- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- জুন ১২, ২০২২
বন্ধ জগৎ পেখম মেলো

চিত্র: সুশান্ত চক্রবর্তী
উঠে এলো ভারী ট্রাকে পাড়ার মধ্যে উঁচু বাড়ি। ঢাকা পড়লো মেঘে মেঘে, তারারা
খুঁজে-নিলো বাড়ির গায়ে তাদের ওড়াউড়ির প্রস্তুতি। খুঁজে পেলো চাঁদ নিজেকে
রাখার একটি আকাশ । কালো থুতু ছিটকে পড়লো ওই বাড়ি থেকে। চিনতে পারি
নিশ্চিন্তে থুতুর ভাষা, গডফাদার শব্দটি ডিকশোনারিতে ইঁদুর কাটতে পারেনি
আপনাদের ভয়ে। আপনাদের থুতু চেটে বেঁচে আছে আমাদের প্রাণ, আপনাদের
বিরুদ্ধে যাবো এতোটা বোকাচোদা নই। গড় হয়ে প্রণাম জানাই নির্ভুল হাসিটি মুখে ধরে।
২
হাত ছাড়বেন না শ্রদ্ধেয় দাদারা, এতোদিন অহংকারী দাদাদের সঙ্গে বেশ ছিলাম।
দূর থেকে ওঁরা দেখতেন দূর দেশের বাঁকানো থাবা, কীভাবে বিঁধছে, ধারালো
হচ্ছে…বুঝতে পারতেন সবকিছু। স্বপ্ন আনতেন মুঠোয় ভরে, ছিটকে দিতেন তাঁদের দেশের
আধহাত বেরিয়ে থাকা জিভের মধ্যে। এখন আপনাদের সঙ্গে আছি,
আপনারা গ্রহণ করুন এই অধমের প্রণামের স্পর্শগুলি।
৩
ইস্পাতের মতন শক্ত করে দাও দয়াময় আমায়, ভালো মানুষের মতন নরম হয়ে
চাই না থাকতে। চড়ে বসতে চাই সবার মাথার ওপরে। ভারী গলায় বলবো, এসো
উড়ি, ধরি—নিচু মানুষকে , চাপ দিয়ে ছোট্ট করে দিই, ছাদে টাঙিয়ে রাখি শাড়ির
মতন, উড়ুক দুখি দেশটি ছাদের তারে। বাড়িটির কী নাম দেবে গো?
জানো না, নাকি মনে করতে পারো না, জানি বাজ পড়ছে ভাতের অন্ধ
থালায়। নামে কী এসে যায়! টানটান কালো ধারালো দড়িতে ঝুলছে আমাদের
স্বাধীনতা।
৪
ইতিহাস শব্দটি শুধু হারিয়ে দেয় আকাশের ভিতর জেগে থাকা ভারী টুকরো কথা।
কাকে খুঁজি, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সাহানি ওঁরা হেঁটে আসছেন দু’জনে
ইতিহাসের রাস্তা ধরে। কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন মস্ত একটা সময়কে।
সময় হারিয়ে যায়, তাকে যায় না পাওয়া খুঁজে। তবু পাতা উল্টে কারা ঘুমিয়ে থাকা
আকাশের ভিতর ঠিকানা অহরহ খুঁজছেন… পাখির সঙ্গে উড়িয়ে তাদের ডানা…
চাপা পড়ে আছে পরিত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাজছে কালো অন্ধ ঘন্টা, কারা ছুটে
যাচ্ছে অজস্র খালি পায়ে, ওই নিঃশব্দের শব্দে দেখা যায়-দায়িত্বের পুরনো
পাতার মধ্যে লণ্ঠনের মৃদু আলোয় কাঁপছে কারা? খাগের কলমে ঝুঁকে পড়ে ইতিহাস
লিখে যাচ্ছে, দুনিয়াভরা তাঁদের বিঁধে বিঁধে থেঁতো হয়ে যাওয়ার যতো সব সময়ের
অন্ধকারে ঘুমন্ত পৃথিবীর কথা।
৫
ধারের কাজ টুকরো করা। দু’পাশে দু’জনকে রাখো টুকরো করে। লাল রক্ত পড়ে
