Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুন ২৯, ২০১৯

ভাংড়িওয়ালা

হালাভোলা, কাদামাটির মানুষ মানুষ কেতাব। বিপদটা যে এভাবে লোহালক্কড় টিন ভাঙা হাল ভাঙা ফাল ভাঙা ফুঁড়ে সিনার হাড়ে গেঁথে যাবে তা বাপের কালেও ভাবেনি সে...

সৌরভ হোসেন
ভাংড়িওয়ালা

রেখাচিত্র: সুনীল দাশ

কালো রঙের আগা সূচালো কী একটা তীরের বেগে ছুটে গিয়ে টং করে পড়ল পাটকাঠির আড়ালে ! গায়ে বলদের জোর দিয়ে জিনিসটা ছুঁড়ল কেতাব। যে জোরে শব্দ করে কালো টুকরোটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তার চেয়েও ঝং করে একটা খেঁখানো কন্ঠ উশরা ডিঙিয়ে বেরিয়ে এল, “বিপদডাকে এক্ষণই ফাঁসির দড়ি বানাবা নাকি ! তুমার দেখছি, হায়া লজ্জা বুলে কিচ্ছু নাই !” চোখ কটমট করতে করতে উশরা থেকে ছঞ্চেয় নামল তাহেরা ।
“অ কিচ্ছু না । একটা আপদ তখন থেকে উশরায় ঘুরঘুর করছিল ।“ আলগা করে বলল কেতাব ।

বিপদটা যে এভাবে লোহালক্কড় টিন ভাঙা হাল ভাঙা ফাল ভাঙা ফুঁড়ে সিনার হাড়ে গেঁথে যাবে তা বাপের কালেও ভাবেনি কেতাব । হালাভোলা আবাং মানুষ কেতাব । মাঝেমধ্যেই দরদামে ভুল করে । খ্যাতালের সব লোক জানে কেতাবকে ঠকানো সহজ । কিন্তু একেবারে কাদামাটির মানুষ কেতাবের চোখেমুখে একটা মাওর ভাব থাকায় কেউ তাকে ঠকায় না । কিন্তু এই অবলা কেতাবের এখন যা হাল তাতে তার এবার জেলে ঢোকার উপক্রম ! বাগে পেয়ে এখন সবাই বলছে, ওপরে মাওর মাওর হলেও ভেতরে বেটা একটা ঘাগু মাল ।

খ্যাতাল পুরোপুরি বন্ধ । যে লোকটা সাইকেলে করে হাঁক পাড়তে পাড়তে দশ গাঁ টইটই করে চক্কর মারত, সে লোকটা এখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছে ।যেকোন সময় পুলিশ ধরতে পারে । কলার ধরে টানতে টানতে বলতে পারে, লাইন ভালই ধরেছিস, শালা ভাংড়িওয়ালা এবার তোকেই পিটিয়ে ভাংড়ি বানিয়ে দেব ।

“কিনার সুমায়, তুমার চোখ কি বুজে থাকে ? ভালো করে দেখে লিতে পার না ? আনাকানি কৈতকার ! একেবারে আক্রা দামের জিনিস পানির দামে পেইছ আর অমনি কিনি লিইছ ! টাকার লোভ তোমার চোখ থেকে কুনুদিন যাবে না খ !” খ্যারখেরে গলাটা ভাংড়ির মতো টং করে বেজে উঠল তাহেরার ! তার এখন আখাতে হাঁড়ি চড়ানো বন্ধ হওয়ার জোগাড় । একমাত্র রোজগেরে লোকটারই তো কোন হিল্লে হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না,তো সংসারের আর কী হিল্লে হবে ! ভ্যালভ্যালে চোখগুলো ফাঁদে আটকানো ঘুঘু পাখির চোখের মতো ঘুলঘুল করছে কেতাবের । হাড়গিলে চামটা মুখটা দুশ্চিন্তার মোড়কে মুদে গেছে ! ফ্যাকাসে গালের ওপরে ঘন হয়ে জমেছে পাড়ি মোষের মতো শ্রাবণের মেঘ । এঁটেল শরীরটা পাকানো দড়ির মতো কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে ! বাপের কালে কোনদিন থানাকোর্ট করতে হয়নি । উকিল মোহরির ছায়া মাড়াতে হয়নি । থানার তিন সিমনায় গিয়েছে কি না তাও সন্দেহ আছে । আর এখন বিপদটা যেভাবে ঘাড় বেয়ে মাথায় চাপছে, তাতে পাঁচ-বছরের জেল নিশ্চিত । চোখের হালকাফোলকা ভ্রূ কুঁচকে ঢ্যাসঢেসে গলায় কেতাব বলল, “আমি কি আর অত হাংলিয়ে দেখি ? একটা আন্দাজ করে কিনি ।“

