- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে।পর্ব ৪
খোলা হাওয়ার কাছাকাছি যেতে পথ মাপামাপি করা যায়? যারা লিখছেন লিখুন ছন্দ মাত্রা মেপে মেপে।আর যারা জীবনছন্দে নিজেদের সমর্পণ করেছেন, তাঁদের কাঠি না করে কবিতায় থাকতে দিন !
চিত্র: ধীরাজ রায়চৌধুরী
ধ্যান আর ধারণায় কবিরা কি ভবঘুরে ? অগোছালো ? অস্থির ? প্রসন্ন স্থিরতায় ও কী তাঁদের ভাবনা ঢেউ তোলে অতলে ? দৃষ্টির বাইরে ? কবি ও কবিতার মনস্তত্ব নিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর আজও বেহদিস। গুরুগম্ভীর পন্ডিতেরা বহুকথা বলবেন, বলেছেন অনেকানেক একাডেমিক কথাবার্তা, ভবিষ্যতেও বলবেন। কবিরা কি বলতে চান, তা জানতে ইচ্ছে করে।
ফরাসি আর জার্মান কবিতার রোমান্টিকতা একসময় ‘গণতন্ত্রের প্ৰথম সন্তান’ রূপে আবির্ভূত হয়ে মুক্তভাবনার দরজায় ধুম লাগিয়ে দিয়েছিল। প্রাচ্যে ওই ভাবাবেগের ঘোর লাগে সুফি আর ছায়াবাদীদের অভিনব দৃষ্টিপাতে। রোমান্টিকদের অস্বীকার করে ভাব আর শৈলীর বিন্যাস সাজিয়ে আলঙ্কারিক অনুশাসন থেকে কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন মালার্মে বৃত্তকে বিত্তবান করে তুলেছিলেন তাঁর সমবেত প্রতিন্দ্বীরা, ইউরোপ সেলাম জানায় মালার্মেও ভ্যালেরিনকে।ওই তরঙ্গ বাংলা কবিতাকে স্পর্শ করে মধুসুদন দত্তের অমিত্রাক্ষরের নৃত্যে, পুরনো, বহুকথিত বিষয়ের নবায়নে। বিহারীলাল চক্রবর্তী থেকে রবীন্দ্রবলয় পর্যন্ত এরকম দুঃসাহস দেখা যায়নি কখনো, রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন দুরস্থিত রোমান্টিক হয়ে রইলেন। তাঁর ভাবনায়, দর্শনে পাগলামির অসংলগ্নতা নেই, আবার সৃষ্টির পাগলামিকে উড়িয়েও দেননি তিনি, বিশেষ করে নাটকে, গানে, বিশ্বের সেরা আর মহোত্তম রোমান্টিক কবির শিল্পবোধে । নজরুল ইসলামই সরাসরি প্ৰথম বেরিয়ে এলেন রবীন্দ্রবলয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে, তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় তাঁর আমি-র, দ্রোহ আর মুক্তক ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিকে অভিবাদন জানিয়ে। নজরুলের বিদ্রোহী বা অন্যান্য কবিতার সৃষ্টির মুহূর্ত অজানা রইল না, লিখে গেছেন অনেকেই । কিন্তু, গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে যারা—জীবনানন্দ, সুধীনন্দ্রনাথ দত্ত থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত প্রধানত বর্হিলোক আর অন্তরলোকের মধ্যে সংযোগ রচনা করলেন, তাঁদের সৃজনের মুহূর্ত নিয়ে সংলাপ বড্ড কম ।
প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের উদ্যোগে প্রকাশিত কেন লিখি ? একটি খুদে বই আমরা পড়েছি।দায়বদ্ধ কবিতার লক্ষ্য এখানে প্রধানত অবলম্বিত, কিন্তু কোনো দায় বা অনুশাসনের তোয়াক্কা করে না যে কবিতা, যা প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের প্রাথমিক শর্ত, অন্যকথায় সুভাষিত, শিল্পায়িত গণতন্ত্রের অন্যতম নিশানা, তার বিস্তৃত বিবরণ নজরে আসে না । মুদ্রিত ‘আরম্ভ‘ একসময় চিত্রকরদের ছবি আঁকার মুহূর্ত কিংবা তাঁদের অন্তর্জগতের রহস্য সন্ধান শুরু করেছিল । আমাদের আহবানে সানন্দে সাড়া দিয়েছিলেন হুসেন থেকে প্রকাশ কর্মকার, ধীরাজ চৌধুরী, রবীন মন্ডল, সুনীল দাস, বিপিন গোস্বামী, অনীতা রায় চৌধুরি ওয়াসিম কাপুরের মতো আরো অনেক কৃতি শিল্পীরা । তাঁদের সবার ইহজাগতিকতা এখন স্তম্ভিত, তবু কী অসীম শক্তির জোরে জেগে আছে ওই ভাবাবেগের স্রোত আর অনিঃশেষ জলরাশি।
কবিদের মনোলোকের সন্ধানেও সুনির্দিষ্ট, নির্বাচিত প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি বেরিয়ে পড়েছে ‘আরম্ভ‘। কেউই বিমুখ করেননি।কেউ কেউ প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছেন, কেউ বা একটি লেখায় জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের লেখার মুহূর্তের বা আগের মানসিক অবস্থান। আমরা বিনম্র, আমরা কৃতজ্ঞ।
বাহার উদ্দিন ।১৭.১২.২০২৩
কন্ঠ দিয়ে নয় শুধু, চোখ দিয়েও লাইন আওড়াই
- কবিতার মুহূর্তে কি খুব অস্থির হয়ে ওঠেন ?