গড়িয়ে বাতাসে, সেটুকুও কালো হয়ে আসে। বাতাস কি রক্তে ঢুকে গোয়েন্দাগিরি
করছে? ফেলুদার মতন আদবকায়দায় চতুর্দিকে চোখ রেখে বুঝে নিতে চেষ্টা করে
দুটি টুকরোর মধ্যে ধার কীভাবে নেমে এলো? নীতি দুর্নীতি সব ধুলোর মধ্যে মিশে
যায় দমকা হাওয়ায়। দুটি টুকরোর মাঝখানে কে জেগে থাকে? তারাখণ্ড থেকে
লাফিয়ে নামেন আলোমাখা এক দাদা। তিনি শুধু টুকরো করেন আর গোপনে ধার
দিতে যান মাঝরাতে লোকচক্ষুর আড়ালে চকচকে সৌরজগতে রাখা গোপন
অস্ত্রগুলি।
৬
বিশ্বাসযোগ্যতা নেই এই লেখার। সে খুঁড়িয়ে চলে, সবকিছু কেমন গুলিয়ে দেয়,
নিরাপদ দূরত্বে থাকে, লেখাটি নামে না দুঃখের সঙ্গে ক্ষুধার্ত আঙুলে দুপুরের সাদা
ভাতে। এ এক সাবধানী লেখকের চমৎকার গোলকধাঁধার খেলা। বোকা রে, বুঝতে
পারিস না পৃথিবী ঘুরছে, ফ্ল্যাগের মতন চাঁদ তুলে দে ওই আকাশে, সবাই দেখুক সমবেত মানুষ ঘুমের ঘোরে মই চাইছে ওপরে ওঠার। আমার মূর্খ কলম কীভাবে
আটকাবে ধারালো মুখের ফণাতলা গোখরোকে? সে চায় বাড়ির ওপর বাড়ি, সুন্দরী
নারী, চায় আরো চায়, স্রোতের সঙ্গে মিশে তার উল্টোদিকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে খুব
দ্রুত চলে যেতে চায় অনেক ওপরে।
৭
পিছলে যাচ্ছে আলোটি, নৌকা বাঁধা নদীর কিনারে, উঠে আসছে রাত্রিরেখা। চাঁদ
ওড়ে বাতাসে, জ্যোৎস্না জলে ভেজে রজনী, গাইবে কে হাতপাখাটি নাড়িয়ে দু’জনের
মাঝখানে একটি গান। তলিয়ে যায় ছায়া, ডুবছে কি ওগো গানের বন্ধু দু’জনে একই সঙ্গে।
৮
অন্ধকারের মধ্যে চিনতে পারি না তোমায়, ডানাঅলা তুমি তলিয়ে যাও খাতার
মধ্যে, লেখাটি ভেঙে পড়ে ঘুমের মধ্যে, ছিটকে ওঠে প্রেম, কেউ সঙ্গী হয় না
তোমার। ইস্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় কে ফুড়ুৎ করে নীল চিঠি। তাতে লেখা তুমি ঘুড়ি
হয়ে যাও, উড়বো আমরা আকাশে অজস্র রঙে রঙে। আবহমান বাংলা বলছে প্রেম
তো গান হয়ে পড়ে আছে সবার কণ্ঠে। একতারাতে কে কতোটা গান ধরে, কে
কতোটা গান ফেলে দেয় পথের মাঝে । তার থেকে দু’টুকরো কুড়িয়ে রাখি আমার
বুকপকেটে । তাতে ঘাম লেগে থাকে, নোংরা গন্ধে ভেজে, ওই গানটি তোমার
দু’হাতে দিয়ে বলি আমি তোমার সঙ্গেই ছুটছি সমস্ত জীবন শ্রীমতী সুমনা বসু।
৯
বাড়ির পাশে প্রতিবেশি ঝগড়া ফেলে, রাগে বন্ধ জানলা খুলে যায়, অপমানে বাড়িটি
নড়ে, পুরনো বেড়াল সরু পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে দেখে ওই ভাঙাচোরা কথাগুলির
ওড়াউড়ি…শহর পালটায়, গলা অবধি দুঃখটি অশ্রু হয়ে ফেলে চোখের জল, মন
