শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
চিত্র: দেব সরকার
গ | ল্প ►
খোলা উঠোনে ঘুণি ঝাড়ছে বড়ো দাদু। তাকে ঘিরে ধরেছে কচিকাচার দল। মাটির মেঝেতে ছোটপুঁটিটা পরে লাফাচ্ছে। কুচো চিংড়ি, মোরলা, কই, লেটা, চ্যাং সহ বেশ কয়েকটা জিয়লমাছ পড়েছে। বেতের কাঠির ফাঁকে আটকে থাকা প্যাকালগুলো হাত দিয়ে টেনে ছাড়াতে ছাড়াতে হাক পাড়ল দাদু—লক্ষ্ণীর মা, ও লক্ষ্ণীর মা, এদিকটাতে আয়। আর কত বেলা করবি। সূর্য যে মাথার ওপর উঠে গেল। এর পর বাজারে গেলে আর কি দাম পাবি!
মৃদু বাতাসে মাছের গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। বড়ো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছটার ওপর বসে থাকা কাকটা কা কা করে যেন বলছে সুযোগ পেলেই ছো মেরে মাছ নিয়ে পালাব। একটাল এঁটো বাসন হাতে ঘোমটা দেওয়া একটা বউ ওঠোনের আর এক পাশ দিয়ে চলে গেল।
ঘুমভাঙা সূর্য চোখ খুলতে শুরু করল। মিষ্টি আভায় পুব আকাশে লাল রঙের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট পুঁটি, একদুখান তেলাপিয়ার তিড়িংতিড়ং লাফানো দেখে কচিদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিন্নি হাত তালি দিয়ে উঠল। ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বছরবারোর পাঁচু। তারপর ভোলা, ছোট্টু, ময়না, টিয়া। তিন্নির দিকে তাকিয়ে পাঁচু বলল, ওই তালি দিলি কেন? যাত্রাপালা দেখলি নাকি? ওর কথার উত্তর না দিয়ে তিন্নি ওয়ান-টু করে মাছ গুনতে শুরু করল। দাদু আবার হাঁক পাড়ল, লক্ষ্ণীর মা।
গলায় ঝাঁছালো সুর চড়িয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, সর সর; সর দিকি। পাঁচুর মাথায় চাটা মারার মতো হাত দিয়ে বলল, ওই কচি যাতো, একছুটে তোর ঠাম্মাকে ডেকে নিয়ে আয় দিকিনি। দাদুর রাগ বুঝতে পেরে ছেলেমেয়েগুলো এদিক ওদিকে সরে গেল।
# # #
তিন্নি একটু সরে গিয়ে তেঁতুল গাছটার নীচে দাঁড়াল। মাছের থেকে চোখ সরিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখত পেল এক হাতে ব্যাগ আর বগলদাবায় পাল্লা আর অন্য হাতে মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে এগিয়ে আসছে ঠাম্মা। ঠিক তার পিছন পিছন কতগুলো শাকপাতা হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে আসছে পাঁচু।নয় সন্তানের মা, ঠাম্মার পরনে মলিন সুতির কাপড়। কপালে সিঁদুরের লাল টিপ, মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুলের মাঝে চওড়া সিঁথি ভরা সিঁদুর। হাতে দুটো করে শাখা-পলা। সামনে আসতেই দাদু গলা খেকিয়ে বলল, তোর আর সময় হয়না বুঝি। কী এত ঘুস ঘুস করিস? বেলা কতটা বাড়ছে সে দিকে নজর আছে, না আমার মতো তোরও চোখেও ছানি পড়ছে?
এই তো যাচ্ছি, বলে ঠাম্মা তাড়াতাড়ি মাছগুলোকে জড়ো করে ব্যাগে ভরে নিল। তারপর পাঁচুর হাতের শাকপাতাগুলোও ব্যাগে ভরে নিয়ে দ্রুত পায়ে রওনা দিল। ঠাম্মাকে চলে যেতে দেখে মাটির ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এল পুঁটি। খালি গা, সরু সরু হাত-পা, পেটটা ফোলা। ওর আগে আগে ওর পেটটা এগোচ্ছে। দৌঁড়ে এসে আঁচল টেনে বলল, আমার জন্য বাজার থেকে খাবার আনবি তো বড়ো মা।ওর দেখাদেখি তিন্নি, পাঁচু ওরাও ঠাম্মার পিছন নিল।পুঁটির হাত সরিয়ে একটু এগিয়ে গেল ঠাম্মা। তারপর তড়তড় পুকুর ঘাটে নেমে মাছের হাত ধুঁয়ে নিল। বাড়ির ভিতরে পূর্ব-উত্তর কোন ঘেঁষে রয়েছে একটা জলাশয়। সান বাঁধানো নয়। এ বাড়ির লোকজন কতগুলো নারকেল কিংবা তাল গাছের গড়ান আর বাঁশ দিয়ে একটা ঘাট বানিয়েছে।পুকুরের উল্টোদিকে বাঁশবাগান। ঘাটের পাশেই একটা নারকোল গাছ তার দেহটা এমন ভাবে বেঁকিয়ে উপরের দিকে মাথা তুলেছে, দেখে মনে হয়, পুকুরের সঙ্গে সখ্যতা গড়তেই নিজের লম্বা দেহ গাছটা বাঁকিয়ে নিয়েছে। পুকুরের পাড়ে বসে বাসন মাজছিল পাঁচুর মা, এ বাড়ির বড়ো বউ। ঠাম্মা-দাদুর চার ছেলে পাঁচ মেয়ে। বড়ো মেয়ে লক্ষ্মী যে এখন কলকাতায় তিন্নিদের বাড়িতে থাকে। ছোট মেয়ে বাদে সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে চারবউ, প্রত্যেকের হাড়ি আলাদা। শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে তারা দেখে না। বড়ো ছেলে কার্তিক একটু পাগলা গোছেড়। তার সংসারের ভার এখনও বইতে হয় পাত্র বাড়ির কর্তা-গিন্নিকে। সংসারের কর্তা ননীগোপাল পাত্র যৌবনে এক বিঘা ধান জমি নিজেই রুইতে পারত। তড়তড় করে নারকেল, সুপারি গাছে চড়া, ধান-বোঝাই, ঝাড়াই কত কাজই না করেছে। এখন পড়ন্ত বেলা, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ। সকাল বেলা দু-একটা মাছ ধরা, অল্প বিস্তর খড়ের আটি কাটা ছাড়া তেমন কোন কাজই পারে না।
