Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুলাই ১০, ২০২২

উলুখাগড়া

বকের পালকের মতো শুভ্র শাদা ভাতের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ির মানুষগুলো তাকিয়ে তেঁতলের জন্য। অথচ বারবার কে যেন তাকে পেছন থেকে টেনে-টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

আশরাফ উদ্দীন আহমদ
উলুখাগড়া

অলঙ্করণ: দেব সরকার

বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা পায়ে চলা মাটির রাস্তা ধরে তেঁতলে আসছে। জামা-কাপড়গুলো লেপ্টে আছে শরীরে। টানা বর্ষার বর্ষণ চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে। পানিতে ভিজে শরীর যেমন, তেমনি মাটি ভিজে হালুয়া। তেঁতলের শরীর কাঁপছে, কিন্তু তারপরও সে হাঁটছে। কারণ তাকে আরো অনেক দূরে যেতে হবে। মাথার ওপর আকাশ, বিজলীর চমকানি।

রাত্রি বাড়ছে। চারদিক অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই, নিস্তব্ধ নিঝুম পৃথিবী। পায়ের তলে যে মাটি তাতে পিছলে যেতে আর কতোক্ষণ ! কিন্তু সে শক্ত-শক্ত পায়ে হাঁটছে। মনে মনে ভাবে একটা সুখটান দিতে পারলে বেশ ভালো হতো, শরীর একটু চাঙ্গা হতো। কিন্তু কোথায় বিড়ি আর দেশলাইট! কয়েকটা টাকা ছিলো তা তো শেষ হয়েছে থলের জিনিস কিনতেই। কেজি খানিক চাল আর আলু-পেঁয়াজ-পটল-লবনে পকেট উজার। এটুক নিয়েই তেঁতলে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাড়িতে বউ-ছেলে-মেয়ে আর মা আছে তার অপেক্ষায় বসে। বকের পালকের মতো শুভ্র শাদা ভাতের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ির মানুষগুলো তাকিয়ে তেঁতলের জন্য। অথচ সে যেতে পারছে না। বারবার কে যেন পেছন থেকে টেনে-টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে যেতেই হবে আরো অনেকটা দূর। এতো বৃষ্টি-এতো বৃষ্টি তেঁতলে জীবনে দেখেনি। মানুষজন এভাবে কতোদিন বা বাঁচবে। আধপেটা খেয়ে না খেয়ে। বৃষ্টি তো ঝরেই যাচ্ছে না থামার কসম দিয়ে। মোষের মতো আবলুশ কালো মেঘ আকাশ জুড়ে বসে আছে সেঁজেগুজে। কবে যে সড়বে নড়বে তার কোনো ঠিকানা নেই। অবিরাম ঝরে যাচ্ছে বর্ষার ধারা।

তেঁতলে ফিরছে মাঝেরদিয়ার হাট থেকে। বসন্তপুরের রাঁধাপ্রসাদ বাবুর চালের আড়তে (কয়াল) মাল ওজনের কাজ করতো সে। মাঝেরদিয়ার হাটের আড়তে গিয়েও সেই একই অবস্থা। রাঁধাপ্রসাদ বলেই বসলো, কাজ দেবো কি? টানা বৃষ্টিতে নাকাল সাতগাঁয়ের মানুষ, বেচাকেনা লাটে উঠেছে…

তেঁতলে অনেক কেঁদে কেটে হাতে পায়ে ধরে, একটা কাজের জন্য। অবশেষে কয়েকটা টাকা ধরিয়ে জানালো, যা বাবা, সামনের সপ্তাহে আসিস বৃষ্টি কমলে…

