Advertisement
  • ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
  • জুন ১১, ২০২৩

গুচ্ছ কবিতা

একরাম আলি
গুচ্ছ কবিতা

চিত্র: অঁরি এমিল ব্যনোয়া মাতিস

 

কী কী বলা হয়েছে, জানি না

 
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে, কবি একরাম আলি-র বিচরণ নিঃশব্দ প্রেমের মতো, কখনো বা পল্লবিত ছায়ার মতো নৈঃশব্দ্যের নিকটস্থ। তাঁর কবিতাযাপনের বয়স প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই, এর মানে, কবিতার সঙ্গে একরামের সখ্যতা নাতিদীর্ঘ নয়, স্বল্পাঙ্গীও নয়, অর্থবহ এবং স্থায়ী স্রোতের মতো সচল, সর্বদা। তাঁর বহুমাত্রিক উচ্চারণ বিস্মিত, মুগ্ধ করে দেয় সচেতন পাঠককে, উদ্বুদ্ধ করে প্রজন্মের কবিদের। তবু, তাঁকে নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তার অবকাশ কোথায়, আমরা অনেকেই স্তাবকতায় বিশ্বাসী, তথাকথিত স্বঘোষিত আচার্যদের সঙ্গ ছুঁতে ব্যতিব্যস্ত। কাউকে বানিয়ে তুলছি, কাউকে অকারণে অস্বীকার করে যাচ্ছি।
এরকম পরিস্থিতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানে মধ্যমেধা গণ্যমান্য হয়ে ওঠে। জয় গোস্বামী এক্ষেত্রে অবশ্যই এক উজ্জ্বল, উজ্জ্বলতর ব্যতিক্রম। একরামও সমগোত্রীয় লেখক প্রতিভা। বহুপ্রজ নন, সুশিক্ষিত, স্বনির্মিত।
বীরভূমের গ্রাম ছুঁয়ে সত্তরের দশকের শুরুতে একরামের উত্তরণ শুরু, ক্রমশ যা গ্রামীণ শুদ্ধতা আর তীক্ষ্ণ নাগরিকতা বোধে জারিত হয়ে, কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস, আমিত্বহীন আত্মকথন আর প্রবন্ধে বিস্তৃত হতে থাকে। কালক্রমে, তাঁর কবিসত্ত্বা ( পোয়েটিক পার্সোনালিটি) ছাড়িয়ে যায় ব্যক্তিস্বভাবের আত্মমগ্ন আমিকে।
বলতে হবে, ভাবতেও হবে, একরাম প্রধানত কবি। এরকম বলাটা খানিকটা ভাসা ভাসা, দায়সারা, যদি তাঁর হয়ে-ওঠা, তাঁর কবিতার নির্মাণ ও ব্যক্তিপ্রতিভার প্রেম-ছোঁওয়া ঐতিহ্য নিয়ে আরোপিত স্তব্ধতা ভাঙতে না পারি। কবিতা নয় শুধু, তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা কি পূর্ণ মনোনিবেশ দাবি করে না ? প্রকারান্তরে বলে না, খণ্ডিত চোখ দিয়ে আমাকে দেখো না, দেখবার চেষ্টা করো অন্য চোখে, ভিন্নতর সংকেতে।
গ্রামের ছায়াচ্ছন্ন, অন্তর্মুখী, সংযত ভাবাবেগের পাশাপাশি– অর্জিত নাগরিকতার ভাঙনমুখর, ছিন্নমূল অভিজ্ঞতার সান্নিধ্য ছাড়াও একরামকে তৈরি করেছে তাঁর রাবীন্দ্রিকতা আর নিরবচ্ছিন্ন শঙ্খ মগ্নতা। এখানেই একরাম সত্তর দশকের পরের বাংলা কবিতার নির্মাণ আর বিষয় ভাবনার স্বতন্ত্র, নিঃসঙ্গ কারিগর।
এরকম দায়বদ্ধ নিঃসঙ্গতা সচরাচর দেখা যায় না, যা আধুনিক বাংলা কবিতায় অনন্য, রোম্যাণ্টিকতায় ঋদ্ধ এবং দাঢ্য। তুলতুলে বা অষ্পষ্ট নয়, সেরা রোম্যান্টিকদের মতো নব্য ধ্রুপদী ঘরানাকে কখনো গ্রহণ করে, কখনো বর্জনের মহিমা ছড়াতে ছড়াতে ক্রমাগত রূপান্তরিত চেহারায় সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার স্বশাসিত কবিকণ্ঠ হয়ে ওঠেন একরাম। তাঁর ব্যক্তি প্রতিভায় যে ছায়াবৃত, রহস্যময়তা [সুফি চেতনা] খেলা করে, তা সহজিয়া চটুল তত্ত্ব কিংবা ফাঁপা নাগরিক কৌশল নয়, বিশুদ্ধ, সূক্ষ্ম বিভূতিরই সচেতন আত্মপ্রকাশ। সমালোচনা কখনো সাহিত্য কর্ম নয়, একধরনের দৃষ্টিপাত, এ নিয়ে কী কী বলা হয়েছে, আমরা খানিকটা জানি, কিংবা কী কথা বলে গেছেন নিখুঁত পাঠক আর সমগোত্রীয় কবি ও লেখকরা, তা আমাদের বইচর্যা আর অভিজ্ঞতা থেকে বিলকুল দূরস্থিত নয়।
 