“হাংলিয়ে দ্যাখোনি তো এবার দ্যাখো মজা, তুমার হাড়-মাংস হাংলিয়ে লিবে পুলিশে ! ভাঙা জিনিসের কত বিষ এবার বুঝবা !” ঝাঁঝিয়ে উঠল তাহেরা । মাথার ঘোমটাটা মাথা থেকে খস করে পড়ে গেল । পরনের হলুদ পাড় ফিকে গোলাপি শাড়িটায় তাহেরাকে শেকড় কাটা ফুলের মতো এলেবেলে লাগছে । বিনুনিহীন আলুথালু চুলগুলো আশ্বিনের উত্তরে বাতাসে ফিনফিন করে দুলছে । পানপাতার মতো মুখটা দুশ্চিন্তার হাতুড়ে থেঁৎলে ভাট পাতার মতো কচড়া হয়ে যাচ্ছে ! ভেতরে ভেতরে ডুকরে উঠছে সে । ঘোমটাটা মাথায় দিয়ে বলল, “পার্টি অফিসে গেলছিলা ?”
“গেছুনু ।“ ঘাড় হেলাল কেতাব । কালো কুচকুচে ঘাড়ের হাড়গুলো কানের লতি ছোব ছোব করছে । মাংস ঝুড়ে বাতা হয়ে গেছে । এই ঘাড়েই সংসারের জোয়াল । পাঁচ পেটের রুজির ভার । খটখটে আল-খালের মতো ঘাড়ের গর্তে দলা হয়ে আছে ছোপ ছোপ অন্ধকার ।
“কী বুলল ?”
“কেহুই পাত্তা দিল না । বুলছে, অ নাকি জটিল কেস ! কেহুই কিছু করতে পারবে না !”
“মজিদ চৌধুরি ? উনার কাছে কি গেলছিলা ?”
“হু, কিন্তু যাওয়াই হয়িছে, কাজ হয়নি । সরাসরি মুখের ছমুতে বুলে দিলেন, তুই যে এত ঘাগুমাল আগে তো জানতাম না ! তা ই কারবার কতদিন ধরে চলছে ? তোর মাথার ওপর নিশ্চয় বড় কোন চাঁই আছে ? সেটা কে বলত ? কোন পার্টির ?“
“তুমি এসব কান পেতে শুনলা !”

“শুনা ছাড়া কী করব ? ছোটলোক হয়ে বড়লোকের গায়ে হাত তুলব ? গরীবের অত ফোঁস করতে নেই । তাও আবার মজিদ চৌধুরির মতো নেতা !যাঁর দাপটে এ তল্লাটে বাঘে-গ্রুতে একই ঘাটে পানি খায় । লোক লাগিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে হাওয়া করে দেবেন ! এমন কেসে ফাঁসিয়ে দেবেন, জেল খেটে জান ফুরিয়ে যাবে !”

দড়ির ছিবড়ার মতো কেতাবের দুবলাপাতলা শরীরটা নিংড়ে পড়ল । তার খুটল চোখে ঝলসে উঠছে অভিমানী রাগ । পরনের লুঙ্গিটা গুটিয়ে ঠ্যাঙ ঠেঙে পায়ে এক খাবলা উঠোনের পুব কোণের নীম গাছটার তলায় খুঁটির মতো দাঁড়াল কেতাব । ঠান্ডা হিমেল বাতাস নিমপাতার কিণারা ছুঁইয়ে ঝিরঝির করে নামছে । বাতাসে ঠেস দিয়ে নামছে সন্ধ্যার গোধূলি । নিমগাছের আড়ালে এক ঠ্যাঙে এসে দাঁড়িয়েছে মিহি অন্ধকার । ঠান্ডা বাতাসে সে অন্ধকার জ্বাড় মেখে টালের ছাউনির দুখুপরি ঘরের চৌকাঠে ঠক্কর দিচ্ছে । উশরার ঠেকনাটাই উপড়ানো গাছের গুঁড়ির মতো কাত হয়ে  দাঁড়াল তাহেরা । ঘোমটার আড়াল দিয়ে আলগোছে ফিসফিস করে বেরিয়ে এল,“মহাজন কী বুললেন ?”

