- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- আগস্ট ১৮, ২০২৪
প্রচলিত ইতিহাসের বিপ্রতীপ সত্য

রণক্ষেত্রে ঘোড়সাওয়ার সিরাজ
মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস, বিশেষ করে নবাবি আমলের ইতিহাস লেখা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। সাহেবরা পাখি মারতে গেলেও তার ইতিহাস লেখা হয়, কিন্তু বাংলার ইতিহাস নেই। উক্তিটি করেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলার ইতিহাস নেই বলে যাঁদের আক্ষেপ ছিল বেশি তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন –উইলিয়াম উইলসন হান্টার। এইসব মনীষীর কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে গণ্য হয়েছে। সঠিক সময়ে মুর্শিদাবাদ কিংবা নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস লেখা হয়নি। কখন ওখান থেকে মূল দলিল পত্র উধাও হয়েছে, তারও হদিস পাওয়া যায় না। নবাবি দফতরেও তার কোন অনুলিপি সুরক্ষিত নেই। সিরাজদ্দৌলার যেটুকু ইতিহাসের খবর পাওয়া যায়, তা সবই হয় জনশ্রুতি না হয় মন গড়া কিংবা প্রতিহিংসার ইতিহাস। ইংরেজরা বা তৎকালীন ইতিহাসবিদরা তাঁকে অবহেলার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের যেটুকু রসদ পাওয়া যায় – তা হলো
‘ মূতক্করীণ’ এবং ‘রিয়াজ – উস সলাতিন’ থেকে। তারও নানা অনুবাদ দেখা যায়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে হাজি মুস্তাফা নামে একজন ফারসি বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ‘মূতক্করীণ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রাইভেট সচিব জোনাথন স্কট আরেকটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। সমকালে লক্ষ্ণৌনিবাসি মুন্সি নওলকিশোর বইটির একটি উর্দু অনুবাদও করেন। এইসব গ্রন্থও এখন দুষ্প্রাপ্য। ‘রিয়াজ-উস-সলাতিন’–এর সম্পূর্ণ অনুবাদ হয়নি। তবে এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধনে মূল গ্রন্থখানি বাংলা অনুবাদ করা হয়েছিল।

ফারসি থেকে ইংরেজিতে রিয়াজ – উস সলাতিন
‘তারিখ-এ-মুনসুরি’ অপেক্ষাকৃত আধুনিক গ্রন্থ বলে অনেকের কাছে বিবেচিত। প্রাচ্যপন্ডিত অধ্যাপক ব্লকম্যান এ গ্রন্থের সারাংশ সংকলন করে গিয়েছেন।গ্রন্থখানি এশিয়াটিক সোসাইটির তত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছিল। তা এখন দুষ্প্রাপ্য। বাজারের মামুলি গ্রন্থগুলো পাওয়া যাচ্ছে এবং জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে আমাদের ইতিহাস চর্চায় এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস ভুলে ভরা। এটা হয়তো অনিচ্ছাকৃত নয়। এসব বৃত্তান্তে সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে ইতিহাস এবং তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তার আগের অনেক স্থাপত্য আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজের আমলের কোন স্থাপত্য কোথায় তা নির্নয় করা আজ বড়ো কঠিন।