ঠাম্মা যেতে যেতে পেছন ফিরে পাঁচুর মাকে বলল— ও বউ, তোর শ্বশুড়কে দুটো পান্তা খেতে দিস। মানুষটা সে ভোর থাকতে উঠে মাছ ধরতে গেছিল, এতখানি বেলা হয়ে গেল, এখনও দানাপানি মুখে দেয়নি।তুই পরে বাসন মাজবি, হাত ধুঁয়ে শ্বশুরকে আগে খেতে দে। খালি পায়ে ব্যাগ হাতে জোরে জোরে হাঁটা লাগাল ঠাম্মা। ছেলেদের দল মাটির পথ ধরে একটু এগোতেই, ওদের হাত দেখিয়ে নির্দেশ দিল, এই তোরা বাড়ি যা এবার।
# # #
এঁকে বেঁকে কাঁচা রাস্তাটা চলে গেছে বহু দূর। রাস্তার ধার ঘেঁষে কত বুনো গাছের মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁয়া, তাল, নারকোল আর খেঁজুর গাছ। পথটা বেশ উঁচু। দুপাশে ছড়িয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ-আবাদ। আল দিয়ে ভাগ করা। সকাল না হতে হতেই বেশ কয়েকজন জমিতে নেমে পড়েছে। মাছের হাঁড়ি মাথায় নিয়ে বাজারের দিকেও এক-দুজন চলেছেন আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে। চারদিকে শুধু সবুজের সারি।
তিন্নি বাকি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফিরে আসছিল, এমন সময় একপাল ছাগল সঙ্গে নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে একটা ছেলে। ছাগলগুলো আগে আগে আর ছেলেটা পরে। ছাগলের গলায় বাঁধা দড়িগুলো হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরে রেখেছে ছেলেটা। কাছাকাছি এসে তিন্নিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাঁচুকে জিজ্ঞাসা করল, কে রে মেয়েটা। নতুন দেখছি এ গাঁয়ে। পাঁচু চুপ করে থাকল। পুঁটি চটপট করে বলল, ওতো বড়ো পিসির সঙ্গে কোনকাতা থেকে এসেছে। আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে মুখ খুলল ছেলেটা কিন্তু একটা ছাগল এমন ভাবে দড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল যে বাধ্য হয়ে এগিয়ে যেতে হল যুবককে ।
কচিদের দলে পাঁচুই সবথেকে বড়ো। সবার আগে এ বাড়িতে ও হয়েছে। তাই সব ব্যাপারেই দাদা দাদা ভাব দেখায়। তিন্নিকে বলল, চল বাড়িতে যাই, খিদে পেয়েছে। এতক্ষণ পর তিন্নি বুঝতে পারল ওরও খিদে পেয়েছে। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে মা কত কিছুই খাইয়ে দিত। নতুন পরিবেশে তিন্নির ব্যস্ততা তুঙ্গে। খাওয়া-দাওয়া ভুলে গিয়ে প্রাণভরে সারাক্ষণ গ্রামবাংলার রূপ-রস গন্ধ নিচ্ছে।
# # #
কাল যখন এই পাঁড়াগাঁয়ের বাড়িতে এসে ওরা পৌঁছল ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে গেছে। পথক্লান্তিতে তিন্নি বারান্দায় পাতা মাদুরে গা এলিয়ে দেয়। পরে লক্ষ্ণীমাসির ডাকে যখন ওর ঘুম ভাঙল, তখন দেখল ওর চারপাশে এবাড়ির লোকজন ভিড় জমিয়েছে। কলকাতা থেকে আসার সময় মা তিন্নির ব্যাগে মিষ্টি পাঠিয়েছিল। ব্যাগ খুলে সে মিষ্টি যেই না বার করেছে, অমনি প্রায় কাড়াকাড়ি পড়ে। লক্ষ্ণীমাসি খুব শান্ত। সাত চড়েও রা কাড়ে না। মাসি শুধু বলল, ওরে তোরা কাড়াকাড়ি করিস না সকলে মিলেমিশে খা। সময় কত হল তা কিছুই বুঝতে পারছে না তিন্নি। লম্ফ আর লন্ঠনের আলো ছাড়া চারপাশেই ঘন অন্ধকার। মাসি এতদিন পর বাড়িতে এসেছে। ভাই, ভাইয়ের বউ, তাদের ছেলেমেয়ে, বাবা-মা সকলের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। পর পর মাটির ঘর-দালান। ঘরের ঝাউনি। সকলের আলাদা আলাদা ঘর। ঠাম্মা-দাদু আর তাদের ছোট মেয়ে শান্তি থাকে বাড়ির উত্তরকোণের ছোট ঘরটায়। এ মুহূর্তে শান্তি বাড়িতে নেই। ও গেছে ওর মেজদির বাড়ি। দাদা-বৌদিরা দেখে না, মা-বাবার সংসারে হা-ভাত। তাই প্রায়ই দিদি-জামাইবাবুদের কাছে দিন কয়েকের জন্য মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেয় ঠাম্মা। লক্ষ্ণীবাদে সব ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন বাকি ছোটটা। ওকেও তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় ওর মা। গ্রামবাংলার লোকেরা বিশ্বাস করে, মেয়েদের কলা গাছের বাড়। তাই বছর তেরো ঘুরতে না ঘুরতেই সম্বন্ধ দেখা শুরু করে।শান্তির জন্যও পাত্র খোঁজা শুরু হয়ছে।
ছোট্ট শরীরটাকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এমন একটা কাজ করে বসবে। ছটপট করতে করতে দেহটা একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল। সবশেষ ! তিন্নি যেন পাথর। নড়াচড়া করতে পারছে না।
