- দে । শ স্মৃ | তি | প | ট
- জানুয়ারি ১০, ২০২৫
পড়ে রইল মুক্তবুদ্ধির চিহ্ন, প্রয়াত বরাকের বুলবুল। শোকে স্তব্ধ ঈশান বাংলা

বরাক উপত্যকা আর মহান উনিশের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ ইমাদউদ্দিন বুলবুল-এর ইহজাগতিকতা থমকে গেল। শুক্রবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃ্ত্যু হয়েছে। বুকে যন্ত্রণা শুরু হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যা্ওয়ার পথেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।পরে হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। মৃত্যুর খবর পেয়ে বন্ধু, অনুগামী ও শিলচর আদালতের আইনজীবীরা একে একে ছুটে আসেন। জন্মাঞ্চল কাটিগড়ায় ছড়িয়ে পড়ে শোকবার্তা।
প্রাথমিক লেখাপড়া কাটিগড়ার প্রাথমিকে, পরে দেওরাইল মাদ্রাসায়। ওখান থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী। শিলচর কাছাড় কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স; পরে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, সাংবাদিকতা আর আইন নিয়ে পড়াশুনোয় তাঁর সাফল্যের ধারাবাহিকতা উজ্জ্বলতর হতে থাকে বিদ্যার অভ্যাসে। গুয়াহাটি থেকে ফিরে শিলচর জেলা আদালতে আইন প্র্যাকটিস শুরু করেন ইমাদউদ্দিন। এখানেও সফল আইনজীবীর সুনাম ছুঁতে থাকে তাঁর বাকপটু স্বভাব আর মুক্ত চিন্তাকে। প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধী বলে তাঁর খ্যাতি ছিল সব স্তরে, সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার ঝলসে উঠত এমাদের যুক্তি, বিবেক আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা।৬০ এর দশকে, কবিতা দিয়ে আরম্ভ হয় তাঁর সাহিত্যিক যাত্রা। মুক্তক ছন্দের পদ্য, নির্মোদ গদ্যভাষা আয়ত্ত করেছিলেন কৈশোরে। একদিনের কাব্য, একরাতের কাব্য শীর্ষক দুটি কবিতা সঙ্কলনের ভাবাবেগ আর রোমান্টিকতায় বুদ্ধিদীপ্ত পাঠক ছাড়াও সাধারণের মধ্যেও আলোড়ন তৈরি করে।দক্ষিণ অসম জুড়ে গণমুখে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। মাদ্রাসা, কলেজজীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে কখনো স্তব্ধ হয়নি তাঁর সাহিত্যচর্চা। শিকড় আর শিকড়ের বিস্তার স্পর্শ করে লিখতেন সব্যসাচীর মতো। কবিতার তথাকথিত আধুনিকতা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেও, সাহিত্যপ্রীতিতে, জীবনবোধে আপসকে প্রশ্রয় দেননি কখনো।

অসমের প্রাক্তন মন্ত্রী ড. লুতফুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ইমাদ উদ্দিন । ১৯৭৬, গুয়াহাটি
পরিণত বয়সে, কথা সাহিত্য আর গবেষণাজাত লেখালেখি তাঁর স্বশাসিত বুদ্ধিচর্চার প্রধানতম অবলম্বন হয়ে ওঠে। প্রকাশিত উপন্যাস সুরমা নদীর চোখে জল-এ বিভক্ত দক্ষিণ অসম ও অবিভক্ত সিলেটের জয় পরাজয়কে যথাসম্ভব চিহ্নিত করতে চেয়েছেন এমাদ, মাঝে মাঝে গল্প লিখেছেন, শেষের দিকে কবিতা থেকে সরে গিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনায় নিয়োজিত হতে থাকে তাঁর ইতিহাস চেতনা, তাঁর যুক্তি প্রবণতা, তাঁর মুক্ত চিন্তা আর বিবেক মগ্নতা। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘দেশি ভাষা বিদ্যা যার’ এবং তিনখণ্ডে প্রকাশিত বরাক উপত্যকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ও গভীরতা ভুলে থাকা সম্ভব নয়। উনিশের ভাষা আন্দোলনের গৃহশত্রুদের যে ভাষায়, যে দৃষ্টিতে ইমাদ সনাক্ত করেছেন, তা অতুলনীয়। তথ্য গোপনীয়তা, বিভ্রান্তির অতিরঞ্জন এবং রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক বিভাজকদের রেহাই দেননি। প্রয়োজনে হয়ে উঠেছেন তীর্যক, প্রবল দুঃসাহসী। সব সমাজে গ্রহনশীলতার প্রশ্নে অজাতশত্রু, আবার বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতায় যাঁরা প্রশ্নহীন থাকতে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে গুরুত্ব দেন, তাঁর ইমাদের যুক্তিচর্চাকে, প্রশ্নময়তাকে গৃহশত্রুর পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন। তবু হাল ছাড়েননি মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা। হুরমল আলি বড়ো লস্কর, গোলমা ওসমানি, ঐতিহাসিক দেবব্রত দত্ত, জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক অমরেশ দত্ত, সুজিত চৌধুরী, কামালউদ্দিন আহমেদকে যেরকম বরাক ভোলেনি, ভুলতে পারবে না, ঠিক সে আদলেই ইমাদউদ্দিন বুলবুলকে মনে রাখবেন তাঁর জন্মাঞ্চলের মানুষ। বরাক নদীর দুর্দশা, কৃষকদের পীড়িত মুখ, শহরকেন্দ্রিক একাংশের আত্মকেন্দ্রিকতা এবং ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা দেখতে দেখতে ইমাদউদ্দিনের হয়ে ওঠা আর চিন্তার বিবর্তন প্রজন্মকে সম্ভবত পথ দেখাবে। বিদ্যাভাসে, তাঁর বুদ্ধির অনুশীলনে তাঁর স্বাতন্ত্র্য, সাংগঠনিক উদ্ভাসে তাঁর সংযুক্তি ও সহজিয়া উচ্চারণের উত্তরাধিকার পড়ে রইল। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সহসভাপতি হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন, অসুস্থ শরীর নিয়েও ৮ জানুয়ারি সম্মেলনের ৪৯তম প্রতিষ্ঠা দিবসে যোগ দিয়েছেন ।এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা নয়, হঠাৎ থমকে গেল তাঁর শারিরীক ইহযাত্রা। তাঁর আচমকা প্রয়াণে স্তব্ধ বরাক, স্তম্ভিত চলমান ইতিহাস। আগামীকাল শেষকৃত্য, এরপর কবরে শায়িত থাকবেন ঈশান বাংলার অন্যতম গৌরব। কবরের অন্ধকার অতিক্রম করে, সর্বপ্রাণবাদের সড়ক দিয়ে, মাঠ দিয়ে জলপথের গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়াবে তাঁর সমগোত্রীয় উপস্থিতি।
❤ Support Us