- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ১৯, ২০২৩
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে
ভাস্কর্য: সুষেণ ঘোষ ।১৯৮৫।মাধ্যম ব্রোঞ্জ
ভুবনবঙ্গের ৫২ জন কবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের লেখার মুহূর্ত, তখনকার ঘোর আর চেতন বা অবচেতনের বিষয় আশয় নিয়ে বলবার জন্য। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে কিছু প্রশ্ন, আড়ালের কোন আত্ম লিখতে বসায়, ক্রমশ মনোবাসী করে তোলে কে এই অধরা ? নিয়ে যায় অন্যরকম বনবাসে কিংবা জনবৃত্তের কোলাহলে? কী তার পরিচয়? অদৃশ্য অস্তিত্ব ? একধরনের পাগলামি ?
আমাদের আমন্ত্রণে, সাড়ম্বর উৎসাহে সাড়া দিয়েছেন প্রিয় কবিরা ।আমরা বিনম্র, আমরা কৃতজ্ঞ।
হাইলাকান্দির একদা বাসিন্দা তীর্থঙ্কর পুরকায়স্থ এর ভ্রাম্যমান, বর্ণময় অভিজ্ঞতার উচ্চারণ দিয়ে শুরু জিজ্ঞাসা। প্রবন প্রত্যুষ। প্রত্যেক রবিবার এরকম অন্তত, একজন কবির এককতার সঙ্গে দেখা হোক সকলের ।
বাহার উদ্দিন
১৯/১১/২০২৩
আমার কৈফিয়ত
কেন কবিতা লিখি ? আপাত-নিরীহ এ প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জিজ্ঞাসাটি খুব নিরাপদ বলে মনে হল না । যেন একটা জবাবদিহির দায় চেপে বসেছে। এত এত কবিতা চতুর্দিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। যে, তাতে প্রতিটি সংযোজনের কাছে দায় থেকে যায় নিজের অস্তিত্বের কৈফিয়ত জোগানোর। সেরকম জুৎসই কৈফিয়ত থাকে না অধিকাংশের কাছে। যাঁদের থাকে তাঁদের চিনে নিতে পাঠকের ভুল হয় না। তাই শুরুতেই বলে রাখা ভালো, গনইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি যব তুঁহু করবি বিচার, এমন একটি আবেদন রাখা ছাড়া পাঠকের বিচারশালায় নিজের সপক্ষে বলার মতো কোনো যুক্তিই নেই আমার। তবু কেন লিখি, এই নাছোড় প্রশ্নের উত্তরে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কী বা করার আছে ?
প্রশ্নটি যেদিন দূরভাষে উড়ে এল, তার দুদিন বাদে দেশের রাজধানীর এক বিদ্বজ্জন-সভায় দক্ষিণ ভারতের এক তরুণ অধ্যাপক আমাকে একান্তে পেয়ে চেপে ধরলেন, ‘শুনলাম আপনি কবিতা লেখেন। বলুন তো, আপনার কাছে কবিতার সঙ্গা কী ?’ যা কখনো দৃশ্যগত, কখনো অদৃশ্য। তাঁর প্রশ্নের সঙ্গে তিনি জুড়ে দিলেন আরেক মোক্ষম নির্দেশ, আমি যেন অধ্যাপকীয় কোনো সংজ্ঞা না দিই। ভাবলাম, সময় খারাপ হলে বোধহয় এমনই হয়। এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মনে হল, আমি হয়তো খুঁজে পেয়েছি আমার কৈফিয়ৎ। তরুণ অধ্যাপককে বললাম, যে ভাষা-শিল্প আমাকে বাচ্যার্থের বাইরে নিয়ে যেতে পারে, তাকেই আমি কবিতা বলি।
আমি জানি, এ সংজ্ঞাটি অভিনব নয়। আমার মনে হল, ভাষার অন্তরের চির-অধরাকে আজীবন খুঁজে বেড়াব বলেই কবিতা লিখি।
তীর্থঙ্কর দাশ পুরকায়স্থ
অত্যাগসহন
কী করে যে বেঁচে আছি সে এক বিস্ময়,
যখন মুহুর্মুহু মেঘ চিরে ঘৃণার বিদ্যুৎ ছুটে যায়,
স্বেচ্ছায় হাত ছেড়ে চলে যায় বন্ধুত্বের হাত,
অমোঘ বৃষ্টিতে গৃহহীন দেখে তার মুখের ওপরে
বন্ধ হয়ে যায় একে একে সুখী গৃহকোণ,
তুই বেঁচে আছিস কীভাবে ?