খারাপে কাঁপে দুঃখে পোড়া কষ্ট। খাঁ-খাঁ রাত্রি কোনো বন্ধু নেই তোমার? কেউ থাকে না তোমার সঙ্গে, তুমি কি আমার মতন একা। শুধু উঁচু ডালে চাঁদ লেগে থাকে। পিছনে দেখি ঝাপসা চোখের বেড়ালটি নীরব চোখে বলে, হূদয়ভাঙা মানুষের কাছে তুই কি চাস আলোর সন্ধান, গভীর আদর যত্ন।
১০
নেমেছি তোমার কাছে, নৌকার মধ্যে ভেসে চলে একলা সুমনা বসু, বলি : দাঁড়াও
ওদিকে যেও না, রঙিন গোলাপের আশ্চর্য গন্ধ নাও, থামাও পুরনো বিবাদ, বুকের
ওপর লাফিয়ে ওঠে চাঁদ, তাকে বলি, ‘এই তুই কে রে?’ সে বলে আমি সুমনার
পথের সঙ্গী, আমি তো আলো, মুখের ফোঁটা ফোঁটা সবুজ উষ্ণ ঘাম। আমি বিশ্বাস
করি না এই হারামজাদা তোকে, তুই তো সাংঘাতিক মাল তা পাড়া প্রতিবেশি সবাই
জানে, কতোজনকে যে ভাগিয়ে নিয়ে পালিয়েছিস, তারপর দু’চোখে বেঁধেছিস
আলো দিয়ে গোপন বুকে, গিলেছিস গোগ্রাসে। অচেনা গোয়েন্দার মতো প্রদক্ষিণ
করছিস নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে। সে হাসে…বলে আমি প্রস্তুর যুগের জ্যোৎস্না,
নারীকে রেখেছি নির্জন পাহারায়, পাথর থেকে পথটি দেখিয়ে বলেছি আঙুল তুলে,
ওই তো তোমাদের নির্জন রঙের বাড়ি।
জানো রাজকুমার কে? ওকে দেবো ধবধবে একটি সাদা ঘোড়া, দেবো দু’টি ডানা,
দেবো ঘুমের মধ্যে অনেক স্বপ্ন, ও হবে ইতিহাসযানা, খুঁজবে পথে পথে গলির বাঁকে
লেন-বাইলেনে ফেলে আসা অজস্র নির্জন পায়ের মধ্যে পায়ের ছাপ।
১১
ও আগুন এ লেখা ছাই করে দাও, এ আমার রক্তবীজ। কোন গহ্বরে ছিল কে
জানে! নাকি সমাজ থেকে উঠে এসেছে মধ্যরাত্রির সঙ্গে টেবিলের ওপরে
একা। আমি তো টুকেছি সেই সব কথা, কোমল পাহারায় রেখেছি কতো কী ধরে।
তবুও কেটেছে রাত ক্ষতের মুখে জেগে ওঠা ভাঙা অক্ষরে। লেখা তো হৃদপিণ্ডকে
রক্ত মাখায়। পিঠের ওপর খাদ্য নিয়ে নামায় ক্ষুধার্তের দেশে। দানা মাঝির পায়ে
লাগিয়ে দেয়না দু’টি চাকা, দেয়না মুছে দু’হাতে দুপুর দু’টোর সূর্যকে, অভাবে কাঁপছে
এই দেশ প্রকাশ্যে ও নীরবে।শুধু তার মধ্যে তারাগুচ্ছের সঙ্গে বর্ণনা করি শ্রীরাধার। আমিও কি কম হারামি? এ লেখার মুখে থুতু ফেলো, তুমি তো স্মরণ অতীত। ছিঃ ছিঃ। থুতুতে প্রতিটা অক্ষর
মুছে যাক। ক্ষুধার কাছে যাও এ লেখা ভাত হয়ে। একাকী হেঁটে যাওয়া মেয়েটির
সঙ্গে সাহস হয়ে। ইঁদুর হয়ে ঢুকে পড়ো সুইস ব্যাঙ্কের গোপন ব্যাগে, কালো টাকা
টুকরো করো, আলোয় ভরো এ দেশ। আমার লেখা লাট খাক ড্রেনের জলে, আগুন
লাগুক সমস্ত গ্রন্থের পাতায়, ভাত ফুটুক ফুলের বদলে, ঘরে ঘরে লেখা হোক শুভ সকাল।♦—♦
❤ Support Us