- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে। পর্ব ১০
চিত্রকর্ম: সমীর কুন্ডু
প্রজিতের বিশ্বাস ও প্রত্যয়আমাদের জিজ্ঞাসার লিখিত উত্তর দিয়েছেন প্রজিত জানা, এই সময়ের অলকেশ কবি, মননে, প্রকরণে যিনি সংশয়হীন, দূঢ় প্রত্যয়ী।উপরিতলের কবিয়ালিতে থেমে থাকে না তাঁর ভাবনাচিন্তা, নীরক্ত মেধাহীন নয় তাঁর চর্চা আর চর্যা।
সম্পাদক। ৪/২/২০২৪
দরজা বন্ধ নয়, কোনও দিন ছিল না
♦ কবিতার মুহূর্তে কি খুব অস্থির হয়ে ওঠেন ?
কবিতার মুহূর্ত নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় বলে আমার মনে হয় না। কবিতা তো নিছক সাদা পাতার গায়ে লেখা হয় না, তা অনেকটাই গড়ে ওঠে ভিতরে ভিতরে। মগজে, শরীরে , স্নায়ু ও রক্ত সঞ্চালনে। একটি বিশেষ শব্দ, চিত্রকল্প, বা লাইন যখন সবে খুব অস্পষ্ট একটা অবয়ব পেতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু পায়নি, সেটাও তো কবিতার এক মুহূর্ত। কিন্তু ধরা যাক অবয়ব পাওয়ার আগেই ওই লাইন বা চিত্রকল্পটি হারিয়ে গেল, সে ভাবে ফিরে এলো না আর।
এমন অনেক লাইন বা চিত্রকল্প হারিয়ে যায় বারবার। যাওয়ার পর হয়তো এক আধটি থেকে যায় আর সেখান থেকেই শুরু হয় কবিতার বিস্তার ও প্রকৃত আলাপ। এক অর্থে এই প্রস্থানবিন্দুটিও কবিতার মুহূর্ত। তবে কবিতার কোনও একক প্রস্থানবিন্দু যেমন হয় না, তেমনই তার কোনও একক মুহূর্তও হয় না বলেই আমার ধারণা।
♦ ভেবেচিন্তে লেখেন, না স্বতঃস্ফূর্তভাবে ?
একটি অপরটির সাথে মিশে থাকে। স্বতস্ফূর্ততা ছাড়া কবিতা শুরুই হতে পারে না। কিন্তু নিছক স্বতস্ফূর্ততা যা ভাবনাচিন্তাশূন্য ও মেধাহীনতা উপরিতলের কবিয়ালীর স্তরেই আবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে কল্পনাপ্রতিভাহীন ও স্বতস্ফূর্ততাহীন নিছক বানানো কবিতাকে আড়ষ্ট ও নীরক্ত বলে মনে হয়। কবিতা এক অর্থে বাস্তবতার পুনর্নির্মাণ করে ও “বানানো” ঠিকই কিন্তু সেই ‘বানিয়ে তোলার’ ভিত্তিই হলো স্বতস্ফূর্ত কল্পনাপ্রতিভা। যা কবিতার শরীরে বা আঙ্গিকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।
একটা স্তরে কবিতা যখন প্রকৃতই জৈবিক (organic) তখন আসলে এসব স্বতস্ফূর্ততা, ভাবনাচিন্তা ইত্যাদির আর কোনও আলাদা অস্তিত্বই থাকেনা, একটি আর একটির অবশ্য হয়ে ওঠে।
♦ কখনো কি মনে হয়, কেউ আপনাকে ভেতর থেকে লিখিয়ে নেয়, এমন কোনো মনোবাসী ?
কবি তো শুধু কবিতা নয় নিজেও নিজেকে লেখেন। কবিতাও কখনো কখনো লেখে কবিকে।তার বাইরের অন্য কারো লিখিয়ে নেওয়ার কথা যারা বলেন তাঁরা এক হাস্যকর ছদ্মমহত্বের উপাসক। এইসব ভান করা চালাকির সাথে কবিতার কোনও সম্পর্ক নেই।
কবি কোনও বেদীর ওপর বসে থাকেন না। বানী দেওয়া তাঁর কাজ নয়। তাঁর মগ্নচৈতন্য ও ভিতরের সফর মানবজীবনের গভীরতম পাপের অংশ।
♦ একটানা লেখেন, না থেকে থেকে লিখতে হয় ?
ধরাবাঁধা কিছু নেই। কখনো একটানা, কখনো খন্ড খন্ড সময়ের ব্যবধানে লিখি। তবে যাই লিখি তা বারবার পাল্টাই। কদাচিৎ পাল্টাই না অবশ্য।
♦ লেখার আগে কি মনে মনে পংক্তি আওড়ান ?
না।
♦ অন্তমিল, মধ্যমিল কি কবিতায় ফেরাতে চান ?