হীরাঝিলের প্রাসাদ নির্মাণের পর সিরাজদ্দৌলা সেই স্থানে নিজের নামানুসারে মনসুরগঞ্জ নামে একটি বাজার বা গঞ্জ গড়ে তোলেন। সে, বাজার থেকে যে আয় হত তা সিরাজের অধিকৃত ছিল। কারণ বাজারের উন্নতি ও আয় বৃদ্ধি হবে তার দিকে তিনি নজর রাখতেন। এছাড়াও নবাব আলীবর্দীর শাসনামলে হীরাঝিলের খরচ বাবদ সিরাজ যে নজরানা আদায় করত তা ‘নজরানা মনসুরগঞ্জ’ নামে বাৎসরিক জমায় পরিণত হয়েছিল
খোসবাগের ইতিহাস, সিরাজ হত্যার ইতিবৃত্ত, অন্ধকূপ হত্যার ইতিকথা, সিরাজের বিচক্ষণতার বা বীরত্বের ইতিহাস সবই আজ বিকৃত, অথবা এলোমেলো। সঠিক মূল্যায়িত ইতিহাস নেই বললেই চলে, যা আছে তা মন গড়া কথন। দেশি বিদেশি ইতিহাস রচিয়তারা সিরাজদ্দৌলার চরিত্রকে নানা ভাবে কালিমালিপ্ত করে তুলেছেন। যে-সব অপরাধে সিরাজ দোষী নন, তাও তাঁর উপর আরোপিত হয়েছে। একমাত্র অক্ষয়কুমার মৈত্র যুক্তি দিয়ে তাঁর রচিত সিরাজদ্দৌলা গ্রন্থে কিছুটা খণ্ডন করেছেন। বাকিরা সেটা না করে উল্টে নানান অপবাদের সলিলে সিরাজকে ডুবিয়েছেন। আর এই ইতিহাস আজও আমরা বহন করে, পাঠ করে চলেছি। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে রাত কাটিয়েছেন এবং বাংলার দুশমনদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খান যখন বর্গীদের আক্রমণ রুখতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন বালক সিরাজ অসি হস্তে দাদুর সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করতে পিছপা হয় না। এরপরও তাঁকে নিয়ে রটনা অব্যাহত অকর্মণ্যের ঢেঁকি, জঘন্য রুচির চঞ্চল যুবক সিরাজ দাদুর সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং অসি চালানোয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আশৈশব মাতামহের কণ্ঠলগ্ন হয়ে প্রত্যেক সেনাশিবির পরিদর্শী। বর্ধমানের কাছে মহারাষ্ট্রীয় সেনা যে সময় বীরদর্পে আলিবর্দীর গতিরোধ করে, তখন সিরাজ নিতান্ত বালক। সে সময় বৃদ্ধ নবাবের সঙ্গে যুদ্ধ শিবিরে তাঁকে দেখা যায়। তাঁকেই ঘুরিয়ে নানা অপবাদ তার নামে ছড়িয়ে আছে। এখন আমাদের কাজ প্রচলিত ইতিহাসের ভুল- ভ্রান্তি দূর করে নতুন বা সঠিক ইতিহাস লেখা ।

নবাব আলীবর্দী খানের সঙ্গে সিরাজ ।১৭৫৬ সালে আঁকা তৈলচিত্র
মনসুরগঞ্জ – হীরাঝিলের প্রাসাদ নির্মাণের পর সিরাজদ্দৌলা সেই স্থানে নিজের নামানুসারে মনসুরগঞ্জ নামে একটি বাজার বা গঞ্জ গড়ে তোলেন। সে, বাজার থেকে যে আয় হত তা সিরাজের অধিকৃত ছিল। কারণ বাজারের উন্নতি ও আয় বৃদ্ধি হবে তার দিকে তিনি নজর রাখতেন। এছাড়াও নবাব আলীবর্দীর শাসনামলে হীরাঝিলের খরচ বাবদ সিরাজ যে নজরানা আদায় করত তা ‘নজরানা মনসুরগঞ্জ’ নামে বাৎসরিক জমায় পরিণত হয়েছিল।
নবাবি আমলের ইতিহাস লেখা, বিশেষ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে আমাদের জ্ঞান নিতান্ত সীমিত। তাঁর কোনো স্মৃতি, প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যে-টুকু পাওয়া যায় তা-হল তাঁর সমাধি। সেওতো অবহেলিত। প্রকাশিত গ্রন্থাদি এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য। গাইডরা পর্যটকদের ভুলভাল ঠিকানায় নিয়ে গিয়ে, কাঠগোলা বাগানকে সিরাজের প্রাসাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