 


ছোটলোক হয়ে বড়লোকের গায়ে হাত তুলব ? গরীবের অত ফোঁস করতে নেই ।যাঁর দাপটে এ তল্লাটে বাঘে-গ্রুতে একই ঘাটে পানি খায় সে লোক লাগিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে হাওয়া করে দেবেন ! এমন কেসে ফাঁসিয়ে দেবেন, জেল খেটে জান ফুরিয়ে যাবে !


“উনি তো এখন পুরোপুরি উল্টি মারছেন ! আমাকে এই কডাদিন আড়তে যাতে মানা করেছেন । উনি ভয় করছেন, বিপদটা যদি আমার পায়ে হেঁটে উনার আড়তে পৌঁছে যায় !” নিমগাছে ঠেস দিল কেতাব । নিমগাছের পাতার আড়ালে ততক্ষণে বেশ কয়েকটা তারা ফুটে গেছে । নীল আকাশে সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ডানা মেলছে ফিনফিন করে।

“এত দিন ধরে যার সাথে কারবার করছ, সে লোকও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ! ওই ভুঁড়িমোটা লোকটা এতই চশমখোর !” তাহেরার কন্ঠ মুষড়ে পড়ল ।খাড়া হয়ে আর দাঁড়াতে পারল না সে । অভিমান আর কষ্টের ভার যেন তাকে বসিয়ে দিচ্ছে । খুঁটিটার নীচে থপ করে বসে পড়ল । সামনের উঠোনে তখন লুকিয়ে ছুপিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে অন্ধকার । আশপাশের ঝোপঝাড়ও জেগে উঠছে । ঝাঁপি ফুঁড়ে ধেয়ে আসতে শুরু করে দিয়েছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক । পাশের গাবগাছে একটা বাদুড় হড়মড় করে উঠতেই, কেতাবের ভেতরটা ধড়াক করে উঠল ! ভেতরের নাড়িভুঁড়ি, হাড়-মাংসগুলো কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে ! কিছু একটা হলকম্প কানে বাজলেই, অন্তরটা কুঁকড়ে উঠছে ! বিপদ মাথার ওপর খাড়া হয়ে থাকলে,আওয়াজ যেন এভাবেই আতঙ্কের সহদর হয়ে ওঠে । কেতাব মনে মনে ভাবল, তাহেরা মন্দ কিছু বলছে না । রসিদ মোল্লা এক ধরণের চশমখোরই ।ভাংড়ি কিনে কিনে লোকটার মনটাও লোহালক্কড় হয়ে গেছে ! তাঁর অবশ্য লম্বা হাত । মাসে মাসে থানাকে তোলা দিয়ে পুলিশকে কব্জা করে রেখেছেন। কিছু একটা লটঘট হলেই, পুলিশ এসে ওপর ওপর হাম্বিতাম্বি করে যায়, কিন্তু তলে তলে ঠিকই হাত করা থাকে, একটা কেসও যেন নামে অনামে দাগি হয়ে না থাকে । লাভের একটা অংশ মাস পয়লা হতেই খামে ভরে থানার বড়বাবুর টেবিলে চলে যায় যে।
কেতাব থপ থপ করে হেঁটে এসে উশরায় ‘দ’ হয়ে বসে । তাহেরার শাড়ির ছোঁয়া লাগে তার নিরমেদ গায়ে । তার পা জড়িয়ে ঘরে ঢোকে প্রথম রাত ।বিড়বিড় করে বলে, “গরিবের নোটও নাই নেতাও নাই । বিপদ আসলে ছায়াও পালিয়ে যায় । ভাংড়িওয়ালার কপাল ভাঙাই তো হবে ।“
“আল্লাহ যত কষ্ট গরিবদের লেগেই লিখে !” ভেজা গলা নিঙড়ে ওঠে তাহেরার । হেলে ওঠে ঠোঁট । চোখের ভ্রূ কুঁচকে নামে খোদার প্রতি অভিমান ।শাড়ি ব্লাউজে যতই মেয়ের মা হয়ে উঠুক, শরীরের বয়স যে এখনও কাচা । এই তো সেদিন আঁচলা লটকে আছড়াত।কেবলই দোপ হয়ে উঠল বুক।

