- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে।পর্ব ৩
চিত্রকর্ম: মকবুল ফিদা হোসেন, মাধ্যম: কাগজে প্যাস্টেল
ভুবনবঙ্গের ৫২ জন কবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের লেখার মুহূর্ত, তখনকার ঘোর আর চেতন বা অবচেতনের বিষয় আশয় নিয়ে বলবার জন্য। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে কিছু প্রশ্ন, আড়ালের কোন আত্ম লিখতে বসায়, ক্রমশ মনোবাসী করে তোলে কে এই অধরা ? নিয়ে যায় অন্যরকম বনবাসে কিংবা জনবৃত্তের কোলাহলে? কী তার পরিচয়? অদৃশ্য অস্তিত্ব ?
আমাদের আমন্ত্রণে, সাড়ম্বর উৎসাহে সাড়া দিয়েছেন প্রিয় কবিরা । আমরা বিনম্র, আমরা কৃতজ্ঞ।
জন্মের প্রাক্কালে আমি এবং আমার কবিতা
কবিতা লেখার প্রাক মুহূর্তে ঘুরে ফিরে দুটো পর্যায় আসে। একটা পর্যায়ে কিছুতেই কবিতা আসে না। আসেই না। তখন বড্ড অস্থির লাগে। মনে হয়, আর কি কবিতা লিখতে পারব ? কবিতার সত্য আর শর্ত কি আমাকে ত্যাগ করে চলে গেল ? সে সময়টা বড় অশান্ত। সারাক্ষণই তেতেই থাকি। পান থেকে চুন খসলেই সবার ওপর বিরক্তি। যেন অন্য সব কিছুই উটকো উত্পাত, এসব কারণেই কবিতা হচ্ছে না। কিন্তু এ পর্যায় ধীরে ধীরে কেটে যায়। সব আশঙ্কা সরিয়ে দিয়ে সে আবার আবির্ভূত হয়। এ এক আনন্দের মুহূর্ত, দুর্দান্ত সুখের সময়। তখন ভেতরে বাইরে আমি শান্ত, স্থির। মনেই হয় না, এ কবিতা কোথায় ছাপা হবে, কে পড়বে ?
রাজনীতি আমার বিষয় নয়, তবু কখনো কখনো নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবার জন্য প্রয়োজনে বন্ধুদের ডাকে বা আদর্শ রক্ষায় ভেবেচিন্তে কবিতা নির্মাণ করেছি। সেরকম কিছু কবিতা ছাড়া সবই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভেতর থেকে নির্মিত হয়েই বাইরে বেরিয়ে আসে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু কবিতা নিজের কবিতা বলে চিনতে পারি না। প্রত্যেকের নিজের মধ্যে অনেকগুলো আমি থাকে। কিছু কবিতা স্বপ্ন দেখে লেখা। ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতরে কে যেন সুন্দর লাইন,শব্দ আওড়ে গেল। আগে ঘুম ভেঙে গেল ভাবতাম, এখন মনে মনে মুখস্থ করে নিই, কাল সকালে লিখব। কিন্তু দেখি, পরের দিন সেই কথাগুলো কিছুতেই মনে পড়ে না। আজকাল সঙ্গে সঙ্গে মাথার কাছে রাখা নোট প্যাডে লিখে নিই। একেবারে যেভাবে এল, সেভাবেই তত্ক্ষনাৎ উগড়ে দিই। সন্তান যেমন আপন স্বভাব নিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রনের বাইরে জন্ম নেয়। জন্মের পর মা তাকে নিজের মনের মতো আস্তে আস্তে তৈরি করে, সেরকম কবিতাটা স্বরূপ আবির্ভূত হবার পর কিছুদিন ফেলে রেখে ঘষামাজা,শব্দ বদল ইত্যাদি পুনর্নির্মাণের ধাপগুলো পেরোতে থাকে।