তারপর মাঝেরদিয়ার হাটের যার কাছে কাজের জন্য গেছে, দূর-দূর করে তাড়িয়েছে সবাই। সত্যিই কাজের বড় অভাব। হাটের মানুষগুলো যেন রাতারাতি কেমন পর হয়ে গেছে, কারো মনে রহম নেই। অথচ সে বে-রহম হতে পারে না। একটা কিছু করতে হবে তাকে। জীবনের জন্য জীবনযুদ্ধ হয়তো একেই বলে ! মন বড় বিষিয়ে ওঠে, রাস্তায় মানুষ নেই। ঘন-ঘন বিজলী চমকাচ্ছে, দূরে কোথাও কড়াৎ কড়াৎ করে বিজলী পড়ছে কাস্তের মতো। তেঁতলের চোখ ঝলসে ওঠে, সে কোথায় যাবে, যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। সবাই মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, কিন্তু তার ঘরে যে এতোগুলো মুখ। বাঁশঝাড়ের ভেতর বেশ ঘন অন্ধকার। আকাশটাকে সম্পূর্ণ দেখা না গেলেও অনুভবে বুঝতে পারে, এ’ বৃষ্টি সহজে থামবে না।

এতো ডাক ভেসে আসছে, তাহলে তো অভাব থাকবে না তার সংসারে। ব্যাঙের চাহিদা আছে বিদেশে।উড়োজাহাজে চড়ে ব্যাঙ যায় সাহেবদের দেশে…

চারদিকে যেমন বিশ্রী ঘুঁটঘুঁটে কালো অন্ধকার, তেমনি ব্যাঙের ডাক। কতো রকম ব্যাঙের ডাক বোঝা মুশকিল। তবে তেঁতলের মনে হয়, ব্যাঙগুলো তার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। ব্যাঙের একটানা শব্দ শুনে তার মন চকমকিয়ে ওঠে। বাজারেও তো এর দাম আকাশ ছোঁয়া। মহেষখালির আদমব্যাপারী রথিন বৈদ্য একবার বলেছিলো, ব্যাঙ রপ্তানি করে এখন ভালো আছি, কি পয়সা কাকে বলে দেখছি।

তেঁতলে বলেছিলো, কেনো তুমি আদম ব্যবসা ছেড়ে ব্যাঙ রপ্তানি করতে এলে…

— সেটাই তো মূল কথা ভায়া ! পুঁজি ভাই পুঁজি।

— খুলে বলো তো কি বলতে চাও!

— আরে ভায়া ব্যাঙ রপ্তানি করে এ’ বেলা পুঁজি বাড়িয়ে নেয়। তুমি পারলে আসতে পারো?

রথীন বৈদ্যের কথা অকস্মাৎ মনে হতেই তেঁতলের চোখ আকাশের বিদ্যুৎ চমকানির মতো জ্বলে ওঠে। চারদিকে এতো ব্যাঙ, এতো ডাক ভেসে আসছে, তাহলে তো অভাব থাকবে না তার সংসারে। বর্ষায় কাজ নেই তো ! ব্যাঙের চাহিদা আছে দেশ বিদেশে। মুহূর্তে নিজের পরনের লুঙিটার কথা মনে হয়। লুঙির ভেতর বড় হাফপ্যান্ট আছে, তাহলে লুঙি খুলতে সমস্যা কোথায়। তারপর অন্ধকার মাইলকে মাইল। লোকজনের কোনো মাথামুন্ডু নেই। লুঙির একদিকে বেশ করে বেঁধে ফেলে, তাহলে বিশাল একটা বস্তা মতো হয়ে গেলো। শুরু হলো খপাখপ ব্যাঙ ধরার পালা। সামনে-পেছনে যেভাবে পারছে ধরে ফেলছে বিভিন্ন সাইজের ব্যাঙ। বাঁশের একটা কঞ্চি ভেঙে নিয়েছে, তা বেশ কাজও দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সারারাত্রি ব্যাঙ ধরে ঢাই করে ফেলবে। সকাল হলে চলে যাবে রথীনের আড়তে। ওর ব্যাঙ দেখে নিশ্চয় খুব খুশি হবে। রথীনই বলেছে, এই ব্যাঙ দেশের বড় বড় রেস্তোয়া-ফাষ্ট ফুর্ড কর্ণার-কমিউনিটি সেন্টারে যায়। তেঁতলে শুনে আশ্চর্য না হলেও ভেবেছে, নিশ্চয় বিদেশীরা খায়। ওরা তো কতো কিছুই না খায়, ব্যাঙও একটা মুখরোচক খাবার হয়তো ! রথীন আরো জানিয়েছে, বিদেশেও চলে যায় মোটা ডলারের মূল্যে। উড়োজাহাজে চড়ে ব্যাঙ যায় সাহেবদের দেশে…হা হা হা হা…

ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ডোমনী কালীর ঘরটা বুঝি খালিই থাকে আজকাল। ওর কালো ভুষকো শরীরটার ছবি আচমকা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাইরি কি শরীরের কি কারুকাজ ! ঘরের বউ নমিতা তো পানসে হয়ে গেছে এখন।

তেঁতলের মনে সুখ আর মুখে কেবলই হাসি। এবার বর্ষায় তার কপাল খুলে গেলো তাহলে।

বিমল বয়াতি সেবার বলেছিলো, টাকা হাতে থাকলে সুখ-আনন্দ সবই থাকে, আর গান কন্ঠে থাকলে ভালোবাসার নদী বয়ে যায়!

আগামীদিনের সুখের ছবি মনে ভেবে তেঁতলের মনে অন্যরকম আনন্দ উঁকি দেয়।

রথীন বৈদ্যের আর বিমল বয়াতির কথাগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে। টাকা মানেই সুখ টাকা মানেই শান্তি। টাকা ছাড়া সবই অন্ধকার। কালো আধাঁর আর অমানিশা। সমস্ত বৃষ্টির রাত্রি যদি ব্যাঙ ধরে লুঙির বস্তা ভরিয়ে ফেলতে পারে তো মন্দ নয়। সকাল হলেই টাকা হাতে এসে যাবে। আর টাকা এলে তেঁতলেকে পায় কে ?

কতোদিন মুখের স্বাদটা পাল্টানো হয়নি। এবার চেখে দেখতে যেতে পারবে, সেজন্য গোবিন্দপুরের মাতারী ডোমনী কালীর কাছে যেতেই হবে। কতোদিন হলো ওর শরীরের উষ্ণ-উষ্ণ উম পায়নি তেঁতলে। টাকা থাকলে মন যেন পাখি হয়ে যায়। পাখি হলে সে তো দিকবিদিক ছুটে যাবেই যাবে। তখন তাকে কে আর আটকে রাখে ? ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ডোমনী কালীর ঘরটা বুঝি খালিই থাকে আজকাল। ওর কালো ভুষকো শরীরটার ছবি আচমকা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাইরি কি শরীরের কি কারুকাজ ! ঘরের বউ নমিতা তো পানসে হয়ে গেছে এখন। আর ভালো লাগে না। দু’ তিনটে ছেলে মেয়ের মা হলে থাকেটা কি ! শরীরের কোনো গড়ন নেই আর, চোখেও সেই ঠমক নেই, আকর্ষণ করতে পারে না আর নমিতা। শুধুই যেন গোবরের নোদার বস্তা। হাতে টাকা এলে গোবিন্দপুরের মাতারীর দরোজায় যাবেই তেঁতলে। মন বড় উছাটন হয়ে ওঠে, হাজার ঝাক্কি-ঝামেলা হলেও যাবে।

এদিকে নধর ব্যাঙগুলো বেশ বস্তার মধ্যে খলবল করছে। একসঙ্গে প্রতিবাদের স্বরে ডাকছে, কোরাস সঙ্গীতের মতো মনে হলেও তেঁতলের সেদিকে কর্ণপাত নেই। তার সামনে টাকার হাতছানি ! রাঁধাপ্রসাদ বাবুর চালের আড়তে কেনো সে পালাদারের কাজ করবে, আর কেনোই বা মানুষের দোরে-দোরে কাজ-কাজ চেয়ে ফ্যাঁ-ফ্যাঁ করে মরবে। ব্যাঙ বিক্রির টাকা হাতে এলেই সে নিজেই শেঠ হয়ে যাবে, তখন চোখের আলো উজ্জ্বল হবে। ঠোঁটে বিড়ির বদলে দোচালা সিগারেট স্থান পাবে। আহা… আহা— আহা…

