Advertisement
  • ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ৩, ২০২৩

কবিতার মনোবাসীর খোঁজে।পর্ব ২

রফিক উল ইসলাম
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে।পর্ব ২

চিত্র- স্বাগতা বোস

ভুবনবঙ্গের ৫২ জন কবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের লেখার মুহূর্ত, তখনকার ঘোর আর চেতন বা অবচেতনের বিষয় আশয় নিয়ে বলবার জন্য। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে কিছু প্রশ্ন, আড়ালের কোন আত্ম লিখতে বসায়, ক্রমশ মনোবাসী করে তোলে কে এই অধরা ? নিয়ে যায় অন্যরকম বনবাসে কিংবা জনবৃত্তের কোলাহলে? কী তার পরিচয়? অদৃশ্য অস্তিত্ব ? একধরনের পাগলামি ?

আমাদের আমন্ত্রণে, সাড়ম্বর উৎসাহে সাড়া দিয়েছেন প্রিয় কবিরা । আমরা বিনম্র, আমরা কৃতজ্ঞ।

 

চিত্রকর্ম: দেব সরকার

 

অনুবাদ করে যাব নিজেকে

জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে এক অস্পষ্ট বর্ণময় রূপরেখা নিয়ত লালন করে আমাকে। আমার ভাষা জুগিয়ে দেয়। ফলে ‘মৃত্যু’ শব্দটির আভিধানিক তাৎপর্য নতুনতর সব সব মাত্রা নিয়ে জাগ্রত থাকে আমার জীবনে। কাব্যজীবন বর্ণনার সূচনায় তাই বারংবার এসে পড়ে ‘মৃত্যু’ নামক এক ঘোর পারপার-এর কথা। ওপার জানা নেই ঠিকঠাক। কোনো এক স্বপ্নময় ডানায় হঠাৎ সেই ওপারে চলকে ওঠা। যা উঠে আসে, সেইসব রং ছবি এপারের জন্যে প্রাণপণে কুড়িয়ে আনা। পথে ছড়িয়ে যায় বেশ কিছু। কিছুটা আবছা, আর কিছুটা ধরা পড়ে মাধুকরীর মতন। এসব কবিতা কিনা জানি না। এপার ওপারের মধ্যবর্তী সেই বর্ণময়তা… এপার থেকে নিজেকে মুছে ওপারের বাসিন্দা করে তোলা… আবার ওপারের ডুব থেকে এপারের ভূমিতে জেগে ওঠা— এমন সব বিচিত্র আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই বারংবার লিখে ফেলতে চাই। যদি কেউ কান পেতে শোনেন, তো ফিসফিস করে বলি।

আঁধার কালের অতীত কোনো বিন্দু থেকে জীবন শুরু করেছিলুম। তারপর কত জন্ম এবং জন্মান্তর। এক প্রাণ থেকে কোটি কোটি প্রাণের ভেতর উড়ে উড়ে চলা। এতসব ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেলি, তার সাধ্য কই! আমার তো সমাপ্তি নেই, অবকাশও নেই। শেষ গোধূলির পারে ফিরে যাওয়ার আগে আরো কত কত জন্ম পার হতে হবে! আর এই পৃথিবীর জীবন, এ যেন সামান্য জিরিয়ে নেওয়া। যেন এই জীবনে দাঁড়িয়ে পূর্বকালের জন্মগুলির হিসেব বুঝে নেওয়া। যেন এই জীবনে দাঁড়িয়ে আগামী জন্মগুলির বিস্তারিত ছক কষে ফেলা। আমার নিজের তো পাওয়ার কিছু নেই, হারাবারও নেই কিছু। নিঃসংশয় গভীর যাত্রাপথে একাকী নিঃশেষিত হতে থাকা, পূর্ণ হতে থাকা, উদ্ভাসিত হতে থাকা। এতসব বিচ্ছুরণের দাগ থেকে যদি কোনো মঙ্গল ঘটে যায়, সে জয় কবিতার, আর কিছু না।