বিহারের পাটনা যাবার পথে শত্রুর হাতে ধরে পড়েন তিনি। এবং মুর্শিদাবাদ নিয়ে এসে তাঁকে নিমকহারাম দেউড়িতে বন্দি করে রাখা হয়। অতঃপর ৩ জুলাই ১৭৫৭ মতান্তরে ৪ জুলাই ১৭৫৭ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। কতিপয় ঐতিহাসিক তাঁদের বিকৃতি, তাঁদেরই লালিত ঘৃণা ঢেলে দিয়েছেন সিরাজের চরিত্রে।
অনেকেই তাঁর ব্যক্তি চরিত্র নিয়ে টানাটানি করেছেন। যেমন, ইন্দ্রিয় বিকৃতি, সুরা পান, যৌনতা ইত্যাদি। কিন্তু এসব অপবাদের সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণ তথ্য পাওয়া যায় না। রাণী ভবানীর বিধবা কন্যাকে নিয়ে যে অপপ্রচার আছে তা কমল বন্দোপাধ্যায় তার “মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি” গ্রন্থে খণ্ডন করেছেন। আসলে সিরাজ বিদ্বেষ এক প্রকার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চেহারা হয়ে ওঠে। হীরাঝিল প্রাসাদ নির্মাণ নিয়ে আলিবর্দী ও সিরাজের মধ্যে যে সংঘাতের কথা বলা হয়েছে, তাও এক প্রকার মিথ্যা। এরকম বহু কলঙ্ক সিরাজের গায়ে প্রলেপন করা হয়েছে। প্রকৃত সত্য গোপন করে। সিরাজ, নবাব হিসেবে যথেষ্ট পরিণত, তা সত্ত্বেও তাঁকে কলঙ্ক বহন করতে হয়েছে।কেউ যে সিরাজের পক্ষ অবলম্বন করেননি তা নয়। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অন্ধকূপ হত্যার দায় থেকে তাঁকে অব্যহতি দিয়েছেন।তিনি বলেন অন্ধকূপ হত্যা অলীক কাহিনী মাত্র। সভাসদরা আবার ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করলেও সিরাজ তাদের ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছেন। উদাহরণ, কলকাতায় ব্রিটিশরা যখন দুর্গ নির্মাণ করে তখন সে দুর্গ উচ্ছেদের সময় উমিচাঁদ ও কৃষ্ণ বল্লভ আত্মগোপন করে ছিলেন এবং সিরাজ পরে তা জানতে পেরে তাদের তিরস্কার করা দূরে থাকুক, সিরাজ উভয়কেই যথোচিত সমাদরে আসন গ্রহণ করতে বলেন।অন্ধকূপ হত্যার গল্প কথা ছড়িয়ে গেছেন হলওয়েল সাহেব। রটিয়ে গেছেন যে, ১৭৫৬ খ্রিস্টব্দের ২০ জুন রাতে ১৪৬ জন বন্দির মধ্যে ১২৩ জনকে হত্যা করা হয়। এইরূপ ঘটনা যাচাই করার দরকার পড়েনি কারও কিন্তু অপপ্রচার করতে শুরু করল তারা। সত্য তথ্য প্রমান না করেই হলওয়েল সাহেবের মিথ্যা ও কল্প কাহিনীর খরস্রোত বাড়িয়ে গিয়েছেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল সর্বজন বিদিত। ২১ বছরের নবাব শান্তিতে রাজ্য শাসন করার সুযোগ পাননি। তাঁর সভায় হিন্দু মন্ত্রী, কোষাধ্যক্ষ, জমিদার ও সেনানায়ক ছিলেন। সিরাজ যদি হিন্দু বিদ্বেষী হতেন তাহলে এঁরা এসব পদে থাকলেন কীভাবে ? সিরাজউদ্দৌলার মতো বহুল পরিচিত নবাবকে কলঙ্কিত করে তুলেছেন ততকালীন ঐতিহাসিক লেখকরা।পাশাপাশি সমকালে ইংরেজ পর্যটক বা পর্যবেক্ষকরা ও সিরাজের নিষ্ঠুর স্বভাব, লাম্পট্য, মদ্য পান আসক্তি বা নারী- লোলুপতার কথা বেশি করে উল্লেখ করেছেন। মোদ্দা কথা সিরাজ সুবিচার থেকে বঞিত এক ট্র্যাজিক নায়ক।

