“ইন্ডিয়া” ব্লক কী দানা বাঁধবে বাংলায় ? রসায়ন জটিল, এখনো পর্যন্ত তার চিত্ররূপ ধোঁয়াটে।রাজনীতির অঙ্ক এখনো পর্যন্ত যে পথে চলছে, সেখানে আশাপ্রদ ফল দুষ্কর, বরং উল্টো ফলের চিহ্নই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে শুরু থেকে এই বিষয়টা জেনেই দেশজুড়ে “ইন্ডিয়া” ব্লক তৈরি হয়েছিল কি? দিল্লিতে যে সীতারাম ইয়েচুরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেশ থেকে বিজেপিকে হঠাতে একজোট হচ্ছেন, সেই সীতারাম ইয়েচুরির দল বাংলায় কোনও ভাবেই তৃণমূলের হাত ধরে বিজেপি বিরোধিতায় নামবে না। এই কথা সীতারাম ইয়েচুরি বহুবার স্পষ্ট করে বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম নিজেও বহুবার বলেছেন তাই সিপিএম-এর ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি। সিপিএম বারবার বলছে, বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি তাদের কাছে সমান ভাবে রাজনৈতিক শত্রু। ফলে ভেঙে  যাওয়া কাচের টুকরোর মতোই অবস্থায় রয়েছে বাংলার “ইন্ডিয়া” ব্লক।যাকে জোড়া লাগানো কার্যত অসম্ভব।

“ইন্ডিয়া” ব্লক যে বাংলায় পরিণতি পাবে না সেটা সিপিএম, তৃণমূল সবার কথায় স্পষ্ট। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই বিষয় স্পষ্ট জানিয়েছেন, “বিবিসি টেলিভিশনের ইন্টারভিউতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার বলেছেন আরএসএস-বিজেপি তাদের ন্যাচারাল এলায়েন। তাই আমরা স্পষ্ট বলছি যে দলের ন্যাচারাল এলায়েন বিজেপি, সেই দলের সঙ্গে সিপিএমের কোনও সংশ্রব থাকবে না। আর তার হয়ে যারা খেলবে তাদের সঙ্গেও সিপিএম-এর কোনও সংশ্রব থাকবে না। বিজেপির মতো একটি দল যারা ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনকারী, যারা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের সঙ্গে সিপিএম বা কোনও বামপন্থী দল সংশ্রব রাখতে পারে না।”

মহম্মদ সেলিমের কথাই প্রমাণ করে দিচ্ছে বাংলায় কোনও ভাবেই সিপিএম নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাবে না। সঙ্গে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস যদি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জোটের দিকে তাকিয়ে বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে মাথা নিচু করে আসন সমঝোতায় যায় তাহলে হাত ও কাস্তে হাতুড়ির বন্ধনও ক্রমশও আলগা হবে। সেলিম বলেছেন, “বিজেপির সঙ্গে যারা মিলেমিশে চলতে পারে এবং সেই রকম দলের সঙ্গে যারা হাত মেলাবে তাদের সঙ্গেও সিপিএম এবং যে কোনও বামপন্থী দল, যারা ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে তারা কোনও সংশ্রব রাখবে না।” সেলিমের এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে কংগ্রেস যদি বাংলায় তৃণমূলের হাত ধরে তাহলে সিপিএম কংগ্রেসের হাত ছাড়তেও দ্বিধা করবে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস কি করবে ? প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতা যিনি কংগ্রেস হাই কমান্ডের সঙ্গে সদ্য শেষ হওয়া বৈঠকে ছিলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই কংগ্রেস নেতা বলেছেন, “অধীর রঞ্জন চৌধুরী কংগ্রেস হাই কমান্ডকে বলেছেন বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে ৬ থেকে ৮টি আসন ছাড়লেই কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গে বাংলায় জোটে যেতে প্রস্তুত।” বাংলার হাত শিবিরে অভ্যন্তরীন গুঞ্জন, “আদর্শ, নীতির চাইতে এখন বাংলার কংগ্রেস নেতাদের একটা অংশের ভাবনা হয়ে গেছে কি ভাবে নিজের আসনে জিতে আবার গিয়ে দিল্লির সংসদে বসা যায়। সে ক্ষেত্রে আগামী ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসের যে ভিটেছাড়া অবস্থা হবে সেই কথা ভাবার মতো কংগ্রেস নেতা বাংলায় এখন কোথায়?”