হে পলকের মতন ক্ষণজীবন আর জীবনের যত ক্রোধ, লিপ্সা, অহংকার আর বাধ্যতা ক্ষমা করো আমাকে। মানুষ কীভাবে এমন অসহিষ্ণু হয়! আমি তার যথার্থ বুঝি না। এই-ই আমার মূর্খতা। আমার চিরন্তন প্রবাহমানতা থেকে অবনত শাখাটির কাছে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখি, কতখানি গান জমা হল। আমি কি অতখানি অবনত হতে পারি? আপন পাথরের স্তর দু-হাতে সরাই। ভেতরের লাভামুখ প্রাণপণে চেপে ধরে চিৎকার করি— আমাকে নির্ভার হতে দাও। এই-ই আমার সিদ্ধি। পৃথিবীর যতকিছু “না” আছে, একদিন সব ছুঁয়ে দিয়ে যাব। এই-ই আমার পথশ্রম। ঘর আর বাহির কে যে মহিমান্বিত, আমি তার হিসেব পাই না। আমার মাতা কিংবা প্রেয়সীরা কি বালুকণায় গড়া, আমি তার হিসেব পাই না। অসহিষ্ণু এই পারে শুধু অতলান্ত ঢেউ, আর দূরে জেগে থাকা বাতিস্তম্ভ। আমি এদের চিনি, আর শ্যাওলার মতন তীর ছুঁয়ে থাকা নুড়িদের ভেতর যতটুকু পারি তাৎপর্য লিখে যাই।

কোন সে অধীর বয়সে প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলুম, মনে পড়ে না। তারপর এই ঘোর অসংসার। এও যে ভালবাসা হয়ে যায়, কেমন করে বুঝবো! পরম যত্নে অসংসারও নির্বাহ করে কেউ, আমাকে প্রশ্রয় দেয়, সন্ততি লালন করে। আমি তার কাছে, তাঁদের কাছে আকণ্ঠ ঋণী হয়ে থাকি। মাথা ঝুঁকিয়ে আমার যাবতীয় দায়ভার বহনের মূর্ছনা পরখ করি। একদিন জেগে উঠেছিলুম জল থেকে, আবার বিলীন হব জলে। এর ভেতরেই লীলাচঞ্চল পলক তুলে দেখা। এ-দেখার শেষ নেই কোনো। পথের দুপাশে অন্যরকমের নারী, লতা, ফুল, পাখি আমার আত্মীয় হয়ে ওঠে। এটুকুই নিজের বলে বিবেচনা করি, আর সব মিথ্যে। এই গৃহ আর কথপোকথন, এই কান্না হাসি অভিমান, ব্যবহৃত জীবনপ্রণালী সবকিছু অকারণ মনে হয়, আর ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে থাকি। সমাজ ভেঙে পড়ে, বর্ণ ভেঙে পড়ে, ক্ষত্রিয়নাম ভেঙে পড়ে। গভীর রাতে একাকী বাড়ি ফেরার পথে স্পষ্ট অনুভব করি, সামনে অন্য কেউ হাঁটছেন। তিনি আমার পথের রক্ষী। খুব অচেনা গম্ভীর কোনো স্থানে ভীতু আমি পৌঁছানোর আগেই অন্য কেউ সেখানে পৌঁছে যান আমার আপ্যায়নে, ফলত ঠিকঠাক একা নই কখনও— এটুকুই আমার বিশ্বাস। এইসব মূর্খতা, সিদ্ধি, সম্পদ, বিশ্বাস আর পথশ্রমে আমার যা-কিছু আহরণ। তার যতটুকু পারি লিপিবদ্ধ করি, যা পারি না, সেসব আমার অক্ষমতা।

এই-ই আমার জীবন আর কাব্যজীবনকথা। ভ্রমের ভিতর, বুদবুদের ভিতর, স্বপ্নের ভিতর আমাদের ঘরবাড়ি, প্রজাবর্গ আর অরণ্যসকল। বারংবার ফিরে যাই তাদের কাছে। কতরকমের গল্পগাথা আর লুকোচুরি।  সেসব অনুবাদ করে আনি। প্রকৃতই আনতে পারি কি? আমি তো নুব্জ পথিক, মাটির অবাধ্য না। জীবনে জীবন যুক্ত করে যাব বিমূঢ় অন্ধ সমর্পণে। আর যতটা পারি অনুবাদ করে যাব নিজেকেই।

রফিক উল ইসলাম

রাঙাবেলিয়ার চর

কোথা থেকে কোথায় ঝাঁপ দেওয়া যায়? নৌকো থেকে
নদীতে, না নদী থেকে নৌকোয়?

এই যেমন নৌকোভর্তি মধু আর গরানের কাঠ ঝাঁপ দিয়েছে
আমার শরীরে! অবাক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক।
সঙ্গের বন্ধুটি ফুঁ দিচ্ছে উনুনে, তার কুণ্ডলীপাকানো ধোঁয়া
ভাসতে ভাসতে ঘিরে ধরছে রাঙাবেলিয়ার চর।

শরীরে কোথাও আর চর জেগে নেই, শুধুই
জোয়ার। আমি ছ’ঘেরির শ্রীমন্ত মৌলে, বাঘের গর্দানের ওপর
লাফ দিয়ে মধু পেড়ে আনি, তারপর হাটে হাটে ফেরি।
আমার ঘরেও আজ ঝাঁপ দিয়েছে সুন্দরবন, অচেনা মৌলে এসে
চুপিচুপি মধু খেয়ে যাচ্ছে।

কোথাও একটা ফিরতে তো হয়ই। কোথায়?
আধময়লা ধুতি আর ছেঁড়া গেঞ্জিটাও একসময়
ভার হয়ে যায়। বড় ভার! অবাক জ্যোৎস্নায়
বিস্তৃত জলরাশির ওপর ভেসে যায় নৌকোর জীবন।
হে বিস্তৃতজল তুমি ঝাঁপ দেবে কোথায়?