নবাব সিরাজের গোলন্দাজ বাহিনী । ১৯০০ সালে আঁকা চিত্রটি লন্ডনের সেনা যাদুঘরে সংরক্ষিত
সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার ক্ষমতাসম্পন্ন নবাব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দালালরা বুঝে গিয়েছিল যে, সিরাজ তাদের যে কোন ফন্দি -ছক অনায়াসে বানচালের জন্য একাই যথেষ্ট।তাই বাণিজ্যিক পরিকল্পণা চরিতার্থ করে ক্ষমতার চাবিকাঠি দখলের জন্য সিরাজকে ক্ষমতা চ্যুত করা জরুরি ছিল তাদের কাছে। দুরাচার নৃশংস পামর দেশীয় কেষ্ট বিস্টুদের পাশে নিয়ে সিরিজকে ক্ষমতা বা সিংহাসন চ্যুত করেছিল।সিরাজ প্রথম থেকেই ফিরিঙ্গির শত্রু, আলিবর্দীর স্নেহ ভাজন, সৌম্য যুবক, বিচক্ষণ। সিরাজ নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় না দিয়ে বাঙ্গালি বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এরপরও সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে আর কত অবহেলা দেখব। তাঁর জন্ম সাল তারিখ নিয়েও কল্প- কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন সিরাজের জন্ম ১৭৩৩ সালের পূর্বে। আবার এস সি হিল বলছেন, সিরাজের জন্ম ১৭২৯ সালে।
সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু নিয়ে টালবাহানা রয়েছে। দেশীয় ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থ “রিয়াজ-উস-সালাতিন” থেকে জানা যায়, সিরাজদ্দৌলা নিহত হয়েছিল –ইংরেজ সেনাপতি দিগের এবং জগৎশেঠের কূট অভিসন্ধিতে। দোষ চাপানো হয়েছে মীরণের উপর। মোহাম্মদী বেগ তরবারি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল সিরাজের দেহ নাকি ইংরেজরা অন্য উপায়ে হত্যা করে তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তা নিয়ে ধোঁয়াশা ও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে।
যাহোক সিরাজের রাজত্বকাল ছিল, ১৭৫৬-৫৭ সাল। পূর্ণ নাম, মনসুর -উল-মুলক মোহাম্মদ হযরত জঙ্গ বাহাদুর। প্রথমা স্ত্রী উমদাতুননেসা বেগম। দ্বিতীয় স্ত্রী বেগম লুৎফুন নেসা। কন্যা উম্মে জোহরা।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হলে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থলপথে এবং জলপথে ভগবান গোলা, পরে মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ জল কমে গেলে নিজামপুরের মোহনায় এসে সিরাজের নৌকা চড়ায় আটকে যায়।বিহারের পাটনা যাবার পথে শত্রুর হাতে ধরে পড়েন তিনি। এবং মুর্শিদাবাদ নিয়ে এসে তাঁকে নিমকহারাম দেউড়িতে বন্দি করে রাখা হয়। অতঃপর ৩ জুলাই ১৭৫৭ মতান্তরে ৪ জুলাই ১৭৫৭ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। কতিপয় ঐতিহাসিক তাঁদের বিকৃতি, তাঁদেরই লালিত ঘৃণা ঢেলে দিয়েছেন সিরাজের চরিত্রে। এসব বিকৃতিকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলার সিরাজ প্রেম ! শিল্পে, সাহিত্যে সিরাজ উঠেছেন এক ট্র্যাজিক হিরো !
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us