প্রসঙ্গত আরেকটি কথা, কবিতার মিল ব্যাপারটা আমাকে তীব্র আকর্ষণ করে। নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, স্বেচ্ছায় কিছুই করতে পারি না। কবিতা মিলের হবে কি না, কোথায় মিল থাকবে, এটা আমি স্থির করি না। যা যেভাবে হবার, সেটাই হয়, সেভাবেই জন্মায়। পাঠক হিসেবে নিয়মনিষ্ঠ ছন্দ মেপে লেখা প্রচুর কবিতা আমার পছন্দের তালিকাভুক্ত। আবার অনেক ভাঙচুরের কবিতাও প্রিয়। ভুল ছন্দের কবিতা অথবা ছন্দ-অশিক্ষিত কবির ছন্দে লেখা কবিতা অসহ্য লাগে। কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, কে ছন্দ জেনে ইচ্ছে করে ভেঙেছে আর কার ছন্দজ্ঞান নেই বলে ভুল লিখেছে। কবি হিসেবেও নিয়ম মানা ছন্দের কবিতা প্রচুর লিখেছি গত আঠাশ বছর জুড়ে। আবার ভাঙচুরও করেছি। আশাকরি যে স্বল্পসংখ্যক পাঠক আমার কবিতা ধারাবাহিক ভাবে পড়েছেন, তারা লক্ষ্য করেছেন।
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
এই আয়োজন
দেখবার জন্যই এত ছলছুতো খোঁজা
দেখব বলেই এই ফিরে ফিরে আসা
পঞ্চাশোর্ধ্ব এই দেহে কী বা আর আছে
শুধু এই ক্ষণিকের দেখার প্রত্যাশা ।
তাতক্ষণিক ভুল নাকি ক্ষণিকের ফুল
পায়নি হদিস কোনো ভ্রমরের ডানা
হিসেবির চোখে স্রেফ আবেগের ভ্রম
লোকমান্য অঞ্জলিতে স্থান পেতে মানা ।
নিয়ম বিধির ফাঁসে গিঁট পড়া দড়ি
শাসন করেছে সব সম্পর্কের সুতো
দূরে সরে যাই তবু ফিরি বারবার
দেখব বলেই রোজ খুঁজি ছলছুতো ।
মহাজাগতিক
ওপড়ানো বেদি ছেড়ে
আলো নেবানো নক্ষত্র
চলতে চায় মাটির পথে ।
তার দু’চোখে ঘাম ।
বর্ষীয়ানের ফিসফিসে স্বর
” এই অন্ধকারে কে?”
অমনি বেজে ওঠে
প্রাকৃত নি:শ্বাসের গন্ধ ।
এই কালোকোলো কয়লার দেশে
খাঁজে খোঁজরে কিছু তো হীরে ছিল !
এতদিন খবর রাখোনি।
আজ কেন তবে পাতালপ্রবেশ ?
আলোহারা নক্ষত্র তবে
হীরার কাছে ধার নেবে?
কাটিং পালিশ ঠিকঠাক করে
দেখা যাক কত টাকা সেন্ট দরে
মহাকাশের নক্ষত্র পৃথিবীতে বিকোয় ।
পাগলা হাতি
সকলে বলছে, সাবধান—
দলছুট খ্যাপা হাতি ভয়ংকর ।
দল তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে ।
দল? নাকি নিজের তরুণ সন্তান?
কবে এত বড় হল সে শাবক!
কত বিপদ থেকে আগলে আগলে
মা তাকে শুঁড়ে জড়িয়ে বড় করল ।
এটাই নিয়ম এই হাতি সঙ্গে
পুরুষ হাতিকে হারিয়ে
যূথপতিকে হঠিয়ে
আসে নতুন নেতা ।
এতদিন যে দলপতি পথ দেখাত,
বিপদ সঙ্কেত দিত অথবা আশ্বাস,
আজ সে নিজেই পরিত্যক্ত ।
খানিক এলোমেলো দাপাদাপি শেষে
হাতি ছটফট করে জলাভূমির কোলে,
তারপর হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে
চাঁদের দিকে শুঁড় উঁচিয়ে
স্যালুট ঠোকে কোন অদৃশ্য জ্যোতির্ময়কে!
মাথা ভার ভার লাগে
মাথা নামিয়ে আনে মাটির বুকে ।
জলাভূমি থেকে তখন বাষ্প উঠছিল
পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাস ।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us