ঘরের ভেতর থেকে একটা কীসের নড়নচড়নের শব্দ কানে এল । ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার আড়াল দিয়ে ভেতরের খাটটার দিকে দৃষ্টির ছিপ ফেলল তাহেরা । তড়াক করে উঠে বলল, “বুড়ির ঘুম ভেঙে গেলছে মুনে হয় ।“ বলেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল তাহেরা । অন্ধকার তখন ঝোপ বেঁধে জানালার ফাঁক দিয়ে মিনমিন করে ঘরে ঢুকছে । উঠোনে বোরখা পরে দাঁড়িয়েছে রাত । নীমগাছের আড়ালে উঁকি মারছে কাঁচির মতো ফালি চাঁদ । সেই মিঠে জ্যোৎস্না কুয়াশা চুইয়ে নামছে চোহদ্দিতে । বিড়ি ধরাল কেতাব । বিড়ির মুখে দুবার জোরে ফুঁ দিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে পুকটিটা আলতো করে ধরল । তারপর লাইটারটা ‘ঝলাক’ করে জ্বালিয়ে বিড়ির মুখে আগুন দিল । লাইটারের এক শীখা আগুনের আলো-ছায়াই দৃশ্যমান হয়ে উঠল,সাইকেলটা । ঝাঁপিতে ঠেস দিয়ে কাত করে রাখা আছে । যেন সাইকেলটা দুঃখে মুখ ভাড় করে গুমরে আছে । বাঙ্গিতে ঝুড়িদুটো ঝোলানই আছে ।কেতাবের সাইকেল চালানো আর বিড়ি খাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে । যে বছর কেতাব বিড়ি খাওয়া ধরেছিল, সেই বছরই সাইকেল চালানো শিখেছিল । তখন কেতাবের আর কত বয়স । এক আঁটি পাকা ধানের বোঝাও ঠিকভাবে মাথায় বয়ে আনতে পারত না। বাপ কেরামতের ধমকে পরনের পেন্টুল খুলে গেলেও, মুখ থেকে বিড়ির পুকটি পড়ত না ।