সুখ-সুখ একটা অনুভূতি বুকের মধ্যে মাথা খুঁটে মরছে। সুখ যে আসবে এবং সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে তা তেঁতলে অনুধাবণ করতে পারছে। একসময় রাত্রি প্রায় শেষের দিকে চলে যায়। বস্তাটা পাহাড় সমান হয়ে গেছে এরমধ্যে। একরাত্রেই এতো আশা করতে পারেনি। কিন্তু জিনিসগুলো এখন কিভাবে নিয়ে যাবে। ভাবতেই মাথাটা খুলে গেলো।

লালটু গতবছর বিয়ে করে যৌতুক হিসেবে যে ভ্যান রিকসাখানা পেয়েছে, সেটাই এখন তার ভরসা। শীত-শীত একটু শিহরণ খেলে যায়। দূরের গাছ-গাছালি কেমন বোবা স্থির। সমস্ত রাত্রির বর্ষার বর্ষণে কেমন শীতল করেছে মন। হালকা হাওয়া খেলে যায় দিকবিদিক। মুহূর্তে তেঁতলে মনস্থির করে এক দৌঁড়ে সওদাপাতি বাড়িতে দিয়ে, দক্ষিণপাড়ায় ছুটে লালটুর কাছ থেকে ভ্যানরিকসাটা নিয়ে আসার। বস্তার মালগুলো যে কোনোভাবে রথীনের আড়তে পৌঁছে দিতে পারলেই খেল খতম ! জাহানারাবাদ পার হলে হাজিপাড়া-আরামবাগ-মাটিচাঁপাদীঘি-সোনামুখীতলা তারপর ময়নাগড়, আরেকটু বামেই নাকবরাবর এনায়েতপুর। রথীনের আড়ত তো একেবারে এনায়েতপুরের শেষ সীমানায় গাঙপাড়ার মাটি ছুঁয়ে। ওর ব্যবসা দিনেদিন বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। তারপরও একটা কথা মনের মধ্যে বড় বিষ ছড়াচ্ছে, কতোদিন আগে রথীনের সঙ্গে দেখা, মাঝে তো অনেকদিন দেখা হয়নি। ঘাঘড়ডাঙায় শ্বশুরবাড়ি, ওখানেও নাকি আড়ত আছে, কিন্তু এখন কোথায় থাকছে কে জানে! এতোগুলো মাল নিয়ে কোথায় যাবে, এনায়েতপুরের ঠিকানা তেঁতলের জানা, কিন্তু যদি শালা ঘাঘড়ডাঙায় থাকে, তো সেখানকার হদিশ পাওয়া দুস্কর। তারপরও তেঁতলে রাখে হরি তো মারে কে শক্তি নিয়ে ছুটে যায় লালটুর বাড়ির দিকে।

