- খাস-কলম
- জুন ৩, ২০২৩
বাংলায় প্রকট ভাষা সন্ত্রাস, রাজনীতিতে রাজনীতিটাই নেই

বঙ্গরাজনীতিতে এখন ভাষা সন্ত্রাস চলছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। শাসক-বিরোধী উভয়পক্ষই পরস্পরকে দীর্ঘদিন ধরেই কুকথার বানে বিদ্ধ করছে, এটা কোনও নব জোয়ার যাত্রা দেখে হিংসা বা ঈর্ষার প্রতিফলন বলে তৃণমূল যা বলছে সেটা আদপে নয়। তৃণমূল বলছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব জোয়ার যাত্রার সাফল্য দেখে কুকথা বলা আরো বাড়িয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী, এটাই তৃণমূলের বর্তমানে অন্যতম অভিযোগ শুভেন্দুর বিরুদ্ধে। পাল্টা শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর দল বলছে, তৃণমূল শেষ লগ্নে এসে পৌঁছেছে। তাই রাজনীতির ভাষায় কুকথা আমদানি করছে। আর এই নিয়ে শাসক-বিরোধী তুই-তোকারি সম্বোধনে রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো অকথা -কুকথার লড়াই চলছে।
তৃণমূলের অভিযোগ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার কর্মসূচির সাফল্য ও জনউন্মাদনা দেখে এক প্রকার চাপে পড়ে অভিষেককে ‘তুই তোকারি’ সম্বোধন করছেন শুভেন্দু অধিকারী। শুক্রবার ধানতলা থানার কুলগাছি গ্রামে গিয়েছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তারপর বহিরগাছিতে দলীয় কর্মসূচিতে একটি সভা থেকে অভিষেককে আক্রমণ করতে গিয়ে শুভেন্দু ‘তুই তোকারি’ করে বলেন, ‘‘যদি সাহস থাকে আটকে দেখা। আমার রাজনীতির বয়স ৩৩ বছর। তুই যার আলোয় আলোকিত, তোর পিসিমণি, তাঁকে আমি হারিয়েছি।’’
কে কাকে আগে “তুই তোকারি” করেছেন সেটা তর্কাতীত বিষয়। আমরা যদি একটু পিছিয়ে যাই তাহলে দেখব, কাঁথির এক নির্বাচনী জনসভায়, শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ির অদূরের সেই সভা থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আয়, এই তো আমি তোর বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সাহস থাকলে যায়। তোর বাপকে ডাক। গদ্দার , বিশ্বাস ঘাতক। আয় সাহস থাকলে আয়।” সম্প্রতি নন্দীগ্রামেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারীকে “তুই” সম্বোধন করে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তার পরের দিন শুভেন্দু বলেছেন, আমার চেয়ে ১৭/১৮ বছরের ছোট একটা ছোকরা, আমাকে এই ভাষায় আক্রমণ করছেন। সেই শুভেন্দুই আবার অভিষেককে কটাক্ষ করে , সমালোচনা করে বলছেন, “কী ভাষা?”
