Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • মে ৮, ২০২২

কবি কণ্ঠে বাঙালির হাহাকার

'বসন্ত' গীতিনাট্য বইটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন।পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে কারাগারে বইটি নজরুলের কাছে পৌঁছে দেন।অনেক রবীন্দ্রভক্ত বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি

বন্দনা মুখার্জী
কবি কণ্ঠে বাঙালির হাহাকার

চিত্র: সুব্রত ঘোষ

বেশ কিছু বিদগ্ধ জনের কথায় শুনেছি রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুলকে পছন্দ করতেন না। এই ধারণা ভুল।প্রায় ৩৮ বছরের ছোট নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ শুধু স্নেহই করতেন না, তাঁর সৃষ্টির গুণগ্রাহীও ছিলেন। একবার শান্তিনিকেতনে গুরুদেব বসে আছেন সেখানে হঠাৎ নজরুল উপস্থিত । কিন্তু স্বভাব বিরুদ্ধভাবে কবির পাশে তিনি মাথা নীচু করে বসে রইলেন। উদ্দাম উচ্ছল নজরুলকে ওইভাবে দেখে কবি সস্নেহে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। এবার নজরুল কান্নামিশ্রিত গলায় বললেন ‘বুলবুলকে (নজরুল ও প্রমীলা দেবীর পুত্র, বয়স মাত্র ৪ বছর) ধরে রাখতে পারলাম না। বসন্ত রোগের কারণে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’ ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথও সন্তান হারানোর শোক পেয়েছেন। এই সংবাদে গভীর শোক পেলেন, এবং দুই কবি দীর্ঘসময় নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলেন। এক সময় দুজনে শোক ভাগ করে নিলেন আর নিজেদের সৃষ্টির মাধ্যমে বহুদিন নজরুল বুলবুলকে বাঁচিয়ে রাখলেন।

‘ধূমকেতু’ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপাত্র। প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আশীর্বানী-সহ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়াষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। রবীন্দ্রনাথের আশার্বাদ সত্য হয়েছিল। নজরুল যথার্থ আঁধারে অগ্নিসেতু বেঁধেছিলেন। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর নজরুলের প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী’ বাজেয়াপ্ত হয় এবং ওই দিনই কুমিল্লাতে নজরুলকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয় বিচারাধীন বন্দি হিসেবে। বিচারে তাঁর এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য বইটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এই প্রথম ঠাকুর পরিবার বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরে কাউকে বই উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথ। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে কারাগারে বইটি নজরুলের কাছে পৌঁছে দেন। বিষয়টি অনেক রবীন্দ্রভক্ত মেনে নিতে পারেননি। নানা গুঞ্জন শুনে, কবি নিজেই একদিন সকলের কাছে বললেন, ‘নজরুলকে কবি বলে সম্বোধন করেছি এবং বসন্ত বইটি উৎসর্গ করেছি সেটা তোমরা পছন্দ করনি। আমার বিশ্বাস তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই অভিমত প্রকাশ করেছো আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি। অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।’ এই বই পড়ে নজরুলও অভিভূত।বিশেষত রবীন্দ্রনাথ মৌখিক ভাবে বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘ও যেন কবিতা লেখা কোনোক্রমেই বন্ধ না করে, সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু সৈনিকদের প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’ আর নজরুল কবির আশীর্বাদ মাথা পেতে নিয়ে তাঁর অনুপম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ রচনা করেন। আরো বহুবার রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছিলেন নজরুল, পেয়েছিলেন উৎসাহ উদ্দীপনা আর আন্তরিক ভালোবাসা।

১৯৪১ সালের ৮ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের দেহবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে নজরুল তাৎক্ষণিক রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শান্ত রবিরে’ শোক সঙ্গীত, শেষোক্ত গানটি নজরুল কয়েকজন সহশিল্পীকে নিয়ে স্বকণ্ঠে গেয়েছিলেন। রেকর্ডে ও বেতারে। আর ‘রবিহারা’ কবিতাটি নজরুল স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের বছর খানেকের মধ্যে নজরুলও অসুস্থ হয়ে পরেন আর মাত্র দুবছরের মধ্যেই নীরব কবিতে পরিণত হন। চল্লিশের দশকে প্রথমার্ধে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক সংঘাত ও সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার প্রেক্ষাপটে বাংলার দুই মহান কবি একে একে বাঙালি জাতির কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ছোটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। কোন সাল মনে নেই তবে তখন বোধহয় আমি ক্লাস টু-এর ছাত্রী। সেইবারেই প্রথম নজরুলের জন্মদিনে তাঁর মধ্য কলকাতার বাসভবনের দ্বার সকাল থেকেই খোলা রাখা হয়েছিল, যাতে আম জনতা কবিকে সামনে থেকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে। আমাকে আর আমার দেড় বছরের দাদাকে নিয়ে আমাদের এক আত্মীয় সকাল সকাল কবির বাড়িতে হাজির। কবিপুত্র সব্যসাচী সকলকে এক দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করছেন। দেখলাম সাদা একটি ফরাসের ওপর কবি বসে আছেন। পাশে কারা যেন কবিরই লেখা গান গাইছেন। আমরা তাঁর পায়ের কাছে ফুল রেখে প্রণাম করতে গেলাম। কবিপুত্র শিখিয়ে দিলেন কীভাবে শুধু নমস্কার করব। তখন বুঝিনি কী সৌভাগ্যের অধিকারিণী হলাম। বাড়ি এসে সারাদিন মায়ের কাছে কবির কথা শুনলাম। সন্ধেবেলায় বাবার সঙ্গে মা আর আমরা সবাই আবার গেলাম । কবিপুত্র অনিরুদ্ধের সঙ্গে বাবার ব্যক্তগত পরিচয় ছিল। যাইহোক এবার শ্রদ্ধাভরে কবিকে নমস্কার জানিয়ে বাড়ি এলাম। তখন মিডিয়ার এত দৌরত্ম্য ছিল না, মনে আছে সন্ধেবেলায় কবি দর্শনার্থীদের বিশাল লাইন হয়েছিল । পরবর্তীকালে কবির গলায় রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে গান ও কবিতার রেকর্ড সংগ্রহ করি। রেকর্ডের উল্টোপিঠে কবিপুত্র সব্যসাচীর স্বকণ্ঠে আবৃত্তি ছিল। কতবার যে সে রেকর্ড শুনেছি আর কেঁপে উঠেছি। অশ্রুসিক্ত গলায় কবি গাইছেন, ‘বাঙালিছাড়া কী হারালো বাঙালি, কেহ বুঝিবে না আর/ বাঙলা ছাড়া এ পৃথিবীতে এত উঠবে না হাহাকার।’ এতো শুধু রবীন্দ্রনাথের জন্য নয়, রবীন্দ্র-নজরুলের জন্য বাঙালির হাহাকার।

♦–♦


❤ Support Us
error: Content is protected !!