এতো সহজে লালটু রিকসাখানা দেবে ভাবেনি তেঁতলে। হয়তো রাত্রে বউয়ের পাশে ভালো ঘুম হয়েছে। আর ঘুম যদি ভালো হয় তো সারাদিন তার মন আরো ভালো হয়। সে সঙ্গে বউয়ের আদর-সোহাগ মাত্রাতিরিক্ত পেয়ে যায় তখন তো পোয়াবারো। লালটুর কাছ থেকে ভ্যানরিকসা নিয়ে লুঙির বস্তাটা অনেক কষ্টে তুলে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর ঘন্টি বাজাতে-বাজাতে তেঁতলে প্যাডেল মারে। জল কাদায় ভ্যানের চাকা মাটির মধ্যে সিঁধিয়ে গেলেও তেঁতলের শক্তির কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। তারপর গড়গড়িয়ে চলতে থাকে। কোথাও গিয়ে আর আটকে থাকে না। মাতারী ডোমনী কালীর মতো ছলাকলায় লালটুর ভ্যান চলছে তেঁতলের কথা মতো। কখনো চলতে-চলতে থামে আবার যেতে থাকে। বৃষ্টি এখনো টিপটিপিয়ে ঝরছে। মাটির রাস্তা হলেও বেশ শক্ত। তবে ঘাসের ওপর দিয়ে যেতে ভালো লাগে। ঘুঘুডাঙার ভেতর দিয়েই শেষাবধি যেতে হয়। এদিক দিয়ে যাওয়া কঠিন। একটু ঘুর ঘুর লাগে। তবে গোবিন্দপুরের মাতারী ডোমনী কালীর বাড়ির চৌঁহদ্দি ধরে যাওয়া যাবে। মনে একটু সুখ সুখ বাতাস বইবে তখন। বুকে গরম নিঃশ্বাস তোলপার করে ওঠে মুহূর্তে। কালীর ওমন পিচকালো শরীর বড় রোশরাই ছড়ায় মনে প্রাণে। ওমন লদলদে শরীর দলাইমলাই করতে কার না সাধ জাগে। বুকের ভেতর বাঁশী সুরে বেসুরে ডেকে ওঠে। নাকি পায়রার মতো বাকবাকুম-বাকবাকুম অহনিশি ডাক শোনা যায়। গোবিন্দপুরের সড়কে ভ্যান ঢুকতেই মনটা কেমন চনমনিয়ে ওঠে। শরীরে কঠিন তাগদ ফিরে আসে। কালী-কালী একটা গন্ধ তেঁতলের সারা মনে-শরীরে মেখে-মেখে যায়। আজই কি কালীর কাছে আসবে ? হাতে টাকা এলে আজই কি আর কালই, গুবড়ে পোকার মতো ইচ্ছেটাকে বের করে আনতে আর কতো দেরি।

ভ্যানরিকসা সাঁ-সাঁ-সাঁ টানছে শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে তেঁতলে। একে একে গ্রামগুলো পেরিয়ে ছুটছে তেঁতলে তার সঠিক গন্তব্যে। মাথার মধ্যে হাজারো স্বপ্নের ঢেঁকি পারা দিচ্ছে। আজকের মতো এতোখানি সুখ কতোদিন পায়নি। মাতাল হাওয়ার মতো সুখ-সুখ স্বপ্নগুলো ছুটে আসতে চাইছে। নমিতার চুপসে যাওয়া দুধ দুটো বড় বেখাপ্পা লাগে আজকাল, হাড্ডিসার শরীর। কোনো নতুনত্ব নেই, খেয়ে না খেয়ে ওমন হয়েছে বোঝে, কিন্তু তার চাহিদা তো মেটে না। মনের চাহিদা শারীরিক চাহিদাকে হার মানায়, তেঁতলে তাই এখন কালীর ভরাট তাল-তাল দুধ দুটোর কল্পনা করে। কি সুখ কি সুখ আর কি আনন্দ শিহরণ !

এনায়েতপুর বাজারে ঢুকে তেঁতলের মনটা আরো ভালো হয়ে যায়। ওদিকটা শ্মশান। গতরাত্রে কোনো মরা আধ পোড়া অবস্থায় রেখে গেছে, কেমন টাটকা মাংস পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বমি-বমি ভাবটা বুক ঠেলে এলেও রাত্রের রোমাঞ্চকর প্রতীক্ষার কথা ভেবে মন ভালো হয়। এনায়েতপুরের শেষমাথায় এসে রথীন বৈদ্যের আড়তের সন্ধান করতে থাকে। একসময় দুরত্ব বজায় রেখে একজন জানায়, ওম্মা জানো না বুঝি, রথীনকে পুলিশে ধরেছিলো গো !

তেঁতলের দৃষ্টিতে বিস্ময়! সে কি পুলিশে? তা অপরাধটা কি…

— অপরাধ, তা ঢের অপরাধ গো!