একবার জোর নিশ্বাসে বিড়ির টান দিল কেতাব । সাদা ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে নাক ছুঁয়ে চোখের সামনে দিয়ে আঁকিবুঁকি পাকিয়ে উঠে গেল । সে ধোঁয়ার ফাঁকফোকর দিয়ে কেতাব দেখল, ঝুড়িগুলোর ভেতরে কিছু লোহালক্কড় পড়ে আছে । ওগুলোর মধ্যে কিছু ঢুকে নেই তো ! বিড়িটায় আরেকবার জোর টান দিয়ে তিড়িং করে উঠে পড়ল সে । গডগড করে হেঁটে সাইকেলটার কাছে এল । সাইকেলটার গায়ে শ্যাওলার মতো ছোপ ছোপ অন্ধকার । ঝুড়িগুলোর দিকে ঘুলঘুলানো দৃষ্টি ফেলল কেতাব । দুই ঝুড়ি অন্ধকার যেন জাপ্টে ধরে ঘুমোচ্ছে । আর সে গহীন অন্ধকারে ডুবে আছে খ্যাতাল থেকে পাওয়া লোহালক্কড় । ভাংড়ি মাল । কেতাব হুটপাট করে ভাংড়িগুলো হাংলাতে লাগল, যদি কিছু লুকিয়ে থাকে ! অন্ধকারে হাত দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে একবার ‘ইস’ করে উঠল কেতাব ! কোন কিছুতে আঙুল ফুঁড়ে গেছে ! চোখের ছমুতে ধরল কচড়া আঙুলটা । অন্ধকার লেপ্টে থাকায় কাটাটা স্পষ্ট বোঝা গেল না । আঙুলটা টনটন করে টাটাচ্ছে । নিশ্চয় ফেড়ে গেছে । কেতাবের মাথায় বুদ্ধি খেলল । সে বিড়িটাকে মুখে পুরে দোমভর টান মারল । বিড়িটা পড়পড় করে উঠে একটা সলতের শীখার মতো আলো দপ করে খেলে উঠল । সে পড়পড়ানি আলোয় কেতাব দেখল, বুড়ো আঙুলের মাথাটা মিহি করে চিড়ে গেছে ! তা থেকে পিলপিল করে রক্ত চোয়াচ্ছে । ভাংড়ি কেনার কারবার করতে নেমে এমনিতেই তার একটা আঙুলও চিড়তে বা আঁচড়াতে বাকি নেই । কোথাও কাটা, কোথাও আচড়ানো তো কোথাও ফুটো হওয়ার দাগ । আবারও ঝুড়িটা হাংলাতে লাগল কেতাব । নাহ, সেরকম কিছু হাতে ঠেকল না । ঝুড়িতে বেশিরভাগই প্লাস্টিক ভাঙা । লোহালক্কড় কম । লাঙলের একটা জং ধরা ভোঁতা ফাল একেবারে তলায় থেবড়ে পড়ে আছে । পাশের ঝুড়িটায় খাড়া হয়ে মুখ তুলে আছে গুচ্চের সাইকেলের ভাঙা স্পোক । এক পাশে ঠেস দিয়ে পড়ে আছে একটা থ্যাবড়ানো টিনের কৌটো ।

“তুমি আবার ওই সব্বনেশে ভাংড়ি ঘাটতে গেলছ !” কথাটা ঘরের উশরা থেকে বাণের মতো ছুটে এল । ভ্রূ কপালে উঠে গেছে তাহেরার । কানের লতিকা রাগে লাল হয়ে উঠছে ! মুখ ভেংচে বলল, “তুমাকে না বুলেছিলাম, ওই ভাংড়িগুলান খাদে ফেলে দিয়ে আসতে ?”
রাগে গজগজ করতে করতে কাপড় লেংটিয়ে সাইকেলটার কাছে এল তাহেরা । ধসফস ধসফস করে বলল, “এই সাইকেলটাকেই এবার ভাংড়ির দামে বেঁচে দিয়ে আসো । আপদ চুকোক ।”

আপদ ! সাইকেলটা আপদ ! যে জিনিসটা এত বছর ধরে এতগুলো মানুষের পেটের রুজি এনে দিচ্ছে, সেই জিনিসটাকেই তাহেরা ‘আপদ’ বলছে !সাইকেলটা যে শুধু কতগুলো লোহালক্কড়ের জোড়াতালি তা তো নয়, সাইকেলটা আমার পা । আমার রোজগারের বাহন । সাইকেলটা না থাকলে কি অতবড় খ্যাতাল টইটই করে ঘুরতে পারতাম ? আমি এলে ভূতি হয়ে গেলেও সাইকেলটা কিন্তু আলে না । ও ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঠিকই ঘুরে যায় ।সাইকেলটাকে ধরেছিলাম বলেই তো আজ সংসারটা একটু শক্ত খুঁটির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে ? সাইকেলটাই আমার ভুঁই । আমার খেতি ।
“তুমি অ কী অলুক্ষণে কথা বুলছ গ !” ভ্রূ টান হয়ে ওঠে কেতাবের । ভাঙা স্পোকের মতো বেজে ওঠে গলাটা ।
“তুমার কি এখনও সান হচ্ছে না ! এই সাইকেলটা তোমাকে এবার আর খ্যাতাল না, একেবারে সরাসরি জেলখানায় টেনে লিয়ে যাবে !” মার্ডগার্ডের মতো ঝং করে বেজে ওঠে তাহেরার গলা । গলাটা আরও ঝেঁঝিয়ে উঠে বলল, “তুমি কি চাও, তুমি জেলে বসে বসে ঘানি টানো আর আমি ছেলেপিলে লিয়ে পথে বসি ?”