তারপরের ঘরটাতেই থাকে বড়ো ছেলে কার্তিক। ছেলে-বউরা বাবা-মাকে না দেখলেও নাতি-নাতনিদের সাধ্যমতো ভালোবাসেন বাড়ির প্রবীণ দুই মানুষ। ঠাম্মা উঠোনের এক কোনে মাটির উনোনে খড়-পাতা জাল দিয়ে মুড়ি ভাজছে। একটা বড়ো তোবড়ানো গামলায় পিঁয়াজ কুচি, আর নুন তেল দিয়ে মুড়ি মাখছে লক্ষ্মীমাসি। সিলভারের একটা বাটিতে খানিকটা তুলে নিয়ে প্রথমে দাদুকে দিতে গেল। তা দেখে ঠাম্মা বলল, তোর বাবাকে দিস না। দাঁত নেই চিবোতে পারে না। পিসে না দিলে খেতে পারে না।দূরে বসা দাদু খক খক করে কাসছে। খালি গা, পরনে খাটো ময়লা ধুতি। বুক পাজরের হাড়গুলো কাশির আওয়াজে আরও বেশি ওঠানামা করছে। উনুনের ধোঁয়া লেগে কাশিটা আরও বাড়ল। দাদুর দিকে তাকিয়ে তিন্নির ভাবল, ইস যদি একটু কাশির সিরাপ পেতাম দাদুকে খাইয়ে দিতাম, মা তো ওর ব্যাগে কোনও ওষুধ পাঠায়নি। ওর আফশোস করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। মাসি তিন্নির দিকে মুড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নে খা। তোর একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু কী করব বল, এখানে এর থেকে বেশি কিছু জোগাড় করতে পারব না। তিন্নি একমুঠো মুখে পুরে বলল, দারুন। এত ভালো স্বাদ, আমার খুব ভালো লাগছে। তিন্নি দু-থেকে তিন গাল মুড়ি মুখে চালান করল। পাঁচু, মুনিয়া, টেপি, ছোট্টু মুখের মুড়ি শেষ হতে না হতেই আবার একমুঠ একমুঠ করে খেয়ে ফেলছে। তা দেখে ঠাম্মা বলল, করিস কী তোরা, মেয়েটাকে কয়েক গাল মুড়ি খেতে দে।মাসি বলল, এই তোরা এবার যা। তিন্নি দেখল, টেপি যাওয়ার সময় ওর ছেড়া জামার ভেতর থেকে মুড়ি পড়তে শুরু করেছে।এত মুড়ি ক্ষণিকের মধ্যে শেষ হওয়ার রহস্যটা এবার জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল ওর কাছে।
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রাতের খাবার দিল মাসি। লাল চালের মোটা ভাত আর শাকঘন্ট, সঙ্গে জলের মতো ডাল।খাওয়া শেষ হলে শোবার পালা।খাওয়া শেষ হতেই তিন্নির পেটের ভিতরটা মোচড় দিতে শুরু করেছে। ও মাসিকে বলল, বাথরুমে যাব, লক্ষ্ণীমাসি একটা লম্ফ হাতে নিয়ে বলল, চল। কয়েক পা এগোতেই তিন্নির গা ছমছম করছে। চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশে চাঁদ নেই। গাছগুলোর দিকে তাকাতে মনে হল, কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। মাসির হাতটা আরও শক্ত করে ধরল। মাসি হেসে বলল, ধূর পাগলি ভয় কীসের, আমি তো আছি। এইজন্য তোর মা তোকে আমার সঙ্গে পাঠাতে চাইছিল না। তা তুই তো শুনলি না, জেদ করলি, বললি গ্রাম দেখব। তিন্নি চুপ করে রইল। ব্যাঙেদের গ্যাঙ গ্যাঙানি শোনা যাচ্ছে। ঝিঝি পোকদের আওয়াজও তিন্নি শুনতে পেল।হঠাৎ হাওয়ায় লম্ফটা নিভে গেল। পেচ্ছাব শেষ হতে না হতেই দাঁড়িয়ে পড়ল তিন্নি, চিৎকার করে ডাকল মাসি। কোথায় তুমি? বলে হাতড়ালো। মাসি হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁয়ে আশ্বস্ত করল, এই তো আমি। এরপর মাসির হাতে তিন্নির হাত, দুজন দুজনকে ধরে আস্তে আস্তে বারান্দায় দিকে এগিয়ে আসতেই দেখল ঠাম্মা আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে। তিনজন ঘাটের কাছে দাঁড়াল। ঠাম্মা ঘাটের প্রথম সিঁড়িতে পা দিয়ে একটু নিচু হয়ে দুহাতে জল তুলে নিয়ে তিন্নি আর মাসির দিকে এগিয়ে দিল। অল্প জলেই কোনরকমে হাত-মুখ ধুঁয়ে শুতে গেল ওরা।
শক্ত বিছানা-বালিস, তেল চিট্টা গন্ধে তিন্নির ঘুম আসছে না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।তিন্নি চোখ মেলে দেখল, লক্ষ্মী মাসি ঘুমোচ্ছে। লন্ঠনের মূদু আলোয় মাসির ফর্সা মুখটা ঝকঝক করছে। তিন্নির মনে পড়ল, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই লক্ষ্ণী মাসিকে ওদের বাড়িতে দেখেছে। মাসি তিন্নিকে সন্তানের মতো ভালোবাসে। মা রেগে গিয়ে যখন তিন্নির গায়ে হাত তোলে, মাসি ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। তিন্নি কাঁদলে মাসিও কাঁদে। মাকে বারবার অনুরোধ করে বলে আর মারিস না, ছেলেমানুষ, ভুল করে ফেলেছে। মায়ের মুখেই তিন্নি শুনেছে লক্ষ্ণীমাসির কথা।