শুক্রবার বরানগরে এক দলীয় সভায় সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, “প্রতারকদের পিঠের চামড়া তুলে দিন। বিজেপি, আর তৃণমূলীদের মারবেন না, ওদের নগ্ন করে দিন।” এই নিয়েও শমীক ভট্টাচার্য বিকাশবাবুকে বিঁধে বলেছেন, “বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো প্রবীণ রাজনৈতিক, সাংসদ, প্রবীণ আইনজীবী যদি এই ভাষায় কথা বলেন তাহলে পাড়ার ঝন্টুরা তো বলবেই।”
তবে আমরা ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বা ২০২১ এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে যদি ফেরা যায় তাহলে মনে পড়বে, বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলছেন, “দিদি, ও দিদি?” প্রধানমন্ত্রীর এই দিদি , ও দিদি বলার মধ্যে একটা রসিকতা ছিল, বিদ্রুপ ছিল। তারপর এই নিয়ে বহু আলোচনা, তর্ক আলোচনা হয়েছে। তার পরেও কেউ কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে ছাড়েননি। এখনও প্রায় প্রতিদিন রুটিন করে শুভেন্দু অধিকারী ভাইপো, ভাইপো বলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যাঙ্গ করেন, কটূক্তি করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে “বেগম” বলে সম্বোধন শুভেন্দু আগে বহুবার করেছেন। শীর্ষ আদালতের থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে বলে দুটো নির্দেশ থাকার পরেও কেউ এসব মানছেন না।
এক সময় সিপিএম নেতা বর্তমানে প্রয়াত অনিল বসু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে “কুকথায়” ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন। সিপিএম দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। ওসব এখন অতীত। এখন রাজনীতির বাজারে সেই বড় নেতা যে যত খারাপ কথার তুবড়ি ছোটাতে পারে। মনে পড়ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নাম করে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে ২০১১-র বিধানসভা নিৰ্বাচনের আগে রাজ্যের বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন এবং তার পরেও লোকসভা নির্বাচনে শ্রীরামপুর থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছেন এবং লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জিতে সাংসদ হয়েছেন। কাজেই আজ শুভেন্দু অধিকারী অভিষেকের নব জোয়ার যাত্রা দেখে অভিষেককে “তুই তোকারি” বলে গালমন্দ করছেন তৃণমূলের এই ব্যাখ্যাটা বোধ হয় সঠিক ব্যাখ্যা নয়। বঙ্গরাজনীতিতে এই “তুই তোকারি”-র আমদানি অনেক আগেই হয়েছে।
এদিকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেন্দুর এই ‘তুই তোকারি’ সম্বোধন নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘শুভেন্দু ১৫ বছরের ছোট অভিষেককে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন। ব্যক্তি ঈর্ষায় অভিষেককে আক্রমণ করেন, ব্যক্তিগত চক্রান্তমূলক কথা বলেন। অভিষেক মাথা উঁচু করেই তার জবাব দিচ্ছেন। দিল্লি নিয়ন্ত্রিত এজেন্সিকে ব্যবহার করে নিজের সাংগঠনিক ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন শুভেন্দু। তাতে সোজা ভাষায় উত্তর দিয়েছেন অভিষেক।’’
কুনাল ঘোষের দাবি, বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামে অভিষেকের কর্মসূচিতে জনবিস্ফোরণ ঘটে। রাত সওয়া ন’টা নাগাদ নন্দীগ্রামের তেঙ্গুয়া মোড়ে ছিল লক্ষাধিক মানুষ। এই জায়গা থেকেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তুলোধোনা করেন বিরোধী দলনেতাকে। বক্তব্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুভেন্দু অধিকারীকে টার্গেট করেন অভিষেক। বলেন, “নন্দীগ্রামের মানুষ চাইলে এই গদ্দারের বাড়ি থেকে বার হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।” কুনাল ঘোষের দাবি, নন্দীগ্রামে অভিষেকের এই কর্মসূচিতে জনবিস্ফোরণ দেখে চাপে পড়ে গিয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। আর তাই চাপে পড়েই শুক্রবার অভিষেককে কুরুচিকর ভাষায় ব্যক্তি আক্রমণ ও ‘তুই তোকারি’ সম্বোধন করেছেন শুভেন্দু।
তবে যে কুণাল ঘোষ অভিষেককে “তুই” বলার জন্য শুভেন্দু অধিকারীকে এতো গালমন্দ করছেন সেই কুণাল ঘোষ কতবার সারাদিনে শুভেন্দু অধিকারীকে তোলাবাজ, গদ্দার, তুই তোকারি করেন প্রতিদিন সেটা বাংলার মানুষ দেখছেন। তাই বলা ভালো “তুই তোকারি” তে কেউ কারো থেকে এগিয়ে বা পিছিয়ে নেই। বাংলার রাজনীতিতে ভাষা সন্ত্রাস বা কুকথা এখন জরুরি উপাদান। কারণ রাজনীতিতে এখন সব আছে, শুধু রাজনীতিই নেই।
❤ Support Us