এরকম প্রশ্নের উত্তরে এককথায় হ্যাঁ বলতেই পারি ! বলবও হয়ত হ্যাঁ ! তবু একথাও বলা জরুরি যে, সব কবিতার জন্মমুহূর্তের পরিস্থিতি একরকম থাকে না । যে ঘটনা তুমুল নাড়িয়ে দেয়, লেখার জন্য কবিতার সলতে দ্রুত উসকে দেয়, সেক্ষেত্রে অস্থিরতা উপচে ওঠে।আবার কখনও শান্ত আর মৌনতার মধ্যেও লেখা হয়ে যায়।
- ভেবেচিন্তে লেখেন,না স্বতঃস্ফূর্তভাবে ?
নাড়িয়ে দেওয়া মুহূর্ত নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রথমে বুক থেকে চলে যায় মস্তিস্কে। সেখানে লেখা নির্মিত হতে থাকে, ধীরে ধীরে শব্দরূপ ধারণ করে তা।সাধারণত, ভাবতে হয় প্রকরণ নিয়ে । কীভাবে লিখব ! খুব তাড়া না থাকলে লেখা কিছুদিন ফেলে রাখি । দ্বিতীয়বার লেখাটিকে নিয়ে বসি । আর পান্ডুলিপি করার সময় পুরোপুরি ঝাড়াইবাছাই করে নিই ।
- কখনো কি মনে হয়,কেউ আপনাকে ভেতর থেকে লিখিয়ে নেয়, এমন কোনো মনোবাসী ?
অবশ্যই মনে হয় । কেউ না কেউ তো লেখায় ! এমন অনেক হয়েছে যে, বিভিন্ন কাগজ থেকে কবিতা লেখার আমন্ত্রণ এসেছে । অপ্রকাশিত লেখা তেমন নেই, অথচ নতুন লেখাই দিতে হবে । গুছিয়ে লিখতে বসেছি, অথচ লেখা আসছে না, ইচ্ছে হলেও লিখতে পারছি না ! দ্বিতীয় কেউ তো আছেই যে লেখায়,আর সে অবধারিতভাবেই মনোবাসী ।
- একটানা লেখেন, না থেকে থেকে লিখতে হয় ?
বিষয়গুলো আপেক্ষিক । একেক জনের ক্ষেত্রে একেকরকম । গদ্যর ক্ষেত্রে একটানা লিখতে হয় । শুনেছি, এক সিটিয়ে অনেকে পরপর কবিতা লেখেন । আমার তেমন হয় না । প্রথমদিকে যখন লিখতে শুরু করি, তখন প্রচুর লিখতাম । কয়েকবছর হল কবিতা লেখা কমে গেছে । থেকে থেকে লেখা শেষ করি।
- লেখার আগে কি মনে মনে পংক্তি আওড়ান ?
কন্ঠ দিয়ে না হোক চোখ দিয়ে তো আওড়াতেই হয়, না হলে সাযুজ্য পাব কী করে ? বহমানতাকে আবহমানের দিকে নিয়ে যেতে হলে আগের পংক্তির রস ও রূপককে নিয়ে নদীর জল বয়ে যায়।
- অন্তমিল মধ্যমিল কি কবিতায় ফেরাতে চান ?