মাকে অনেক সাহায্য করেছে মাসি। মাসির বাবা-মা বজবজের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে। মাসির বাবার একটাই বোন ছিল। বড়ো সাধ করে কলকাতায় বিয়ে দিয়েছিল বোনের। বিয়ের পর কয়েক বছর কেটে গেলেও বোন সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত। তাই বোনের অনুরোধে দাদা মানে লক্ষ্মীমাসির বাবা নিজের প্রথম সন্তান লক্ষ্মীকে বোনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে লক্ষ্মীমাসি পিসি-পিসেমশাই সঙ্গে শহরে থাকত। খুব আদর-যত্নেই ছোট মেয়েটিকে মানুষ করেছিল তারা। নাম রেখেছিল লক্ষ্মী। কলকাতার যে বাড়িতে লক্ষ্ণীমাসি বড়ো হয়েছে, সে বাড়িতেই তিন্নির মায়েরও ছেলেবেলা কেটেছে। একসময় তিন্নির দিদা মারা যাওয়ার পর তিন্নির মা অসহায় হয়ে পড়ে। লক্ষ্ণীমাসিই তখন তিন্নির মায়ের একমাত্র ভরসা। পিসি-পিসেমশাই লক্ষ্মী মাসির সঙ্গে তিন্নির মা মনাকেও আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর থেকেই তিন্নির মা আর লক্ষ্মীমাসি একই সঙ্গে হাতের কাজ শেখা শুরু করে। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ কঠিন অসুখে পিসেমশাই মারা যান। স্বামীর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারে নি পিসি। একাকিত্ব ঘিরে ধরেছিল তাকে। বছর না ঘুরতে ঘুরতেই কালা-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সেও মারা যায়। লক্ষ্ণীমাসি দেশে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারত। কিন্তু বান্ধবীর কী হবে? এই ভেবে তিন্নির মা অর্থাৎ মনাকে ছেড়ে যায়নি। তারপর থেকে বন্ধুর থেকেও বেশি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছে লক্ষ্ণী। মনার বিয়ে, সংসার, ছোট্ট তিন্নির দেখাশোনা সবতেই লক্ষ্ণী।এসব করতে করতে নিজের বিয়ের ব্যাপারে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ে। যদিও এখনও লক্ষ্মীমাসির জন্য পাত্র খোঁজে তিন্নির মা-বাবা। যতদিন না মাসিকে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারছে মায়ের শান্তি নেই। লক্ষ্মী মাসির মনেও তীব্র যন্ত্রণা। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে দূরে, এখন আবার মনাও ওর সংসার থেকে মাসিকে দূরে পাঠাতে চায়। তিন্নিকে লক্ষ্মীমাসি বলেছে, শ্বশুড় বাড়ি যেতে চায় না সে। বিয়ে করবে না। ছোট তিন্নিরও একমত, ওর সঙ্গেই থাকবে মাসি।এসব ভাবতে ভাবতে কখন তিন্নির চোখ বুজে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে।
# # #
আজ সকাল সকাল তিন্নির ঘুম ভাঙল মোরগের চিৎকারে। চোখ খুলে ও মনে মনে ছেলেবেলায় শেখা রাইমসটা বলল, ‘ককস ক্রো ইন মর্ন টু টেলস আস টু রাইস’।এবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল। পাঁচুর মা মানে বড়োমামি গোবর জল দিয়ে ঘর নেতাচ্ছে। তিন্নি ছুটে নামতে চাইল। মামি ওকে সাবধান করে বলল, আস্তে নামো পড়ে যাবে।তারপরই তো উঠোনে গিয়ে কচিকাচাদের দলে ভিড়ে গিয়ে মাছ দেখছিল।
একটু বেলা গড়িয়েছে। সকালের খাবার পান্তা ভাত। লক্ষ্মীমাসি বলল, কী রে পারবি তো খেতে, তিন্নি ঘাড় নাড়ল। কড়ির থালায় অল্প একমুঠো ভাত আর একথালা করে জল, এইভাবেই পাঁচটি থালায় ভাত বাড়ল মাসি। তিন্নি, পাঁচু, লক্ষ্ণীমাসি আর পাঁচুর বাবা মা, মানে মামা আর মামি খেল। সে যদি কাজ করত, তাহলে সংসারটা অন্যরকম হত। কিন্তু বড়-মামা খ্যাপাটে। কাজে গিয়ে বসে থাকে, আকাশ-বাতাস দেখে। কখনও কখনও আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে পথ চলতে শুরু করে। একবার নাকি মাঠে জন-মজুরের কাজ করতে গিয়ে ঝগড়া বেঁধে গেছিল, মামা রাগ দেখিয়ে কাজ ছেড়ে উঠে আসার সময় নিজের হাতের কাস্তেটা এমন ছুঁড়েছিল যে, পাশের ছেলেটির পা ফুঁটো হয়ে গিয়ে রক্তাক্ত কাণ্ড। মামি খুব শান্ত।কম কথা বলে। ফর্সা, সুন্দর মুখ। চোখ দুটো দেখে মনে হয় খুব ভীতু। বড়োমামার আচরণে মামি অস্থির। ভয় পায় মামা যে কখন রেগে যায় তার কোনও ঠিক নেই। রাগ উঠলেই হাতেই সামনে যা পায় ছুড়ে মারে। পাঁচুও বাবাকে ও খুব ভয় পায়। তাই বাবার থেকে দূরে দূরে থাকে। তিন্নি লক্ষ্য করল, ভাতের থালা নিয়ে মামা জলের মধ্যে হাত চোবাচ্ছে আবার মনে মনে কী বলছে। ও দ্রুত খেয়ে উঠে গেল।
লক্ষ্ণীমাসি বলল, এই ছেলেমেয়েরা তোরা একটু লক্ষ্য রাখিস। আমি বাচ্চাসমেত বড়ো মুরগিটাকে খাঁচার বাইরে ছাড়লাম। ওরে বাইরে না চড়লে তাড়াতাড়ি বড়ো হবে না। ময়না, টিয়া টেপিও ততক্ষণে পান্তা খেয়ে পুকুরে এসেছে থালা মাজতে। তিন্নিকে দেখে ওরা বলল কী রে আয় জলে নামবি। তিন্নি বলল না আমার ভয় করে যদি পড়ে যাই। ঘাটটা খুব পিছল। যখন স্নান করব তখন নামব। টেপি ঠোঁট উল্টে উহু। তিন্নির পিছন ছাড়ছে না পাঁচু। ওর বড়োপিসি মানে লক্ষ্ণী মাসি ওকে বলে রেখেছে তিন্নির দিকে খেয়াল রাখতে। লক্ষ্মীমাসি যেহেতু এ বাড়ির সবথেকে বড়ো মেয়ে, তার উপর শহরে থাকে, তাই মাসির কথা কেউ অমান্য করে না।