ফেরানোর তো কিছু নেই। মিল কাঠামো( সেটা অন্তমিল হোক বা অন্য কিছু) বা rhyme scheme কোনও দিনই কবিতা থেকে উঠে যায়নি। যাবেও না। সনেটের নানান রূপগুলিই তো দাড়িয়ে আছে অন্তমিলের নানান বৈচিত্রের ওপর। পাশাপাশি গদ্য কবিতা বা মুক্তকও থাকবে। মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত বা অক্ষর বৃত্ত তো আছেই। তাছাড়া ছন্দবৈচিত্র ছাড়াও কবিতার পথ অসংখ্য। কোনওটারই দরজা বন্ধ নয়। ছিল না কোনো দিন।
♦ ছন্দের ওলট পালট বা ভাঙচুর কতটা পছন্দ ?
খুব পছন্দ। আমার নিজের লেখাতেই তা করেছি বারবার। তবে ছন্দ না জেনে বা একটু আধটু জেনে ( দ্বিতীয়টি আরও ভয়ঙ্কর) ভাঙচুর বিশেষ না করাটাই ভালো। ওতে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। ছন্দে গভীর অধিকার ও বুৎপত্তি ভাঙচুরের পথে যাওয়াটাকে আরো সার্থক করে তোলে।
এত যে পাথর, তবু …
আমরা কি ফিরতে চাই নি অলকেশ !
নিরেটের নাগপাশ থেকে ফের আমরা কি চাইনি বেরোতে !
যাব বলে কতবার রাস্তায় নেমেছি । অলকেশ তুমি জানো
তোমার কপালে আজো দংশনের দাগ লেগে আছে
তোমার কপালে আজও রক্তের দাগ লেগে আছে
আমি চিনি ওই দাগ । ওইসব ক্ষতমুখ চিনি
এত যে পাথর, তবু কোথাও রহস্য কিছু আজও রয়ে গেছে বলে মনে হয়
এত যে পাথর, তবু কোথাও রোমাঞ্চ কিছু আজও রয়ে গেছে বলে মনে হয়
তবুও দুচোখে কেন সংশয়ের মেঘ নামে.. অলকেশ
তবুও দুচোখে কেন অবিশ্বাসের মেঘ নেমে আসে বলো
অলকেশ । তবুও অলীক খুঁজি । আঁকড়ে ধরি অলীকের মেঘমালা, অদৃশ্য সরণি, বাতিঘর
দেখি করতোয়া স্বচ্ছ স্রোত পাথর ছাপিয়ে বয়ে যায়
নিথর যেন না বলে শেষ কথা
নিরেট যেন না তার শেষ লৌহ শলাকাটি আমাদের বুকে গেঁথে দিতে পারে ফের
মেঘের অক্ষরে তাই আজও লিখি অলীক যাপন
মেঘের অক্ষরে তাই আজও লিখি প্রলাপ কাহিনি ।
যাব বলে কতবার রাস্তায় নেমেছি । অলকেশ তুমি জানো
তবু পথ সরে গেলো । তবু যাওয়া হলো না এখনও….
শব্দভেদী
মুখ তো ঢাকে না। যেন মেলে দেয় আরো
সকল সৌন্দর্যচিহ্ন। সাথে বলিরেখা
সে মুখোশ পাই আজও শূন্যপুর হাটে
কাঁচের অধিক স্বচ্ছ। চোখে মরীচিকা ।
আলোকসংবেদী পর্দা স্নায়ুজাল আলো
রক্ত জমে অন্ধকারে রক্ত জমে চোখে
কিভাবে নির্গত করি বদরক্ত বলো
স্বপ্নহত্যা যেন আজ বুকে হাত রাখে
সুস্থ তবু সুস্থ নয় । দৃষ্টি রেখা স্থির
তবুও মুখোশই মুখ রচনা করেছে
অন্ধ মুনি খোঁজে কার শব্দভেদী তীর
সন্তানের ছিন্ন শির কোথায় রেখেছে।
ঘুম যারা কেড়েছিল তারা আজ মৃত
মুখেরা কবরে গেছে। মুখোশ জীবিত।
অলীক শয়নঘরে
তুমি কি স্বপ্নেও এমন কোনও
বিছানা চেয়েছিলে
যেখানে একবার শুলে
ওঠা যায় না আর !
এমন এক তোশক যা একবার
বিছোলেই মানুষ, দেওয়াল
দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকা
তৈলচিত্র নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যায় ।
এমন দরজা, যেখানে টোকা দিলেই
অদৃশ্য খড়খড়ি খুলে কে যেন
উঁকি মেরে ফের আবার
পাশ ফিরে শোয় ।
বোঝা যায় দরজা খোলার জন্য
আর কেউ উঠে আসবে না কখনও
এই সেই প্রবেশদ্বার
যা পেরোলেই মৃত্যুর অন্দরমহল
অনুমতি না নিয়ে
বাতাসেরও, এখানে প্রবেশ নিষেধ!
মৃত্যু নিজেই এখন অন্ধ ও নিরেট
অলীক তার দরজায়
টোকা দেয় । তবু তার
ওঠার ক্ষমতা নেই আর…
♦—♦—♦♦—♦—♦♦—♦—♦
❤ Support Us