আমি মিল ফেরানোর বা না ফেরানোর কেউ নই । স্পষ্ট ভাষায়, মিলান্তি নিয়ে কিছু বলতে গেলেই পুরনোকে আঁকড়ে থাকা পন্ডিতপ্রবরেরা রে রে করে উঠবেন । চর্যাগানে অন্তমিল ছিল । আজও অন্তমিলে লিখেই বিখ্যাত হন মূলধারার কবি । কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা । কবিতা নিয়ে প্রচুর আন্দোলনও হয়েছে । কত জল গড়িয়ে গেছে কবিতা র ভাষার উপর দিয়ে । এ সত্য আমরা বুঝতেই চাই না ! আমার মনে হয়, মিল একটি বন্ধন।কবিতা মুক্তি চায়।কবিতার পথ অনন্তের দিকে।
- ছন্দের ওলট-পালট বা ভাঙচুর কতটা পছন্দ ?
সাহস করে বলেই ফেলি যে, ভাঙা আর গড়া একটি চলমান প্রক্রিয়া।গড়তে যে জানে না, সে ভাঙার দুঃসাহস দেখাবে না, তাকি হতে পারে ? পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, ছন্দে জগৎ চলে।এমনকি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে হৃদয়ের লাবডাব, রক্ত সঞ্চালনের শব্দ।রাতের পর দিন,তারপর রাত এই চলাতেও এক অপরূপ ছন্দের দোলা।আমরা নিজেরাও যখন কথা বলি,তখন তাতে বাক্যের মধ্যে নিজেদের অজান্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে আট-ছয় মাত্রা চলে আসে।আমাদের মজ্জায় ছন্দ লেগে আছে।কাজেই লেখার সময় আলাদাভাবে ছন্দ রাখবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।পৃথকভাবে ছন্দাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন কী ? আমার ধারণা কখনো কখনো কবিতা বাধাপ্রাপ্ত হয়।সবাই তো আর রবিকবি কিংবা মধুকবির মতো এত সমর্পিত নিষ্ঠাবান নন ! খোলা হাওয়ার কাছাকাছি যেতে পথ মাপামাপি করা যায়? যারা লিখছেন লিখুন ছন্দ মাত্রা মেপে মেপে।আর যারা জীবনছন্দে নিজেদের সমর্পণ করেছেন, তাঁদের কাঠি না করে কবিতায় থাকতে দিন !
রিমি দে
দৃষ্টিপথ
এই চোখ যা বলছে
পাখি তা বলছে না
পাখি একটি অনন্ত চোখ
নিজস্ব কিছু খুঁটে খেতে
জগৎ অগ্রাহ্য করে উড়ে যেতে যেতে
বাতিল কিছু উড়িয়ে দিতে দিতে
হাওয়ার শূন্যে নিজেকে মেলে দেয়
পাখি একটি শেষহীন পথ
অথচ
পাখি যা যা দেখায় পথ তা দেখায় না..
পথ একটি জীবনের সমনাম !
সংসার
বিষগাছটি আশ্চর্য আনন্দ নিয়ে খেলে
আমি তাকে দূর থেকে দেখি
ওর চারদিকে কোনো জল নেই আলো নেই
অথচ মা তাকে বাতাস দিতেই থাকে অবিরাম
মায়েরও কি বিষ আছে
পাপের মতো তাপের মতো আলো
ব্যক্তিগত গাছে ঝুলে আছে
আলো বেয়ে বেয়ে নেমে আসে ফিসফিস হাসি গান
তার ঘ্রাণে কি অমৃত থাকে
যেখানে তার সন্তান ও সংসার
অর্থ জমি গয়না ও প্যাঁচ পয়জার জমা হয়
বিষগাছ লকলকে পাতায় পেতে দেয় পরমান্ন
আশ্চর্য আনন্দ নিয়ে বিষ তার বটগাছে ঝুরি খুলে দেয়
সাপ
সাপটি আমাকে ছাড়িয়ে গেছে
শরীর জুড়ে গোখরোর মতো ঢেউ
রসে ভেজা গোটা শরীর
প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো অভিঘাত….
খোলসের সঙ্গে মুক্তির বিবাদ অবিরাম
একে অপরের বিরুদ্ধে বিষেদাগার ছড়ায়
মধু মুখে নিয়ে মেলে রাখি সবুজ প্রান্তর
ঘাসে ঘাসে আমার মধুমাস
ফণা তার বিষাক্ত ওমে মুড়ে ফেলে ইমনকল্যাণ
সাপের মন নিয়ে মানুষের জঙ্গলে
কবির অভিনয় করি
নিজের ছায়াতে সর্পরূপে সমাহিত হই
মানুষটি সাপ ও মানুষ দুটোই হতে পারে
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us