“তা কেন চাইব ?” চোখ ফেড়ে ওঠে কেতাব । “কুন স্বামীই বা এসব চাহাবে !” কথাটা শেষ হতে না হতেই হড়মড় করে সাইকেলটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ! বাঁশের লাঠির দাঁড়ানিটা হড়কে যাওয়াই, ঝুড়ির ঝুল সামলাতে না পেরে, সাইকেলটা ঝাঁপির গায়ে হুমড়ে পড়ল ! পিছনের বাতায় ঝোলানো দুটো ঝুড়ির একটা তলায় আরেকটা মুখ থুবড়ে ওপরের দিকে উল্টে পড়ল । ওপরের ঝুড়িতে রাখা ভাংড়িগুলো খড়মড় করে নীচের মাটিতে পড়ল ।ভাংড়িগুলোয় ঝুঁঝকি মিশে যেন মনে হচ্ছে এক লাদা অন্ধকার ঢিবি হয়ে পড়ে আছে । কেতাবের মায়াবি দৃষ্টি সেখানে উনহিয়ে পড়ল । তাহেরাও চোখ ফেড়ে সূচের মতো ঢুকে গেল পড়ে থাকা ভাংড়িগুলোর দিকে ! সেরকম কিছু নাই তো !

সেরকম কিছু না চোখে পড়াই, তাহেরা ‘যত্তসব’ বলে পরনের কাপড় গুটিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘরের দিকে চলে গেল । তার হাঁটার চলন দেখে মনে হচ্ছে, রাগ দাঁত থেকে খসে গা-গতর বেয়ে আঁচলার মতো উঠোনে ছ্যাচড়াচ্ছে । আর সে রাগে অভিমান করে অন্ধকারের মুখ আরও গুমরে উঠছে ।কেতাব লক্ষ্য করল, তাহেরা যেই গডগড করে ঘরে সেঁধিয়ে পড়লে, তার পিছু পিছু থোক থোক অন্ধকার উঠোন থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল ।কিছুক্ষণ ভারি চোখ জোড়া বন্ধ করে থাকল কেতাব । চোখের মণি দিয়ে হুড়মুড় করে মনের মণিতে ঢুকে পড়ল উঠোনের কেলঠে অন্ধকার । মন তখন হাঁসফাঁস করে বলছে, গরিবের উঠেনে যেমন ঝুপ করে যেকোন সময় অন্ধকার নেমে আসে, ঠিক তেমনি ঘরের ভেতরে আচমকা সেঁধিয়ে পড়ে আপদ ! সে আপদ কেউটের মতো ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করে ! উঠতে বসতে মারে ছোবল ।

সাইকেলটার সিটে আলতো করে হাত দিল কেতাব । মনের ভেতরে একটা অদ্ভূত উদ্দীপনা খেলে গেল । ডোবা জলে কেউ ঢিল মারলে যেমন থির জল স্রোত কেটে ওঠে, ঠিক তেমনি কেতাবের ঝিম মারা মনে একটা ঢেউ খেলে গেল ! ঘুলঘুলি চোখে একবার ঘরের চৌকাঠের দিকে চুরি করে তাকাল, তাহেরা কি দাঁড়িয়ে রয়েছে ? হলহলে কপাটদুটোর মাঝে ঘোমটা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধকার । তারপর ফুরিয়ে আসা বিড়িটাই একবার জোর সুখটান দিল কেতাব । পড়পড় করে উঠল বিড়িটা । ঢোল ফোলা গালদুটো চাপ দিয়ে গলগল করে ছেড়ে দিল ধোঁয়া । আলো-ছায়াই ধোঁয়াটা জ্বিনের কাপড়ের মতো সাদা হয়ে উড়তে থাকল । আর তখনই আচমকা ডান পা তুলে ‘ভ্যাক’ করে সাইকেলটাকে জোরে মারল এক লাথি !সাইকেলটা সড়মড় করে পাটকাঠির ঝাঁপির মধ্যে আরও পুঁতে গেল ! মনে বিড়বিড় করে উঠল কেতাব, তোর লেগেই আমার আজ এই আপদ ।জানের যন্ত্রণা । তোকে ল্যাওড়া মাটিতে পুঁতেই ফেলব ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!