বাহার উদ্দিন

১১.৬.২০২৩
 
 
তার গল্প

 

এক
 
যখন হাঁটি
হাওয়ার ঢেউ এসে শরীরে মিশে যায়
একটা ভঙ্গি
আমাদের নয়, তবু আমাদেরই
 
কখনো রাস্তা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ি
কখনো যাই রাস্তা ছাড়িয়ে
রাস্তা হারাই এবং স্খলিত রাস্তার ছেঁড়া সুতো বেয়ে হাঁটি
 
 
দুই
 
সে জন্মায়নি
যদিও তার জন্য একটা ঘর তৈরি হয়েছিল
সমভুমি থেকে সন্ধ্যার দিকে নিম্নমুখী
দরজা, গবাক্ষ, জল নির্গমনের নালা
 
কোনোদিনই অতর্কিতে ঝনঝন শব্দে
সে ঝাঁপ দেবে না
 
তবু তারই জন্যে একটা গল্প আছে
একদিন আমি বলতে শুরু করব, তুমি বিশ্বাস করবে
এবং শুনে যাবে
 
 
তিন
 
অলৌকিকতার কিছুই জানি না
জানি, কী বিষয়ে আমরা কথা বলেছি
তবে, কী-কী বলা হয়নি, জানি না
 
অন্ধকারে মৃতদেহ জ্বলছে
কেউ দেখতে পায় না কতটা লাল
আর ধারালো চোখ
আমার মাথা জাহান্নামে
জ্বলছে উজ্জ্বল পচা আলোর মতো
 
শেষ হয়েও হয়তো একগুঁয়েমির জোরে দাঁড়ানো যেত
কিন্তু চারদিকে রক্তবর্ণ লালসা গরগর করছে
 
 
চার
 
রাতে তার শরীর থেকে
ঝনঝন শব্দ আসে
 
নরকের চাবির সঙ্গে জান্নাতের চাবির সঙ্ঘর্ষ
অসংখ্য মৃত্যুর সঙ্গে অগণিত প্রাণের
 
ঝনঝন ঝনঝন ঝনঝন
 
জাহাজ ছেড়ে গেল
তার শরীরের ভেতর ভেসে গেল
ঢেউ খেলানো আওয়াজ
 
ভালোবাসার শরীর! তুমি কি
এখনো পাশে শুয়ে আছ?
 
 
পাঁচ
 
কথারা অনেক
সামনের মাঠে তারা ছুটে বেড়ায়
শব্দগুলো একেকটা কচি কুকুরছানা
 
সে কি ভয় পেয়েছে?
 
আকাশ নয়, সমুদ্র নয়
নির্বোধ কুকুরছানা
তারা এগিয়ে, পিছিয়ে, লাফ দিয়ে
বিভ্রান্ত করে
 
সে কি খুশি নয়?
শিখুক। কেন-না
খুশি হওয়ারও দরকার আছে
 
 
ছয়
 
আকাশের মাটি-ঘেঁষা বৃত্ত, ধোঁয়া, ছাই
নরম, বেষ্টিত নীল দিগন্তরেখায়
 
তবু হয়তো সবচেয়ে আগে মরবে পোষা শুকতারা
কেন-না ততটা গাঢ় তারা সে তো নয়— গ্রহ
 
চারদিকে গড়ে উঠছে নতুন নতুন সব পাড়া
তুমি কবে মরবে? আমি? খুঁটে-খুঁটে দেখি অহরহ।
 
 

♣♦♣


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!