পুকুরের পাড় ঘেঁষে চড়ে বেড়াচ্ছে মা মুরগিটা। পেছনে প্রায় আট-দশটা ছানা। ভিজে মাটিতে মুখ ঠুঁকরে মাটির ডেলা ভেঙে দিচ্ছে মা, আর ছানাগুলো পটপট পোকা ধরে মুখে ফেলছে। ছানা গুলোকে দেখেই তিন্নির খুব ভালো লাগল। দারুণ দেখতে হয়েছে। একটা ধরে দে নারে পাঁচু, একটু আদর করি। বছর বারোর কালো মিশমিশে রঙের ছেলেটা চোখ বড়ো করে মাথা নেড়ে বলল না, মুই পারব নি।ওর মা এক্ষুনি তেড়ে এসে ঠোক্কর দেবে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া ওদের মাথার ওপর থেকে বয়ে গেল। পাঁচু বলল, এসে গেছে। তিন্নি এদিক-ওদিক তাকাল। মুখে কথা না বলে, আকাশের দিকে ইঙ্গিত করল পাঁচু। তিন্নি দেখল, মস্ত একটা চিল। একনজরে মুরগির বাচ্চার দিকে তাকিয়ে। পাঁচু তাড়াতাড়ি ঢ্যালা তুলে নিয়ে মরগিগুলোর পেছন পেছন তাড়া দিতে দিতে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিল।
# # #
লক্ষ্ণীমাসি হাতের কাজ শেষ করে তিন্নির কাছে এসে বলল চল, জ্বালানি জোগাড় করে আনি। মায়ের বাজার থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। মাসির হাতে কাস্তে, ঝুড়ি, আর বস্তা। পাঁচু বলল, আমিও যাব পিসি। চল বলেই এগিয়ে গেল ওরা। মাটির শক্ত রাস্তার ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছে। একটু এগিয়ে গিয়েই পরপর দুটো পুকুর। পুকুরে কাজ করছে মেয়েরা। মাসিকে দেখেই একজন বয়স্ক মহিলা বলে উঠল, কী রে লক্ষ্মী না, মাসি বলল হ্যাঁ গো জেঠি। তা কবে এলি তুই? মাসি দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে ওটা কাকে এনেছিস? তোর মেয়ে না কি? কবে বিয়ে করলি, ভাতার কোথায়, আর কবেই বা তুই বিয়োলি? এতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে চলল বয়স্ক মোটা চেহারার বউটা। তারপর পুকুরে ডুব দিয়ে ভেজা গায়ে মাসির দিকে এগিয়ে এল। তিন্নি র চোখ মহিলার দিকে। ভিজে গায়ে মহিলার সারা শরীরের ভাজগুলো উন্মুক্ত। বয়স হলেও শক্তোপোক্ত। মাসি ধুপ করে কী একটা প্রশ্ন করল ওকে। মহিলা বলল, সেই যে মেয়ের কাছে যেবার গেলাম কনকাতায়, তখন তোর সঙ্গে দেখা হল, আজ তা না করে কত্তো দিন কেটে গেছে বল তো। মাসি বলল হ্যাঁ, প্রায় অনেক বছরই হল। এবার মাসির মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো পাত্রদের বড়ো মেয়ে, তা আর কতদিন এমন করে পরের সংসার সামলাবি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, ভাতার ঘরে না গেলে হয়। মাসি— মাথা নীচু করে বলল, সময় হলেই যাব জ্যেঠি। নিজের মনেই মহিলা বলে চলল, কত রূপ ছিল তোর, মেয়েদের বয়স বাড়লে মদ্দদের মেন ধরে না, দত্ত জ্যেঠির কথাখানা মনে রাখিস।
শ্যামলী কেমন আছে জ্যেঠি? মাসি জানতে চাইল। মহিলার চোখে হঠাৎ কষ্ট দেখতে পেল তিন্নি, বলল, আর কী বলল বল, একটাই মেয়ে আমার। তাও আবার কতো দূরে থাকে যে, বাব-মার শরীর খারাপ হলেও জামাই আসতে দেয় না। সবই আমার কপাল। এ বুকে কি কম যন্ত্রণা! বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোল, যেতে যেতেই বলল, আমি গেলুম, সময় পেলে আমাদের বাড়ি আসিস। তিন্নি পেছন ফিরে দেখল মহিলার পেছনের দেহ দুলতে দুলতে এগোচ্ছে। পাঁচু বলল পিসি, এদিকটাতে নয়, চল, ওইদিকে যাই। ওরা পুকুরের বামে দিক ধরে বিশাল কলাখেতে ঢুকে পড়ল। সারি সারি কলা গাছ।
তিন্নিকে মাসি বলল তুই এই গাছের ছায়ায় একটু বোস। আমি আর পাঁচু তাড়াতাড়ি জ্বালানিগুলো বস্তায় পুড়ি।গাছের নীচে বসে তিন্নি দেখল, মাসি কাস্তে দিয়ে কলাগাছের শুকনো পাতা ঝটপট করে কাটছে আর পাঁচু ওগুলো জড়ো করে বস্তায় পুড়ছে।তিন্নির কানে ভেসে এল পাখির ডাক। কান খাড়া করে ও শুনল সে আওয়াজ। বেশ গরম লাগছে। শুকনো পাতায় মাসি আর পাঁচুর পা পড়ে মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে।বিশাল কলা বাগান। কত কাঠবেড়ালি ছোটাছুটি করছে। কাদি কাদি কলা ঝুলছে। তিন্নি মাসিকে কলা কেটে নিতে বলল। লক্ষ্ণী মাসি তাতে রাজি নয়। জানাল গ্রামের লোকেরা খুব সৎ। কেউ কিছু চুরি করে না। তিন্নি ভাবল শহরে কত কুকর্মের কথা শোনা যায়। অথচ এই অজপাড়া গাঁয়ে চুরিই হয় না!