একটু পিছনের দিকে তাকালে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস একসঙ্গে জোট করে বাংলায় তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে কোনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। সেবারের নির্বাচনের ফলে দেখা গিয়েছিল তৃণমূল ২২টি, বিজেপি ১৯টি, কংগ্রেস ২টি আসন পেয়েছে। আর নিপাট শূন্যে পরিণত হয়েছিল সিপিএম। আমরা যদি ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখি তাহলে দেখতে পাব তৃণমূল ৩৪টি, কংগ্রেস ৪টি, বাম ২টি এবং বিজেপি পেয়েছিল ২টি আসন। ২০০৯ -এর লোকসভা নির্বাচনের ফলে আমরা দেখেছিলাম তৃণমূল পেয়েছিল ১৯টি আসন, বামেরা পেয়েছিল ১৫টি আসন, কংগ্রেস পেয়েছিল ৭টি আসন এবং বিজেপি পেয়েছিল ১টি আসন। এই ফলাফল  পর্যালোচনা করলে একটি চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ২০০৯ -এর তুলনায় ২০১৪ তে বাংলায় লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের আসন বেড়েছিল। তবে ২০১৯-এর লোকসভায় তৃণমূল ২০০৯ এর তুলনায় বেশি আসন পেলেও ২০১৪-র তুলনায় তাদের আসন কমে গিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব কি গত লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বাম-কংগ্রেসের করুন পরিণতির কথা স্মরণ করে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় তৃণমূলের হাত ধরে নিজেদের শক্তি আর একটু বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে? কংগ্রেস কি সারা দেশে নিজেদের বিজেপি বিরোধী প্রমাণের জন্য তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করে কমপক্ষে ২টি এবং সবচেয়ে বেশি হলে ৬টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে? কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কংগ্রেসকে তাঁর দল ২টি আসন ছাড়তে পারে। তার থেকে কংগ্রেস চাইলে ১টি আসন বামেদের দিলে তাতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তৃণমূলের বাংলার নেতারা সর্বত্র বলছেন, বাংলার কংগ্রেসের অবস্থা “গাঁয় মানে না আপনি মোড়ল” এর মতো। কাজেই এই পরিস্থিতিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর দাবি মেনে ৮টি আসন তৃণমূল যে কংগ্রেসকে বাংলায় ছাড়বেই তার কোনও নিশ্চয়তা এখনো পর্যন্ত নেই। যদিও সংখ্যালঘু ভোটার একটা অংশ এখনো কংগ্রেসের হাতে রয়েছে। তৃণমূল সেই দিকে তাকিয়ে যদি কংগ্রেসকে ২টির বেশি আসন ছাড়ে, আর হাই কমান্ডার নির্দেশে গুটিগুটি পায়ে সব বিপ্লব ছেড়ে বাংলার কংগ্রেস মমতা-অভিষেকের সঙ্গেই কাজ করে। তাতে যদি এই পরিস্থিতি হয়, যে অধীর রঞ্জন চৌধুরী ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচার করছেন তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে বহরমপুর লোকসভা আসনে জিততে হলে তৃণমূলের সঙ্গে আপোষ করা ছাড়া আর অন্য পথ খোলা নেই। কারণ অধীর রঞ্জন চৌধুরী নিজেও জানেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই হাস শিবির। তাদের হয় তৃণমূল না হলে বামেদের হাত ধরতেই হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে অধীর রঞ্জন বা বাংলার কংগ্রেস যদি লোকসভা নির্বাচনে সত্যিই তৃণমূলের সঙ্গে হাত ধরে নির্বাচনে নামে তাহলে এতদিন কংগ্রেসের তৃণমূল বিরোধিতা মিথ্যা হয়ে যাবে। যার ফলটা ১০০ শতাংশ ভোগ করবে তৃণমূল। জনসমক্ষে তৃণমূল বলতে পারবে, যারা তাদের চোর বলে প্রচার চালাত সেই কংগ্রেস কি ভাবে তৃণমূলের সঙ্গে জোটে আসতে পারল ?

এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। তিনি প্রথম থেকেই বলে আসছেন বাংলায় তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে পারেন বিজেপিকে পরাজিত করার স্বার্থে। তবে কোনও ভাবেই ২টির বেশি আসন তিনি কংগ্রেসকে দিতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কংগ্রেসের তৃণমূলের হাত বাংলায় ধরতে হলে তৃণমূলের শর্ত মেনেই ধরতে হবে। তাছাড়া ২০১৯-এর তুলনায় এই মুহূর্তে তৃণমূলের রাজনীতির, সামাজিক অবস্থান খানিকটা নড়বড়ে। কাজেই এই অবস্থায় যদি কংগ্রেসের সমর্থন তৃণমূল পায়, আর যদি ২ থেকে ৬টি আসন দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে রফা হয়ে যায়, তাহলে বাংলা ৩৬ থেকে ৪০টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে লড়তে পারবে। সেই লড়াইয়ে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারবে তৃণমূল। ফলে বঙ্গ রাজনীতির সাপলুডু খেলায় এক চালে তৃণমূল সাপকে যেমন মারতে পারবে লাঠিও তেমন ভাঙবে না।

তবে এরপর, আগামী ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থা বাংলায় অতি করুন যে হয়ে পর্বে তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। কংগ্রেস সূত্রে খবর অধীর রঞ্জন চৌধুরী কংগ্রেস হাই কমান্ডকে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় তৃণমূল তাদের ৬টি থেকে ৮টি আসন ছাড়লেই তারা সিপিএম-এর হাত ছেড়ে তৃণমূলের হাত ধরতে প্রস্তুত। তবে এই যদি হয় তাহলে ২০২৬-এর বিধানসভায় সিপিএম-এর দিকে হাত বাড়িয়ে কংগ্রেস হয়তো আর তাদের হাত ধরতে পারবে না। তাই বলা যায় আজ বহরমপুর, রায়গঞ্জ, মালদহ লোকসভা আসন জেতার জন্য বাংলা থেকে চিরতরে কংগ্রেস দলের অস্তিত্ব তুলে দেওয়ার এই খেলায় বাংলা কংগ্রেস নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত সায় দেবেন কি না।

এই পরিস্থিতি যদি হয় তাহলে সিপিএম-এর কিছু হারাবার নেই। তারা এখনও শূন্য, একক শক্তিতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে তারা যদি শূন্যও হয়ে যায় তাহলেও তাদের সংসদে উপস্থিতির সুযোগ হারানো ছাড়া অন্য কোনও ক্ষতি নেই। রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস তৃণমূলের হাত বাংলায় আগামী লোকসভা নির্বাচনে ধরলে সিপিএম-এর এটাই প্রাপ্তি। কারণ রাজনীতি থেকে যখন বিশ্বাস, নীতি, আদর্শ এই শব্দগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে তখন সিপিএম নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ ধরে রেখে মানুষের মধ্যে এই বার্তা অন্তত দিতে পারবে, রাজনীতি থেকে এখনও নীতি, আদর্শ নামক শব্দগুলো বিলীন হয়ে যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের একটা অংশ এখনো আশায় বসে আছেন, বাংলায় কংগ্রেসকে সাইনবোর্ডে পরিণত করার জন্য হাই কমান্ড পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসকে তৃণমূলের হাত ধরতে হয়তো বলবে না। তাদের আবার এই আশঙ্কাও রয়েছে, বিজেপিকে পরাজিত করে ভারতের শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য কংগ্রেস হয়তো বাংলার ৪২টি আসনে নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দেবে, কারণ বাম-কংগ্রেস জোটের অতীত ফল আশাপ্রদ হয়নি, সেটাও নজরে রয়েছে হাই কমান্ডের। তাই বলা যায় বাংলায় “ইন্ডিয়া” ব্লকের জোট রসায়ন এখনো ঘোলাটে। বাকিটা সময় বলবে।