া দূর করার ব্যবস্থা হয়েছে। টিকে গেছে মাছ আলু ভাজার যুগলবন্দী। এখনও দশ হাজারেরও বেশি ফিশ অ্যান্ড চিপস এর দোকান এ দেশে, ৪০ কোটি ডিশ বিক্রি হয় প্রতি বছর। তবে বিপদ পিছু ছাড়ে নি। ফিশ অ্যান্ড চিপসকে এখন লড়তে হচ্ছে টেকএওয়ে খাবারের অসংখ্য বিকল্প, সংখ্যায় কমতে থাকা কড, হ্যাডক মাছ, জলে প্লাস্টিক কণা খেয়ে ফেলা মাছ, ব্রেক্সিটের ঘোলা জলের সঙ্গে। সমস্যা যাই থাক, তেলতেলে আঙুল চেটে কুড়মুড়ে মাছ আর মুচমুচে আলু ভাজা খাবার বাসনা যতদিন ব্রিটিশদের রসনায় বাসা বেঁধে আছে, বিলেতে ততদিন ফিশ অ্যান্ড চিপস এর আসনটি রানির সিংহাসনের মতোই অনড়, অটল।
❤ Support Us