গ্রামদেশে হরহামেশা চুরি-চামারি লেগেই থাকে। অথবা খুন জখম মামলা-মকদ্দমার তো শেষ নেই। নারীঘটিত বিষয়ও তো আছে ওদিকে। কার কপালে কি এসে জোটে বোঝা বড় শক্ত!

— তা কিসের জন্য পুলিশ—

— পুলিশের দোষ কোথায় বলো দিকি ! ব্যাঙ ধরা, রপ্তানি করা নিষেধ সরকার করেছে, আর ওই ঢেমনা কি না…

— কি কি বললে ব্যাঙ ধরা নিষেধ করেছে সরকার, তা কবে করেছে…

— সে অনেকদিন আগের আইন। চুরি-চামারি করে এদিকে কেউ কেউ ব্যাঙ ধরে বিক্রি করতো।

অকস্মাৎ লোকটার চোখ যায় তেঁতলের লুঙি বস্তা ভর্তি কোলা ব্যাঙ সোনা ব্যাঙের দিকে। তাতেই লোকটার চোখ ছানাবড়া! মুখে কোনো রা নেই। কি বলবে তাও বলতে পারে না। আচম্বি লোকটা চিৎকারে বলে ওঠে, সর্বনাশ করেছো বাবা ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও…

— ছেড়ে দেবো, কেনো ছেড়ে দেবো!

— নিষিদ্ধ জিনিস বিক্রি করছো, আবার বলছো কেনো ছেড়ে দেবো…. পুলিশে ধরলে বত্রিশ ঘাঁ’ য়ের দাঁত দেখতে পাবে।

— রথীন বৈদ্য কোথায়, ও যে আমাকে…

— রথীন জেলে তুমিও জেলে যেতে না চাইলে ব্যাঙগুলো ছেড়ে দাও…

হঠাৎ তেঁতলে কিছু বোঝার আগেই ব্যাঙের লুঙি বস্তার মুখ খুলে যায়। ব্যাঙগুলো হুটোপুটি করে সমস্বরে ডাকতে-ডাকতে যেন মিছিল নিয়ে দিকবিদিক ছোটে। মুহূর্তে সবাই বস্তার ভেতর থেকে বের হয়। ভ্যানরিকসা থেকে নেমে ওদিকের বাঁশঝাড়ের শ্মশানের ডোবাটায় নেমে যায়। কেউ-কেউ ভাঙা জংলা সাবেকি আমলের বাড়িটার ভেতর ঢুকে ঘ্যাঁনর-ঘ্যাঁনর ডাকে। তেঁতলে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে। নিয়মমাফিক ওরা নিজের ডেরা ভুলে অন্য জায়গায় এখন আস্তানা গাড়বে। তেঁতলের চোখে ধরা পড়ে, গোবিন্দপুরের মাতারী ডোমনী কালী ছুটে পালাচ্ছে, তাল-তাল দুধ আর চওড়া নিতম্ব দুলিয়ে অনেক দূরে কোথায় যাচ্ছে। কালো শ্যামলা মাগীর পিঠ-কোমর আর শিরদাঁড় উচুঁ করে গ্রীবা ঘুরিয়ে। যাওয়ার ভঙ্গিটাই তেঁতলেকে সেদিন ঝুলন উৎসবে পাগল করেছিলো। তারপর একদিন নাকি দুদিন গিয়েছিলো ওর বিছানায়। তারপর আর যাওয়া হয়নি। নিজের সঙ্গে নিজেই চরম যুদ্ধে মেতে ওঠে। আর কি যাওয়া হবে না…যাওয়া হবে না… হবে না যাওয়া… মন বলে কালী… কালী রে… তোকেও আমি হারিয়ে ফেলেছি কালী– কালী রে… আমার স্বপ্নের কালী…

 

♦♦♦♦–♦♦♦♦

লেখক পরিচিতি: গল্পকার বাংলাদেশের রাজশাহীর বাসিন্দা। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গল্পগ্রন্থ


গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । কোন মিল অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।


 

 


❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!