মায়ের কোলের মতো স্নিগ্ধ গ্রহটিতে
আমাদেরই লাগানো আগুনে পুড়ে যায় শ্যামল গাছেরা,
আমাদের হাত থেকে জলে মেশে আত্মঘাতী বিষ,
মাইলের পর মাইল পড়ে আছে দুঃখী ডালপালা,
যখন হাতের মুঠো থেকে নির্মম কুঠার
কিছুতেই বিলগ্ন হচ্ছে না।
হাত-ধরাধরি করে একদিন সামগ্রিক মৃত্যুর ভিতরে
একসাথে হেঁটে যাব বলে
তোকে ছেড়ে যেতে পারিনি, কবিতা।
ভিড় থেকে দূরে
কথা বলো, বলো কথা
শোনার লোকেরা নেই,
মেঘ ছাড়া কোনো শ্রোতা
নেই, তাই সাবধানে
বাতাসেরা ছোঁয় পাতাদের,
আঘাত লাগে না যাতে।
এই তো সময় যখন তোমাকে দেখার
ভিড় সরে গেছে আলোয়,
খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে অন্ধকার
ফুটিয়ে তুলেছে গ্রীবা ও চিবুক,
পৃথিবী তোমার একার,
একাকী তোমাকে দাঁড়িয়ে দেখছে সময়।
কী দেবে তোমার দর্শনপ্রার্থীকে
ভিড় থেকে দূরে, পুরস্কারের আশা
তুচ্ছ করেছে, কী দেবে সে ভিখারিকে?
কথা বলো তুমি, সেই গোপনীয় কথা,
যা কেবল দুই, একজনই নেয় লিখে !
রঙিন বুদ্বুদ
হে কবিতা, রঙিন বুদ্বুদ, তোমাকে প্রণাম।
বেলা গড়িয়ে বিকেল,
ছাতা মাথায় লোকটিকে পেরিয়ে
রোদ এখন ধুলোয় ।
ছিপ হাতে ফিরে যেতে যেতে
তার চোখে
হীরক-খন্ডের মতো জলের মাছেরা খেলা করে।
হে কবিতা, রঙিন বুদ্বুদ, ধরা দাও তার ঘুমের ভিতরে।
মাটি
মাটি আনো, অতীতের গন্ধবহ মাটি,
যাতে দোর খুলে মা এসে দাঁড়ায়,
শাড়িতে অজস্র গিঁট, চুলের জটায়
কতকাল তেল নেই, দু’চোখে পিঁচুটি,
সে চোখেই মা দেখুক আমাদের
ফেলে আসা গাঁ-টি ।
যদি তার মনে পড়ে ছবির আঁকের মতো নদী,
ওপরে বাঁশের সাঁকো, এপার ওপার
করা সব লোকজন, হাতের মুঠোর মতো হাট,
যাতে সাধ ও আহ্লাদ, কামিনী-কাঞ্চন
গরীবের, মা-র আজ মনে পড়ে যদি !
মাটি আনো, তুমি যাকে বলো ইতিহাস,
মা সেখানে পুঁতেছিল নিমের চারাটি,
বড়ো হয়ে একদিন আরোগ্য-বাতাস
দেবে কথা ছিল সন্তানের ভরন্ত সংসারে।
মাটি আনো, ঘড়া ভরে আরো আরো মাটি,
আমরা তো ভুলে গেছি, মা-র কিছু মাটি দেখে
হয়তো বা মনে পড়তে পারে।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us