লক্ষ্মীমাসির মুখটা রোদে কেমন তামাটে হয়ে গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পাঁচুর মুখটা শুকিয়ে গেছে। মাসি এক বস্তা কাকালে, অন্যটা পাঁচু মাথায় তুলে নিল। তিন্নি বলল, আমিও নেব, আমায় দাও। পাঁচু বলল, তুই পারবি ? না, হেগে ফেলবি। তিন্নির মুখ ভার হয়ে গেল। মাসি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলল, এই পাঁচু চুপ কর। জানিস আমাদের তিন্নি কত কাজ করে।পাঁচু ঠোঁট উল্টে বলল, হু তা তো দেখতে পারছি। এবার তিন্নি রেগে মাসির থেকে বস্তাটা কেড়ে নিতে গেল। মাসি বলল, দাঁড়া। রাগ করিস না। এখন আমি একটু নিই, বাড়ির সামনাসামনি এসে গেলে তুই নিবি। চল আমরা যাই। মায়ের আসার সময় হয়ে গেল। গাছের ছায়া-মাখা পথ ধরে ওরা বাড়ি ফিরে এল। ফিরতে ফিরতেই দাদুর গলা শুনতে পাচ্ছিল তিন্নি। কাকে যেন দাদু বলছে, এতখানি বেলা হল, কখনও হাড়ি চড়বে উনুনে। বলি কোথায় গেলি সব। নক্ষ্মী ও নক্ষ্মী, বড়োবউ…বুড়ো মানুষটার দিকে কারোর খেয়াল নেই। কোথায় গেলি সব।মাসি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলল, এই তো। তুমি তেল মেখে নাইতে যাও। মা বাজার থেকে এল বলি। দাদু আবার শুরু করল, এই কারনেই তোর মাকি তাড়া দিই। মেয়েমানুষটার ওপর আজকাল সাধে কী আমার রাগ হয়, বলি সকাল সকাল বাজারে যা, কার কথা কে শোনে! মাসি দাদুকে আশ্বস্ত করে বলল, আচ্ছা কাল থেকে মা সকাল সকাল যাবে। মায়েরও তো বয়স হয়েছে বাবা! দাদুকে শান্ত করে মাসি বড়োমামিকে ডাকল।
মামি পুকুরে ছিল, ভাত চড়াবে বলে তাড়াতাড়ি জল আনছে হাড়ি করে। মাথা থেকে হাড়িটা নামিয়ে বলল, দিদি এক্ষুণি হাড়ি চড়াচ্ছি। পাতার জালে তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যাবে।
এরই মধ্যেই বাজার থেকে ঠাম্মা এসে গেছে। রোদে ক্লান্ত ঠাম্মা হাঁফাচ্ছে। মাসি তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস এগিয়ে দিল। মাযের হাত থেকে ব্যাগটা নামিয়ে বড়ো মামির দিকে এগিয়ে দিল। তারপর, আঁচল থেকে টাকা আর খুচরো পয়সা গুলো গুনে জর্দার কৌটোয় ভরে রাখল। মাসি এবার তিন্নিকে বলল, যা এবার চান করে নে। এখুনি রান্না হয়ে গেলে ভাত খেয়ে নিবি। তিন্নি দু পা এগোতেই দেখল, বাড়ির সব বাচ্চা পুকুরে দাপাচ্ছে। রোদ থেকে ফিরে তিন্নিও মন চাইছিল, কখন জলে নামবে। ওদেদ স্নান করা দেখে তিন্নির চোখের সামনে ভেসে উঠল, ওর স্কুলের জানলা দিয়ে দেখা দূরের পুকুরটা। সেখানে ছেলে-মেযেরা জল ছিঁটিয়ে সাঁতার কাটে।পাঁচুও এসে পড়েছে গামছা নিয়ে। বলল চল আজ বাঁশবাগানের ঐ পাড় থেকে দৌড়ে এসে জলে ঝাপ দেব। তিন্নি বলল তুই যা, আমার ভয় করে। আমি বরং ঘাট থেকেই জলে নামি। একটা কলা গাছের আধখানা অংশকে কে জলে ভাসিয়ে তার ওপর ধরে ধরে সাঁতার কাটছে টেপি। ও তো খুব ছোটো। সাঁতারটা এখনও শেখেনি। এইভাবে সাঁতার কাটলে ডোবার ভয় নেই। তিন্নির খুব আনন্দ হচ্ছে, মনে মনে গ্রামের যেমন ছবি এঁকেছিল, ঠিক তেমনই।# # #
জল নিয়ে খেলতে খেলতে আবার ভাবতে শুরু করে দিল তিন্নি। সেই কবে থেকে বায়না ধরেছিল মায়ের কাছে। আসলে ওর স্কুলের বন্ধুরা পুজোর ছুটিতে, গরমের ছুটিতে দেশের বাড়িতে যায়।ফিরে এসে তিন্নিকে কত গল্প করে। তিন্নি মুদ্ধ হয়ে শোনে। এই তো দিন কয়েক আগেই ক্লাসরুমে দিপালী ম্যাম রচনায় গ্রাম বাংলার রূপ লিখতে দিয়েছিল। তিন্নির লেখা পড়ে ম্যাম বলেছিলেন, তিন্নি মা-বাবাকে বলো তোমাকে একবার গ্রামে ঘুরিয়ে আনতে, তাহলে নিজের ভাষায় লিখতে পারবে।
বাড়ি ফিরেই মাকে সেদিন প্রশ্ন করেছিল, সবাই ছুটিতে দেশের বাড়ি যায়, আমরা যাই না কেন?