ছাই

বাড়াভাতে ছাই দিতে এলে!

ছাই আমাদের অষ্টোত্তর শতনাম, দিবারাত্র জপের মালা
কাঁধের ঝোলার ভেতর। ছাই জাগে ছাই ঘুমোয়,
তাদের উড়িয়ে ছড়িয়ে কত যে ঐশ্বর্য আমি তার
মর্ম বুঝি না। হঠাৎ দু-একটি জ্যোৎস্নারাত আর কিছু নির্জনতা
আড়ালে ডেকে নিয়ে কতকিছুই বলে দিয়ে যায়!

হিতকারী মেঘ ভেসে চলে, ছাই ওড়ে চতুর্দিক।
কত মাণিক্য ঝরে পড়ে। আমাদের গাঁ-গঞ্জের যত নাবালক কথা
কিশোর হয়ে ওঠে। ছাইঢাকা যে কোনো আঁচল এত কান্তিময়,
এত অপরূপলিপি গ্রথিত থাকে সেখানে, একটি দুটি
জ্যোৎস্নারাত আর কিছু নির্জনতা ইঙ্গিত দিয়ে যায়।
আমি তার মর্ম বুঝি না সবটুকু। শুধু ঝোলার ভেতর হাত,
হাতে নিমগ্ন জপমালার মতন ছাই, অষ্টোত্তর শতনাম,
যেখানে পারি যেভাবে পারি উড়িয়ে ছড়িয়ে দেখি!

গ্রিল

বারান্দায় স্থাপিত হওয়ার আগে নীল শিখা আর
গলিত ধাতুর বন্ধু ছিলুম আমি। ওরা দুজন, দুরন্ত দুপুর
আর নির্মম হাতুড়িরা কত যে শিল্পরূপ শিখিয়েছে,
ভাবতে ভাবতে স্তব্ধ হয়ে গেছি! এই স্তব্ধতা ভাঙার নয়
কখনো। সমুদ্র পেরিয়ে, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে
বাতাস ছুটতে ছুটতে আমাকে স্পর্শ করার আগে
পথ হারিয়ে ফেলে। উত্তাপ জমাট বেঁধে যায়।

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে তুমি এখন
বাথরুমে। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠবে: মা,
খেতে দাও। এরপর আধভেজা ব্রা, শায়া আর ছোট্ট হাতরুমালটি
মেলে দিতে দিতে অল্প একটুক্ষণ আমাকে ধরে
দাঁড়াবে। নানারঙের উত্তাপে ঝলমলে হয়ে আছে
শরীর। সেসব দিয়ে তোমাদের যাবতীয় জলছাপ মুছিয়ে দিতে দিতে
আমি কি কখনো আর ফেরার কথা
ভেবে উঠতে চেয়েছি ?

যাওয়া

দরজা, জানালা উন্মুক্ত করে দাও, যেন
সঠিক বেরিয়ে যেতে পারি। কুয়াশার নদী
আজ নিতে এসেছে দূরবর্তী পুষ্পের কাননে। তোমাদের অশ্রু,
ঘোর সংসারভূমি থেকে নিঃসৃত মায়ার প্রলাপ যেন তার
বিভ্রম না সাজায়।

অনন্ত খাটিয়া জুড়ে দীর্ঘকাল শুয়ে আছি। কার জানালা
কখন খুলে যায়, কার দরজা কখন তাকে সদর পর্যন্ত
এগিয়ে দিতে আসে, কে বলতে পারে! মানুষ
স্বপ্ন জানে, স্বপ্নের ও-পারে যে কুয়াশার নদী,
পুষ্পকানন আর অবিরাম খেলার পৃথিবী, তার খোঁজ
নিতে চাওয়া পরিব্রাজক আজ বুকের মাঝখানে এসে
থেমেছে। কীভাবে ফিরিয়ে দেব?

স্বপ্ন ভেঙে যায়, ভেঙে যায় একসময়। মানুষের কাঁধ
ক্রমশ ক্ষয়ে এলে, ক্রমশ কুঁজো হয়ে এলে
ফেরেশতারা কাঁধ দেবেন অনন্ত খাটিয়ায়!

♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!