মা জানিয়েছিল, আমাদের কোনও বাড়িই নেই। আমরা কোথয় যাব?
তিন্নি-কেন মা সবার তো দেশের বাড়ি আছে, আমাদের নেই কেন?
মা-বাসন মাজা ফেলে রেখে কোমরে গোজা আঁচলটা টেনে হাত মুছে নিয়ে ওর স্কুল ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে দিল। তারপর উদাস চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমার বাপের বাড়ির লোকজন বলতে তো শুধু তোর মামা। মামা তো এখন এখানেই থাকে। আর তোমার বাবার বাড়ির আত্মীয়রাও এখন সবাই কলকাতায়।
মুখ ভার করে তিন্নি বলল, তাহলে আমি কি কখনও দেশের বাড়ি দেখতে পাব না?ঠিক আছে এখন রাগারাগি না করে চল, স্নান সেরে ভাত খাবে। মায়ের কথা মতো উঠে গেলেও, গ্রাম দেখার ইচ্ছাটা ওর মনেই থেকে যায়। বিকেলে লক্ষ্মীমাসির সঙ্গে পার্কে গিয়ে বলেছিল, মাসি চলো না, তোমাদের বাড়িতে যাই। শুনেই মাসি যেন কী ভাবল, তারপর বলল, হ্যাঁ, অনেকদিন বাড়ি যাই না। যাব যাব করে হয়ে ওঠেনা। এবার সময় পেলে যাব। তিন্নির তাতে মন ভরল না। ও আবার বায়না ধরল। মাসি উপায় না দেখে বলল, আচ্ছা। তোর বাবা-মাকে বলে দেখি, ওরা রাজি হলে তোকে নিয়ে যাব।
শহরের যানবাহনের কালো ধোঁওয়া, ভিড়-ভাট্টা, ক্লাসরুমের ছেলেমেয়েদের হৈ-হুল্লোড়, দিদিমণির পড়া, বাড়িতে বাবা-মায়ের শাসনে হাঁফিয়ে ওঠেছিল তিন্নি। প্রাণ ভরে অক্সিজেন নিতে চায় ও। গ্রামের মাটির রাস্তা, গাছপালা, পুকুর, খোলা মাঠ হাতঝানি দিয়ে কেবলই ওকে ডাকছে। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল ছোট্ট মেয়েটা। মনখারাপের যন্ত্রণা তখনই কমবে যখন ও গ্রামে যেতে পারবে।
কল্পনাপ্রবণ তিন্নির মন আজ বড় চঞ্চল। স্কুলে এসে কোন মতে প্রথমের ক্লাসগুলো করলেও লাস্ট প্রিয়ডে দিদিমণির পড়া ওর কানে গেল না। বড় ক্লাসরুমটার দক্ষিণ দিকের খোলা জানলাটা দুপুরের দমকা হাওয়ায় দড়াম করে খুলে গেল। ওই দিকে তাকিয়ে তিন্নির উদাসী মন শ্রেণিকক্ষ পেরিয়ে না দেখা কোনও অচেনা গ্রামে পৌঁছে গেল। চোখের সামনে সবুজে ভরা মাঠ।সকালের শিশিরে পা ভিজিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তিন্নি। কেবল ছুটছে। হঠাৎ ঢং ঢং করে তীব্র ঘন্টাধ্বনি আর ছেলেমেয়েদের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেল। অজানা ভালো লাগা। তাড়াতাড়ি বই গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে।
তপনকাকুর রিক্সা চড়ে বাড়িতে ফিরেই মা মা করে ডাকল সুমি। ভেতর থেকে আওয়াজ দিল মা, আসছি। কিছুক্ষণ পর মায়ের বদলে লক্ষ্মী মাসি এসে ওর জুতো-মোজা স্কুল ড্রেস বদলে দিল। ঘরের পোশাক পরতে দিল। তারপর বলল, কাল আমরা দেশে যাচ্ছি। শুনেই মাসিকে জড়িয়ে ধরল তিন্নি।
মায়ের মুখ ভার। মা রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু রাতে খেতে বসে বাবা মাকে বুঝিয়েছিল।বলেছিল, দুটো দিন মনা, তুমি রাগ করো না। তিন্নি যখন যেতে চাইছে ওকে যেতে দাও। লক্ষ্মী তো সঙ্গে থাকছে। মা বলেল, রাগ করছি কি সাধে। লক্ষ্মীদের নিজেদেরই কতোগুলো পেট। ওরা বাবা-মা কষ্ট করে সংসার চালায়। তিন্নি ওখানে গিয়ে থাকতে পারবে! তাই একটু চিন্তা হচ্ছে। লক্ষ্মীর কষ্ট বাড়বে আর কি! ঠিক আছে যখন যেতেই চাইছে যাক। আমি আর বারণ করব না।
তিন্নি খাবার ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
মা ধমকের সুরে বলল, কী করছ এটা? বাবার গায়ে এঁটো লাগিয়ে দিলে তো!
এইবার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার যত আদিখেতা। বাবা, তিন্নিকে বলল, চট করে খেয়ে নে, না হলে মা আবার বকবে।
খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। তীব্র গন্ধে ভরে যাচ্ছে। তিন্নি এখন বাবার কাছে গেলে মা বকবে। শুতে যাওয়ার আগে ও বাবার জন্য অপেক্ষা করল। বাবা মিনিট দশেক পর ঘরে ঢুকল। বিছানা ছেড়ে উঠেই বাবার কোলে চেপে বসল। বাবা-মেয়ের গল্প শুরু। হাত নেড়ে নেড়ে বাবাকে বন্ধুদের গ্রামের গল্প শোনাল।মা-আর মাসি ব্যাগ গোচ্ছাছিল।
পরের দিনই মাসির সঙ্গে তিন্নি রওনা দিয়েছিল।ঝপাৎ করে জলের ঢেউ তিন্নির গায়ে লাগায় ওর সম্মতি ফিরল। তাকিয়ে দেখল পাঁচু ডুব দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। দাপাদাপি, হুড়োহুড়ি করছে ওরা। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল, লক্ষী মাসি হাত নেড়ে তিন্নিকে ডাকছে। চিৎকার করে বলছে, উঠে আয়, না হলে শরীর খারাপ হবে। খুব সাবধানে সিঁড়িতে পা রেখে জল থেকে উঠে গেল তিন্নি। ঠাম্মা একটা বড় চ্যালা কাঠ এনে সবাইকে ধমক দিয়ে শাসাচ্ছে, ‘এবার যদি তোরা না উঠিস, তাহলে আজ তোদেরকে পুকুরে রেখে দেবো ‘। ছেলেমেয়েগুলোর জ্বালায় এই পুকুরে নাইতে পারি না। জল একেবারে ঘোলা করে ছাড়লো। টিয়া, ময়না, টেপি, ছোট্টু, পাঁচু একে একে সবাই জল ছেড়ে উঠে পড়ল।
# # #
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার বেশ ভালই আয়োজন। পুঁইশাকের চচ্চড়ি, ডাল আর চুনো মাছের টক। লক্ষ্মী মাসি বড়ো মামিকে বলেছিল, চুনো মাছের টক রাঁধতে। দাদু খেতে খুব ভালোবাসে। তিন্নিরও বেশ লাগলো। এখানে আসা থেকে নিজেই নিজেকে লক্ষ্য করছে তিন্নি । ঘন ঘন খিদে পাচ্ছে। এক থালা ভাত খেয়ে ফেলেছে। আর বাড়ি থাকলে মা-মাসি দুজনই বকাবকি করে, জোর করে খাইয়ে দেয়। খাওয়া শেষ। দাদু আগেই উঠে পড়েছে।
মাসি ঠাম্মা আর বড় মামি এঁটো হাতে খাওয়া শেষ করে গল্প করছে। পাঁচু মুরগির খাঁচা খুলে দিয়েছে, ছানা গুলো আর ওদের মা থালার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাতগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দূরে বসে দাদু বিড়ি ধরিয়ে সুখ টান দিচ্ছে। বড় মামা ঘরে চলে গেল শুতে। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। তিন্নি ছানাগুলোকে দেখছে আর ভাবছে, একটাকে যদি ধরতে পারতাম। আদর করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু হাত বাড়ালেই সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট ডানাগুলো ঝাপটাচ্ছে। তিন্নির এবার হাই উঠতে শুরু করেছে। ঘুম পাচ্ছে । মাসি বললো, যা ঘরের ভেতর থেকে মাদুর টা নিয়ে আয়। বড় বউয়ের বারান্দাটা বেশ চওড়া। ওখানে মাদুর বিছিয়ে একটু গড়িয়ে নে। তিন্নি বলল, আমরা কি কালই চলে যাব । আর একদিন থাকলে হয়না। কথাটা শুনে ঠাম্মা বলল নক্ষ্মী কাল কেন যাবি। আর কদিন থাক। মাসি বলল, না। আবার আসবো। তিন্নিকে সঙ্গে এনেছি। এবার অভিমান দেখিয়ে ঠাম্মা বলেই দিল, হ্যাঁ ওরাই তোর সব, আমরা কেউ না। মাসিও দমবার পাত্রী নয় বলল তোমার তো কষ্ট হওয়ার কথা নয় মা। তুমিতো ছেলেবেলা থেকেই আমাকে আলাদা করে দিয়েছ। ঠাম্মার চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠল। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সুর নরম করে মাসি বলল কষ্ট পেয়ো না, মা। আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। আবার আসব। এরপর এলে অনেক দিন থাকব।
তিনি দৌঁড়ে মাদুর আনতে ঘরে ঢুকলো। ঘরে পা ফেলতেই কি যেন নরম মত ওর পায়ে ঠেকল। তাকিয়ে দেখল, রক্তাক্ত ছোট্ট দেহটা দূরে ছটফট করছে। একী করল ও। বুকের ভেতর থেকে একটা তীব্র যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে গলায় কাছে উঠে এল। চোখের সামনে সব আবছা হয়ে আসছে। ছোট্ট শরীরটাকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এমন একটা কাজ করে বসবে। ছটপট করতে করতে দেহটা একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল। সবশেষ। একটা ছোট্ট জীবন ওর ভুলে নষ্ট হয়ে গেল। তিন্নি যেন পাথর। নড়াচড়া করতে পারছে না। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে, তা জানে না।
কীরে কখন থেকে ডাকছি, কী করছিস এখানে দাঁড়িয়ে। লক্ষ্মী মাসির বুকে ঝাঁপিয়ে হাউ করে কেঁদে ফেলল তিন্নি। চিৎকার করে কী যেন বলতে চাইল, বলতে পারল না, দম আটকে যাচ্ছে, বাকরুদ্ধ অবস্থা।
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34